
দেশে ভুয়া লিংকে ক্লিক করে আইডি হারানো এবং পরবর্তীতে হয়রানির শিকার হওয়ার এমন অভিযোগ বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
আব্দুল্লাহ আল ইমরান: প্রথমেই সাম্প্রতিক একটি ঘটনা বলি। মেয়েটির নাম নাদিয়া। মেডিকেলের ছাত্রী। রাতে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী তানহা তাকে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে একটি নিউজ পোর্টালের লিংক পাঠিয়ে বলেছে, ‘রান্নার রেসিপিটা দেখ। একেবারেই আলাদা।’
কৌতূহলি নাদিয়া লিংকে ক্লিক করতেই দেখল ফেসবুক হঠাৎ লগ আউট হয়ে গেছে। নাদিয়া ভাবল, হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে। পুনরায় সে ফেসবুকের হোম পেজে ফোন নাম্বার ও পাসওয়ার্ড টাইপ করল। কিন্তু ফেসবুকে আর ঢুকতে পারল না। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই হ্যাক হয়ে গেল নাদিয়ার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট!
প্রিয় বান্ধবী এমন কাজ করতে পারল! রেগে-মেগে তানহাকে ফোন করে কড়া কথা শোনাতে যাবে, ফোন দিয়ে জানতে পারলো ঘণ্টাখানেক আগে তানহার ফেসবুক আইডিটিও ছিনতাই হয়ে গেছে। সেও মহা বিপদে পড়েছে। একই কায়দায় হ্যাকার তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের ফাঁদে ফেলছে। আর বিকাশ নাম্বার দিয়ে টাকা দাবি করছে।
মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল নাদিয়ার। অজানা এক ভয় ঘিরে ধরল চৌদিকে। টাকার জন্য না, ভয় ম্যাসেঞ্জারের ব্যক্তিগত আলাপ নিয়ে। ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে প্রতিরাতের কথোপকথোনে কত আলোচনাই তো হয়েছে। কত ব্যক্তিগত মূহুর্তের আদান-প্রদান। এগুলো যদি হ্যাকারের হাতে পড়ে! সে যদি ছড়িয়ে দেয়! বুক কেঁপে ওঠে নাদিয়ার। নিঃশ্বাসের গতি বেড়ে যায়!
ভালোবাসার মানুষটিকে সব জানাল। সবাই নামল আইডি উদ্ধারে। কিন্তু হ্যাকার নাদিয়ার আইডিতে প্রবেশের সব তথ্য বদলে ফেলায় এবং ফেসবুকে কোনো রিকভারি মেইল বা ব্যাকআপ নাম্বার না থাকায় কিছুতেই কিছু হলো না। আইডিটি আর উদ্ধার করা গেল না। ওদিকে হ্যাকার নাদিয়া সেজে ফ্রেন্ডলিষ্টের ঘনিষ্টজনদের জরুরি ভিত্তিতে বিকাশে টাকা চেয়ে ম্যাসেজ পাঠাতে শুরু করেছে। এখন উপায়?
দেশে ভুয়া লিংকে ক্লিক করে আইডি হারানো এবং পরবর্তীতে হয়রানির শিকার হওয়ার এমন অভিযোগ বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। চটকদার সংবাদের লিংক, প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হতে ভোট চেয়ে অনুরোধ, চেহারা দেখতে কোন তারকার মতো বা কার সঙ্গে বিয়ে হবে এমন উদ্ভট জরিপ, অনলাইনে বায়োমেট্রিক সিম নিবন্ধনের সুযোগসহ বিভিন্ন প্রলোভনে পড়ে ফেসবুক আইডি হারাচ্ছেন অনেকেই। দেশে প্রচলিত এই সাইবার ক্রাইমটিকে ‘ফিশিং’ বলে।

মুহুর্তের অসতর্কতায় ফিশিংয়ের শিকার হয়ে ভয়ানক সব বিপদে পড়ছেন ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। ফেসবুক আইডির দখল নিয়ে ব্যক্তিগত ছবি বা চ্যাট প্রকাশ করার ভয় দেখিয়ে হ্যাকাররা ভূক্তভোগির কাছ থেকে টাকা আদায়ের পাশাপাশি অনৈতিক সম্পর্ক গড়ারও প্রস্তাব দিচ্ছে। মান-সম্মান হারানোর ভয়ে এবং পরিত্রাণের আশায় অনেকে আবার এমন কুপ্রস্তাবে রাজি হতেও বাধ্য হচ্ছেন।
এমন হ্যাকিং বা ব্লাকমেইলিংয়ের শিকার হলে করণীয় পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় এবং প্রচলিত আইনে ভিকটিমের জন্য কী কী সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখা আছে তা জানা না থাকায় হ্যাকারের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করে বসেন অধিকাংশ ভুক্তভোগি।
কিন্তু এভাবে আত্মসমর্পণ বিপদ থেকে রক্ষা তো করবেই না উপরন্তু হ্যাকারকে আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী করবে নতুন নতুন অনৈতিক দাবি করতে। মনে রাখা জরুরি, সামান্য অসুখ নীরবে সহ্য করে করে ক্যান্সার বাঁধানোর মানে হয় না।
বছর ২ আগে দেশের ৪০টি স্কুল ও কলেজের ১০ হাজার ছাত্রীকে সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ বিষয়ক একটি প্রশিক্ষণ দিয়েছে সরকার। অষ্টম থেকে একাদশ শ্রেণির অল্প বয়সি মেয়েরা ওই প্রশিক্ষণ কর্মশালায় সাইবার অপরাধের শিকার হলে পরিত্রাণের উপায়, বিপদে পড়লে কোথায় জানাতে হবে এবং আইনে কী কী সুরক্ষার কথা বলা আছে তা জেনেছে।
কর্মশালায় অংশ নেয়া ১০ হাজার ২০০ শিক্ষার্থীর উপর একটি জরিপও করেছে সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ। ওই জরিপের ফলাফলে উঠে এসেছে উদ্বেগজনক চিত্র। যেমন, কর্মশালার ৯৩ শতাংশ ছাত্রীই জানে না যে দেশে এ সংক্রান্ত একটি আইন আছে।
জরিপের ফলাফলে আরো বলা হয়, কর্মশালায় অংশ নেয়া শিক্ষার্ধীদের ৬৯ শতাংশ ইন্টারনেট সেবা গ্রহণ করে। ওই ৬৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮৩ শতাংশই সামাজিক মাধ্যম যেমন ফেইসবুক, ভাইবার, ইমো, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি ব্যবহার করে। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ফেইসবুক, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মোট ব্যবহারকারীর ৯৪ শতাংশ।
সরকারের এ কর্মশালাগুলোতে বক্তা হিসেবে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। সাইবার অপরাধ ঠেকাতে নানা পরামর্শ দিয়েছি সেখানে। সে পরামর্শ ও প্রতিকারের উপায়সমূহ আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছুতেই এ লেখা।
অপরাধের শিকার হলে কী করবেন
ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে সাইবার অপরাধের ধরন ও অপরাধীর শাস্তির বিধানের কথা বলা আছে। কিন্তু প্রতিকার পেতে গেলে আপনাকে এ আইনটি ব্যবহার করতে হবে বা আইনের আশ্রয় নিতে হবে। এমন ঘটনায় আইডি উদ্ধারে ব্যর্থ হলে ভুক্তভোগিকে যা যা করতে হবে তা হলো-
ক. ঘটনার বিবরণ এবং বিকাশ বা রকেটের যে নম্বার পাঠিয়ে টাকা দাবি করছে তা উল্লেখ করে নিকটস্থ থানায় জিডি করতে হবে।
খ. থানা পুলিশ যদি পূর্ণ সহযোগিতা না করে অথবা ব্যর্থ হয় তবে জিডির কপি নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের হেডকোয়ার্টারে অবস্থিত সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এছাড়াও দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে পুলিশের ‘হ্যালো সিটি’ অ্যাপসের মাধ্যমে অভিযোগ দাখিল করলে প্রতিকার মিলবে। জিডির কপি দিয়ে অভিযোগ করলে সহযোগিতা করবে সিআইডির সাইবার পুলিশও।
ঘ. অভিযোগ দাখিলের পর তাড়াহুড়ো না করে কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে এবং নিয়মিত ফলোআপ করলে আপনি অবশ্যই প্রতিকার পাবেন। কেননা পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের আছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং আন্তরিক বহু কর্মকর্তা।

অনলাইনে সতর্ক থাকুন
বিপদে পড়ে সাহায্য প্রার্থণার চেয়ে আগাম সতর্কতা সাইবার অপরাধের শিকার হবার ঝুঁকি কমায়। যে সব বিষয়ে খেয়াল রাখলে বা পদক্ষেপ নিলে এমন বিপদ থেকে সুরক্ষিত থাকা যাবে তার কয়েকটি তুলে ধরছি।
ক. ই-মেইল ও ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড ভিন্ন রাখুন। হ্যাকাররা ফেসবুক হ্যাক করার পর মেইল এড্রেসও বদলে ফেলে। আর মেইল বদলে ফেলতে পারলে হ্যাকড হওয়া অ্যাকাউন্ট ফিরে পাওয়া কঠিন।
খ. কোথাও পাসওয়ার্ড প্রয়োজন হলে লক্ষ রাখুন এটি আসলেই মূল ঠিকানার এড্রেস কি না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুয়া সাইটগুলোতে পাসওয়ার্ড দিয়েই বিপদে
পড়ে মানুষ। যেমন ধরুন- facebook. com -এর পরিবর্তে যদি facebookie. com, facabook. com ইত্যাদি দেখায় তবে পুনরায় পাসওয়ার্ড টাইপ করা থেকে বিরত থাকুন।
গ. কাজ শেষে অবশ্যই লগ আউট করতে হবে। এক্ষেত্রে পাসওয়ার্ড রিমেম্বার দেওয়া যাবে না। পাবলিক কম্পিউটারে বসলে কাজ শেষে অবশ্যই cache এবং cookies ডিলেট করতে হবে।
ঘ. Facebook Password Reset Confirmation এ রকম ই-মেইলে ঢুকে পাসওয়ার্ড রিসেট ক্লিক করা থেকে বিরত থাকুন।
ঙ. ফিশিং বা অন্য কোনো উপায়ে পাসওয়ার্ড চুরির ক্ষেত্রে আইডির ক্ষতি ঠেকাতে ফেসবুক অ্যাকাউন্টে আপনার মোবাইল নম্বর দিয়ে রাখুন। এরপর account settings এর Security অপশনে গিয়ে change অপশনে ক্লিক করুন। Login Notifications এর নিচে লেখা Send me a text message সিলেক্ট করুন। এতে আপনার ব্যবহৃত ডিভাইস ছাড়া অন্য কোনো ডিভাইস থেকে লগ ইন করা হলে আপনার মোবাইলে বার্তা যাবে। এরপর Login Approvals এর নিচে লেখা Require me to enter a security code sent to my phone সিলেক্ট করুন। এতে কেউ আপনার অ্যাকাউন্টে লগ ইন করার চেষ্টা করলে মোবাইলে কোড পাঠাবে ফেসবুক। কোড ছাড়া কোনভাবেই লগইন করা সম্ভব হবে না।
সবার ইন্টারনেট ব্যবহার নিরাপদ হোক। মনে রাখা জরুরি, ভার্চুয়াল জগতে এক মুহুর্তের অসতর্কতা ভয়ানক সব বিপদ ডেকে আনতে পারে। ফলে, অনলাইন জগতে সতর্ক থাকুন, যৌক্তিক আচরণ করুন এবং অপরাধের শিকার হলে নীরবে সহ্য না করে অবশ্যই প্রতিবাদ করুন।