তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসার অল্পদিন পরেই জনপ্রিয়তায় আসে ভাটা। প্রতিশ্রুতিমাফিক করতে পারেননি কিছুই। এরমধ্যে আবার পুরো বিশ্বের মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের অনুভূতিতে দিয়েছেন আঘাত। সময়টা কী ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে ইমানুয়েল ম্যাখোঁর?

বাবার সাথে বাইরে গেলাম একটা কাজে। রাস্তায় নেমেই আটকে গেলাম। বিশাল একটা মিছিল যাচ্ছে। 'ফরাসি পন্য বর্জন করুন' প্ল্যাকার্ড নিয়ে যাচ্ছে একদল মানুষ। এছাড়াও শ্লোগানে আরো কথাবার্তা হচ্ছিলো। এরমধ্যে একটা লাইন কানে ঢুকে গেলো। 'মাইক্রো'র বেয়াদবি , মানি না, মানবো না।' ভাবলাম, মাইক্রো টা কে? মাইক্রোওয়েভ ওভেন? নাকি, মাইক্রো বাস? পরে বুঝলাম, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ'কে নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। খুব একটা অবাক হলাম না।  ফরাসি নামগুলো আসলে বেশ খটকারই।  যেমন হার্জের অমর সৃষ্টি 'ত্যাঁত্যাঁ' এ দেশে হয়ে গিয়েছে টিনটিন। তো, এভাবেই বিবর্তিত হয়ে ম্যাখোঁ হয়ে গিয়েছে মাইক্রো। যাক, সেটা ব্যাপার না। খুব অল্পবয়সে প্রেসিডেন্ট হয়ে এবং নিজের চেয়ে পঁচিশ বছরের বড় একজনকে বিয়ে করে ইমানুয়েল প্রথম থেকেই জনগনের চোখে এক 'ধামাকা।' এই ধামাকা কীভাবে হলো, কী করে শুরুটা তার, কেনই বা ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পরেই তাকে নিয়ে শুরু হয়েছিলো সমালোচনা, কেনই বা এখন বাংলাদেশের আপামর জনগনও তার বিচার চাচ্ছে, সেটাই জানার চেষ্টা করা যাক বরং।

তার আসল নাম ইমানুয়েল জঁ-মিশেল ফ্রেদেরিক ম্যাখোঁ। ফ্রান্সের মানচিত্রের উত্তরদিকের শহর আমিয়াঁ'তে জঁ-মিশেল ম্যাখোঁ এবং ফ্রঁসোয়াজ নোগেস এর ঘরে জন্ম নেন ইমানুয়েল। ছোটবেলার পড়াশোনা শুরু হয় আমিয়াঁতেই। বয়স যখন তার মাত্র ১৬, তখনই ৪১ বছরের স্কুলের নাটকের শিক্ষিকার প্রেমে পড়েন তিনি। পরিবার এই অসম প্রেমের বিষয়টি জানার পরে ম্যাখোঁকে নানাভাবে আটকানোর চেষ্টা করেন। যদিও লাভ হয়নি। সে অন্য আলাপ। আপাতত বালক ম্যাখোঁতে থাকি। অন্যান্য অনেক রাজনীতিবিদের মতনই ছোটবেলায় রাজনীতি তাকে খুব একটা টানতোনা। পছন্দ ছিলো সাহিত্য। হতে চেয়েছিলেন ঔপন্যাসিক। কিন্তু 'ললাট' বলেও তো একটা কথা আছে। সেখানেই আটকে যান তিনি। স্কুল থেকে পাশ করে বের হন একসময়ে।

পারি নঁতের বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর পরবর্তীতে তিনি পড়াশোনা করেন সিয়ঁস পো এ। জনসংযোগ বিষয়ে স্নাতকোত্তর উপাধি অর্জন করেন তিনি এখান থেকে। এরপর তিনি ফ্রান্সের বিখ্যাত একল নাসিওনাল দাদমিনিস্ত্রাসিওঁ থেকে গ্রাজুয়েশন সমাপ্ত করে বের হন। তিনি ফ্রান্সের আঁস্পেকসিওঁ জেনেরাল দে ফিনঁস (অর্থসংস্থান পরিদর্শকদের সাধারণ কার্যালয়) এ কাজ করেন কিছু বছর। এরপর রথসচাইল্ড অ্যান্ড কো নামক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ ব্যাংকার হিসেবে কাজ করেন।

২০০৭ সালের দিকে এসে এক কাণ্ড করেন তিনি। ষোল বছর বয়সে একচল্লিশ বছর বয়স্ক যে স্কুল শিক্ষিকার প্রেমে পড়েছিলেন তিনি, তাকে বিয়ে করেন। ব্রিজিত ত্রোইনিও নামের সেই স্কুল শিক্ষিকা তার স্বামী ও সন্তানদের ছেড়ে চলে আসেন ইমানুয়েল এর বিবাহিত স্ত্রী হয়ে।

ইমানুয়েল ম্যাখোঁ ও তার স্ত্রী ব্রিজিত ত্রোইনিও! 

২০১২ সালের ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজয়ী হন ফ্রঁসোয়া ওলঁদ। এই রাষ্ট্রপতির আমলেই ম্যাখোঁকে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের উপ-মহাসচিব পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এর দুই বছর পর তিনি ফরাসি মন্ত্রীসভাতে ইকোনমিক্স, আর্ট এন্ড ডিজিটাল বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ২০১৬ সালের তিনি মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন এবং ২০১৭ সালের ফরাসি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা শুরু করেন। যদিও তিনি তার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম কয়েক বছর ফ্রান্সের সমাজতান্ত্রিক দল 'পার্তি সোসিয়ালিস্ত' এর সদস্য ছিলেন। কিন্তু তিনি যখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দাঁড়ালেন, তখন তিনি তার সদ্য খোলা "অঁ মার্শ" নামক রাজনৈতিক দলের ব্যানারে নির্বাচন শুরু করলেন।

প্রথম দিকে জনমত জরিপে পিছিয়েও ছিলেন তিনি। কিন্তু এরপরেই সব সমীকরন ঘুরে যায়। ৬২.১% ভোট পেয়ে মাত্র ৩৯ বছর বয়সী ম্যাখোঁ হয়ে যান ফ্রান্সের ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রপতি। তিনি বিজয়ী হয়েই এদুয়ার ফিলিপকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন। এরও এক মাস পরে তাঁর নেতৃত্বাধীন 'লা রেপ্যুব্লিক অঁ মার্শ' ২০১৭ সালের ফ্রান্সের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে  সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

ফরাসিরা এমনিতেই একটু বেশি অধিকার সচেতন। সেখানে আগের শাসকদের ক্রমাগত ব্যর্থতায় তারা খুঁজছিলেন নতুন মুখ। ম্যাখোঁ'তেই তাই তারা খুঁজে পেলেন ভরসা। অকুন্ঠ সমর্থনও তাই ম্যাখোঁ পেয়ে যান খুব তাড়াতাড়িই। তাছাড়া ফ্রান্সের জন্যে যা যা কল্যানকর;  দুর্নীতি কমানো, শিক্ষা বাড়ানো, কর্মসংস্থান বাড়ানো... অনেক বিষয়েই বেশ আশ্বাসের বাণী শোনান তিনি। জনগনের বেশ মনে ধরে প্রতিশ্রতিগুলো। এছাড়া তার অসম বয়সী বিয়েও অনেকটাই আলাদা করে তাকে পরিচিতি দিয়েছিলো। এসব কারণ মিলিয়ে ম্যাখোঁ কারিশমায় বুঁদ ছিলো গোটা ফরাসি রাজ্য।

কিন্তু সে কারিশমা ফুরোতেও সময় লাগে নি। খুব অল্পসময়ের মধ্যেই তার জনপ্রিয়তা পড়তে শুরু করে। ফরাসীরা এমনিতেই অল্পতেই অসন্তুষ্ট জাতি। তারা ম্যাখোঁ'র কাছ থেকে জাতীয় সমস্যাগুলো নিয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছিলো না। কথা দিয়ে যে সবকিছু হয় না... ম্যাখোঁ সেটাও বুঝেছেন হাড়েহাড়েই। ক্ষমতায় আসার অল্পদিনের মধ্যেই তার জনপ্রিয়তায় ব্যাপক ভাটা পড়তে শুরু করে।

এই গেলো ম্যাখোঁর কথা। বাংলাদেশে কেন ম্যাখোঁ'র বিরুদ্ধে কথা বলা হচ্ছে, সেটাও আমরা জানি। তবে ধর্ম অবমাননার জন্যে যে ম্যাখোঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে, সেই ম্যাখোঁই কিন্তু বলেছিলেন, ফ্রান্সে কোনো ধর্মকে অবমাননা করা হবে না৷ ধর্মনিরপেক্ষতা সংক্রান্ত ফ্রান্সের মূলনীতি "লাইসিতে"-র (laïcité)ও জোরালো সমর্থক ছিলেন তিনি। ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপতি পদপার্থী হিসেবে বক্তৃতায় তিনি স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন, ফ্রান্সে সবাই নিরাপদে যার যার ধর্ম পালন করতে পারবে। ফ্রান্সের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম নারীদের হিজাব পড়ার  উপরে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলো। ম্যাখোঁ তখন এই বিষয়ে তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলেন। হিজাব পড়ার অধিকার সব মুসলিম নারীরই আছে, এরকমভাবে মুসলিমদের পক্ষেই বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি। আবার তিনিই শার্লি আব্দোতে প্রকাশিত ইসলাম ধর্মের নবী হযরত মুহম্মদ (স) এর ব্যাঙ্গাত্মক ছবিকে সমর্থন করেছিলেন এবং 'বাক-স্বাধীনতা'র কথা বলেছিলেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতাও করেছিলেন।

সারা বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায় ক্ষেপে গিয়েছেন ম্যাখোঁর উপর

এসব ছাড়াও নানারকম কাজকর্ম করে তিনি জনগনের নেকনজরে আসার জন্যে বেশ জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে খুব যে সফল হচ্ছেন না, তা বলাই বাহুল্য। ইমানুয়েল ম্যাখোঁ তার কাজকর্মের জন্যে বেশ অনেকদিন ধরেই প্রশ্নবিদ্ধ, তা আমরা জানি। কিন্তু তিনি আর কতদিন এভাবে থাকতে পারেন ক্ষমতার মসনদে, এটাই আপাতত দেখার বিষয়। সে সাথে চলমান আন্দোলনের প্রভাবে ফ্রান্স রাজনৈতিকভাবে কতটা কোনঠাসা হবে অদূর ভবিষ্যতে, এটাও ভূ-রাজনীতির অন্যতম গবেষণার বিষয়। এই টালমাটাল পরিস্থিতি ম্যাখোঁ কীভাবে সামলাবেন, সবার নজর থাকবে সেদিকেও। 

আপাতত, দেখা যাক, কী হয় সামনে!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা