যে কাজের জন্য ১০০ ঘোড়া দরকার সেখানে দশটা গাধা বসিয়ে রাখলে এরকম অবস্থাই হবে...
যে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক নিয়োগ পান বান্ধবী কোটায়, যে প্রতিষ্ঠানের জনৈক গবেষক মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নিজের পদবী পাল্টে দেন, নিজেদের দূর্বলতাগুলো বারবার প্রমাণিত হওয়ায় পরও যারা নির্লজ্জের মত অস্বীকার করে যান, তাদের নিয়ে কথা বলতে আর রুচি হয় না। তারপরও বলতে হয়, কারণ তারা এখনো মানুষকে চরমভাবে ভুগিয়ে যাচ্ছেন। এবং তাদের থামানো না গেলে সেই ভোগান্তি সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। যার মূল্য দিতে হবে সারা দেশের মানুষকে।
একজন সরকারি চিকিৎসক কর্মকর্তা কোভিড-১৯ পজিটিভ হন গত ১৩ এপ্রিল। সাথে সাথেই ভর্তি হন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। ভাইরাস মুক্ত হয়েছেন কিনা সেটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি ২১ এপ্রিল আবার পরীক্ষা করেন। গত ২৩ এপ্রিল গুনে মানে অনন্য এবং অদ্বিতীয় সেই প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁকে জানানো হয় তিনি কোভিড নেগেটিভ। ২৫ তারিখ আবার নমুনা নেয়া হয়, কারণ একজন রোগির ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে দুইবার নেগেটিভ ফল আসলেই বলা যাবে, তার শরীরে করোনা ভাইরাস অনুপস্থিত।
৭২ ঘন্টা পর অর্থাৎ ২৮ এপ্রিল তাকে জানানো হয় তিনি কোভিড পজিটিভ! কারণ জানতে চাওয়া হলে বলা হয়, আগেরবার হয়ত ফলস নেগেটিভ রিপোর্ট এসেছিল! এর মধ্যে ডাক্তার সাহেব নিজে থেকেই ২৭ এপ্রিল আবার নমুনা দেন এবং ৩০ তারিখ জানতে পারেন ফলাফল নেগেটিভ এসেছে। ওইদিনই আবার নমুনা নেয়া হয়, এবং তিনি সেই রিপোর্টের জন্য অপেক্ষায় আছেন। উনি কতদিনে রিপোর্ট পাবেন জানি না। শুধু আতংকে আছি এবার যদি আবার ফলাফল পজিটিভ আছে, তখন তিনি কি করবেন?!
একজন নারী চিকিৎসক তাঁর মায়ের মৃতদেহ নিয়ে আমার হাসপাতালে আসে গত ২১ এপ্রিল। যে হাসপাতালে তিনি ভর্তি ছিলেন সেখানকার ডাক্তাররা তাকে কোভিড-১৯ সন্দেহ করে পরীক্ষা করতে বলেন। আমার এবং আমার হাসপাতালের ব্যর্থতা যে সেদিন আমরা সেই ডাক্তারের মায়ের নমুনা সংগ্রহ করতে পারিনি। দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা মায়ের লাশ নিয়ে বসে থেকে উনাকে ফিরে যেতে হয়েছিল। সেই একই প্রতিষ্ঠান থেকে নারী চিকিৎসককে জানানো হয় তাঁর মা কোভিড-১৯ পজিটিভ। যার শরীর থেকে নমুনাই সংগ্রহ করা হয়নি, তাকে পজিটিভ বলা হচ্ছে! তাহলে যার সত্যিকারের পজিটিভ, সেই রোগি কোথায় হারিয়ে গেল?
ভুক্তভোগি নারী চিকিৎসক আমাকে ফোনে জানালেন, "স্যার আমার মায়ের ডেডবডি থেকে স্যাম্পল নেয়া যায়নি, সেটা আমি মেনে নিয়েছি, কারণ আমি দেখেছি আপনারা চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যার স্যাম্পলই নেয়া হয়নি সে কিভাবে পজিটিভ হয়? এখন আপনি দয়া করে তাদের বলেন এরকম মানসিক অবস্থায় আমাকে যেন লকডাউনের মত পরিস্থিতিতে না পড়তে হয়।" আমি কোন জবাব দিতে পারিনি, একজনের কাছে কতবার লজ্জিত হবো? পরে উনাকে ফোন করে জেনেছি, হর্তাকর্তাগণ দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সিরিয়ালে উলটপালট হওয়ার কারণে সেদিন যে আরো কত মানুষ ভুল রিপোর্ট পেয়েছে এবং তাদের ট্রেস করে এখন কি করা হবে, এই বিষয়ে উনাদের পক্ষ থেকে কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
আর কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং? আমি নিজ দায়িত্বে অন্তত ৫ জন কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগির কথা জানি, যাদের সেই অনন্য প্রতিষ্ঠান থেকে শুধু রিপোর্টটি জানিয়ে দেয়া ছাড়া কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং সম্পর্কে একটা প্রশ্নও করা হয়নি। অন্তত ১০ জনের কথা বলতে পারি যারা ঐ প্রতিষ্ঠানে নমুনা দেয়ার ৭-১০ দিন পর জেনেছেন উনারা কোভিড-১৯ পজিটিভ। সবচে আতংকের কথা অনেককেই কোন ধরণের রিপোর্ট বা এসএমএস দেয়া হচ্ছে না, শুধু ফোনে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা তো ভয়ংকর অভিযোগ। তাহলে কি প্রতিদিন রোগি সনাক্তের যে পরিসংখ্যান দেয়া হচ্ছে, সেটি থেকে অনেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে?
যে কোন পরীক্ষার রিপোর্টে ভুল হতে পারে। কিন্তু সেগুলো সংশোধনেরও পদ্ধতি আছে। কিন্তু নিজেদের নিখুঁত দাবি করা সেই অথর্ব মানুষগুলো সেই পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করছেন না। গুটিকয়েক মানুষ খেটে যাচ্ছেন, বাকিরা শুধু মিডিয়ায় বাণী বিতরণ করে যাচ্ছেন। একেকটি রিপোর্ট দিতে ৩-৪ দিন সময় লেগে যাচ্ছে। এর মধ্যে সেই রোগি অনেককে সংক্রমিত করে ফেলছে, কেউ কেউ মারাও যাচ্ছেন। গত ২৬ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করা একজন ব্যাংক কর্মকর্তা লক্ষণ প্রকাশের পর একবার না, দুইবার কোভিড-১৯ পরীক্ষা করিয়েছিলেন, ফল নেগেটিভ এসেছিল। পরে গুরুতর অসুস্থ হলে আবার পরীক্ষা করেন। মৃত্যুর পর জানা যায় তিনি কোভিড পজিটিভ ছিলেন। এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে।
যে কাজের জন্য ১০০ ঘোড়া দরকার সেখানে ১০টা গাধা বসিয়ে রাখলে এরকম অবস্থাই হবে। তারপর আবার কর্তা ব্যক্তিরা নিজেরাই ঘোড়া আর গাধার পার্থক্য বোঝেন না। ভাগ্য ভালো, আমাদের মত কিছু অধমের একটানা প্রতিবাদকে আমলে নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি জেলায় পিসিআর ল্যাব চালু করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এখন দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গড়ে ৪-৫ হাজার টেস্ট হচ্ছে।
প্রতিদিন প্রেস ব্রিফিংয়ের নামে সার্কাস থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিলেই অতীতের সব অপকর্ম মাফ হয়ে যাবে না। একদিন ঠিকই জবাব দিতে হবে। তবে দুই একটি টিভি চ্যানেল এখনো গবেষক স্যারের মোহ কাটাতে পারছে না। তাই এখনো উনার সার্কাস চলছে। নিজের প্রতিষ্ঠানের হাজারো ভুলভ্রান্তি ধামাচাপা দিতে উনি করোনা হাসপাতালে অক্সিজেন সরবারহ কম হওয়ার জন্য দায়ী করছেন ভিআইপি রোগিদের। তারা বলে প্রয়োজন না থাকলেও নিজেদের কেবিনে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে রেখেছেন!
কি চমৎকারভাবে সরকার এবং জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেন। এর আগে আবার বাণী দিয়েছেন, "মহামারিতে পরীক্ষা করার প্রয়োজন নেই, লক্ষণ দেখেই চিকিৎসা"। এই মহান গবেষককে অনতি বিলম্বে আবার হোম কোয়ারাইন্টাইনে পাঠানো জরুরি হয়ে পড়েছে। এবং সেখানে কোন ইন্টারনেট সংযোগ থাকতে পারবে না।