ষাটের দশকের শেষের দিক। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের ৫২ নম্বর সেলের ভেতর আধমরা অবস্থায় ২১-২২ বছরের এক যুবক পড়ে আছে। মাথা ফেটে রক্তে ভেসে গেছে মুখ, শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রচন্ড শারীরিক অত্যাচারের চিহ্ন স্পষ্ট। বন্ধুস্থানীয় ক'জন যুবক শঙ্কিত গলায় ডাকছে, 'মণিদা! এই মণিদা'!

পৃথিবীতে কিছু মানুষকে জন্মাতে হয় সময়ের প্রয়োজনে। পাথরে পা আটকে থেমে থাকা সময়কে হাত ধরে টেনে তোলেন সেসব মানুষরা। সময়ের অনেক আগে জন্মানো তেমনি এক বিপ্লবী ঘোড়া ছিলেন মণিদা। 

ভালো নাম- গৌতম চট্টোপাধ্যায়। তাঁর সময়ের আরো কিছু ঘোড়াকে নিয়ে গড়েছিলেন 'মহীনের ঘোড়াগুলি' নামের এক আস্তাবল। শক্তি এবং গতিতে নিজেদের সময়ের চাইতে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন তাঁরা।নকশাল আন্দোলনে সক্রিয়তার কারণে প্রায় একবছর কারাভোগ করেন গৌতম। জেল থেকে বেরিয়ে প্রথমে যান জাবালপুর এবং এরপর ভোপাল। পানির ভেতরে সৃষ্ট বায়ুর বুদবুদ যেমন পানির বাধার তোয়াক্কা করে না, তেমনি এত অত্যাচারের পরও গৌতমের সোজা-সত্য বলাটা আটকানো গেল না। তবে এবারের বলাটা একটু অন্যরকম... 

গৌতম চট্টোপাধ্যায়  

ভোপাল থেকে কলকাতায় এসে গড়লেন ভারতের প্রথম প্রোগ্রেসিভ-রক ব্যান্ড দল। কিন্তু ভিন্ন আমেজের মিউজিক, সহজ নাগরিক ঘটনাগুলোর অনন্যসাধারণ লিরিক্যাল উপস্থাপনাকে তখনকার ক্লাসিক্যাল একতরফা সংগীতে মজে থাকা বাঙালি ছুঁতে পারেনি। এক কাবুলিওয়ালার ধারের টাকায় ১৯৭৭ সালে প্রথম এ্যালবাম 'সংবিদ্ধ পাখিকূল ও কলকাতা বিষয়ক' বের করে দলটি। এরপর আর দুটি এ্যালবাম আর হাতে গোনা ক'টা শো করেই প্রথম দফায় থামে মহীনের ঘোড়াগুলি।

'৮১ তে দল ভেঙে যায়। আর দশটা-পাঁচটা মানুষের সাথে মিশে যায় দলের মানুষগুলো। কিন্তু তেজস্বীরা বোধহয় আপন তেজ লুকোতে পারেন না! দলভঙ্গ গৌতম এককভাবে মিউজিক আঁকড়ে ধরলেন। বিভিন্ন সিনেমায় সংগীত পরিচালনা করতে লাগলেন। একসময় চলচ্চিত্র-পরিচালনায় নেমে বানালেন 'নাগমতী'। ১৯৮৩ তে জাতীয় পুরস্কার পেল এই সিনেমা। 

নব্বই দশকের মাঝামাঝি এসে সময়ের প্রয়োজনে আবার দৌড় শুরু করে মহীনের ঘোড়াগুলি। '৯৫ থেকে '৯৮ এর ব্যবধানে চারটে এ্যালবাম বের হয়। কলকাতার নাগরিক জীবন যেন নেড়েচেড়ে বসল এবার! অনেক বছরের শুকিয়ে যাওয়া মাটি যেন পেল বৃষ্টির স্বাদ।

সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো। হঠাৎই ১৯৯৯-এ হার্ট অ্যাটাকে চলে গেলেন গৌতম। সময়ের আগে দৌড়ানো ঘোড়াটি শেষপর্যন্ত ময়দান ছাড়ল সময়ের আগেই। কিন্তু ততদিনে বাংলা ব্যান্ড সংগীতকে অন্তত তিন দশক এগিয়ে দিয়ে গেছেন এই তেজস্বী মানুষটি। 
মণিদা-কে দেবার মতো সামর্থ্য এখনো আমাদের হয়নি ।বছরের প্রথম বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে বারবার আমরাই হাত পাতছি তাঁর কাছে, হাত পেতেই যাচ্ছি...

-

* প্রিয় পাঠক, এই লেখাটি একজন কন্ট্রিবিউটর লিখেছেন। চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা