এই মুহূর্তে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামকে পেছনে ফেলে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পিন্টারেস্ট। কীভাবে সম্ভব হলো তা?

আমাদের বাংলাদেশীদের কাছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানেই হলো ফেসবুক, টুইটার কিংবা ইন্সটাগ্রাম। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কোনটি? নিশ্চয়ই ধন্দে পড়ে যাবেন অনেকে। কারণ উত্তরটি উল্লিখিত তিনটির কোনোটি নয়। বরং সেটি হলো পিন্টারেস্ট (Pinterest).

হ্যাঁ পাঠক, ১০০ মিলিয়নেরও বেশি নিয়মিত ব্যবহারকারী আর ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যমান নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের জগতে একটি খুবই বিশেষায়িত স্থান দখল করে নিয়েছে পিন্টারেস্ট। এটিকে মনে করা হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল অনলাইন স্টার্ট-আপ। অন্য আর সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেখানে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েছে, সেখানে পিন্টারেস্টই একদম সজীব কোনো ধারণা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে।

তবে ঠিক কী কারণে পিন্টারেস্ট অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চেয়ে একেবারেই আলাদা, এবং কীভাবে তারা এত বড় ভ্যালুয়েশনের একটি কোম্পানিতে পরিণত হলো- সেটি অনেকের কাছেই বিশাল বড় একটি রহস্য। এই রহস্যের সমাধান পেতে প্রায়সই গুগলের সাহায্য নেয় অনুসন্ধিৎসু মানুষ। তাই তো গুগলকে সবচেয়ে বেশিবার জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের তালিকায় বেশ উপরের দিকেই অবস্থান ‘how pinterest works’ এবং ‘how pinterest makes money’- এর।

যেমনটি আগেই উল্লেখ করেছি, বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে পিন্টারেস্ট একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই। এটির কাজ কী, তার প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যাবে এর নামকরণের মাধ্যমেই। pin আর interest, এই দুইয়ের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে পিন্টারেস্ট। অর্থাৎ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের যা কিছু interest বা আগ্রহের বিষয়, সেগুলোকে সংরক্ষণের জন্য pin করে রাখারই একটি ওয়েব ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন হলো পিন্টারেস্ট।

আগ্রহের বিষয় বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে কোনো ছবি বা ওয়েব কনটেন্টকে। আপনার ঘরের দেয়ালে যেমন আপনি আপনার পছন্দের কোনো ছবি, পোস্টার বা কোটেশন পিন করে রাখেন, পিন্টারেস্টেও আপনি ঠিক সেই কাজটিই করতে পারবেন, ডিজিটাল ফরম্যাটে। মূলত বিভিন্ন ওয়েব ব্রাউজারে যেসব বুকমার্ক অপশন থাকে, সেটিরই একটি ভিজ্যুয়াল ও উন্নততর ব্যবস্থা হলো পিন্টারেস্ট। নিজের ওয়ালে আপনার পিনকৃত সকল কনটেন্ট সংরক্ষিত থাকবে, এবং আপনি সেটিতে ক্লিক করা মাত্রই একই বা ভিন্ন কোনো ট্যাবে সেই কনটেন্টটি তার আদি ও অকৃত্রিম রূপে আপনার সামনে হাজির হবে।

পিন্টারেস্টের কোনো নির্দিষ্ট টার্গেট গ্রুপ নেই। এটি সব বয়সের, সব পেশার, সব লিঙ্গের মানুষের কাছেই সমান জনপ্রিয়। ফেসবুক, টুইটার বা ইনস্টাগ্রাম চালানোর জন্য আপনার যেমন নির্দিষ্ট বিষয়ে আগ্রহ থাকার দরকার আছে, পিন্টারেস্টে সেরকম ‘নির্দিষ্ট’ কোনো আগ্রহের প্রয়োজন নেই। স্রেফ একটি আগ্রহ থাকলেই হলো। সেই আগ্রহের বিষয়ের যেকোনো কিছুই আপনি পারবেন আপনার ওয়ালে পিন করে রাখতে।

এখন পর্যন্ত পিন্টারেস্টের মিলিয়ন মিলিয়ন ব্যবহারকারী, এতে পিন করে রেখেছে বিলিয়ন বিলিয়ন বৈচিত্র্যময় কনটেন্ট। বিভিন্ন ধরণের অনলাইন প্রোডাক্ট থেকে শুরু করে ইন্টেরিয়র ডিজাইন, আর্কিটেকচার, ফ্যাশন ডিজাইন, ট্যুর প্ল্যানিং, টিউটোরিয়াল, ফ্যান আর্ট, ফ্যান ফিকশন কিংবা প্রচলিত যেকোনো ছবি বা ওয়েব লিংক - সবই রয়েছে পিনটারেস্টে পিনকৃত কনটেন্টের তালিকায়।

পিন্টারেস্টের গ্রাহকতালিকা কোনো নির্দিষ্ট গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়

মূলত পিন্টারেস্টের এত দ্রুত উন্নতির আসল কারণ এটিই যে তাদের গ্রাহকতালিকা কোনো নির্দিষ্ট গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। এর বদলে তারা যদি কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণীকে আকৃষ্ট করাকেই প্রাধান্য দিত, সেক্ষেত্রে এটির ব্যবহার অন্তত এক-তৃতীয়াংশ কমে যেত। ফলে মড়ক লাগত তাদের আয়ের উৎসেও।

এই আয়ের উৎসই হলো আমাদের পরবর্তী আগ্রহের বিষয়। আসলে ২০১০ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকেই পিন্টারেস্ট একটি ওয়েব সোশ্যাল ক্যাটালগ বিজনেস মডেল অনুসরণ করে আসছে। শুরুতে এটি কোন ঘরানার ওয়েবসাইট তা নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলেও, সামাজিক যোগাযোগের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পিন্টারেস্টকে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি।

বর্তমানে পিন্টারেস্ট বিজনেস মডেলের অন্যান্য সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ফিচারের পাশাপাশি রয়েছে ই-কমার্স, ক্যাটালগিং এবং কনটেন্ট অ্যাসপেক্টসের সুবিধাও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে এর অন্যান্য প্রতিযোগীর (ফেসবুক, স্ন্যাপচ্যাট ইত্যাদি) মত পিন্টারেস্টও গড়ে তুলেছে একটি অ্যাডভার্টাইজিং রেভেন্যু মডেল, যার ফলে ব্যবহারকারীরা এই ওয়েবসাইটে আসলেই উপকৃত হয় পিন্টারেস্ট। এই কোম্পানিটির সামনে বিশাল সম্ভাবনার দ্বার খোলা থাকলেও, রেভেন্যু জেনারেশনের ক্ষেত্রে এটি এখনও সকল উৎসের কার্যকারিতাকে কাজে লাগাতে পারেনি। তবে ধারণা করা যায়, তারা খরগোশ আর কচ্ছপের গল্পকেই তাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে ধরে নিয়েছে।

পিন্টারেস্ট প্রধানত একটি ক্যাটালগ, যেখানে পিন সেভ ও শেয়ার করা যায়। রেজিস্টার্ড ব্যবহারকারীরা ওয়েবে পাওয়া যায় এমন যেকোনো পিন এখানে সেভ করে রাখতে পারে। এসব পিন সরাসরি আপলোড করা যেমন যায়, তেমনি ব্রাউজার এক্সটেনশনের মাধ্যমে সেভ করাও সম্ভব। পিনগুলোকে একই জায়গায় সংরক্ষণের জন্য রয়েছে পিনবোর্ডের সুবিধাও। ক্যাটাগরি অনুযায়ী খেলাধুলা বিষয়ক পিনগুলো এক জায়গায়, আবার ব্যবসা সম্পর্কিত পিনগুলো আরেক জায়গায়- এভাবেই ভিন্ন ভিন পিনবোর্ডে সংরক্ষিত থাকে পিনগুলো।

এছাড়া ক্রয়যোগ্য পিনের ব্যবস্থাও রয়েছে, ঠিক যেমনটি দেখা যায় ফেসবুক ও টুইটারে। পিন্টারেস্টের রয়েছে একটি ‘বাই ইট’ বাটন, যার মাধ্যমে কোনো মার্চেন্টের ওয়েবসাইটে প্রবেশ না করে, সরাসরি পিন্টারেস্ট থেকেই ব্যবহারকারীরা পছন্দের যেকোনো পণ্য অর্ডার দিতে পারেন। এবং এজন্য পিন্টারেস্ট মার্চেন্টদের কাছ থেকে কোনো এক্সট্রা চার্জও রাখে না।

আরও আছে প্রোমোটেড পিন, এবং এটিই এখন পর্যন্ত পিন্টারেস্টের আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। কোন ব্যবহারকারী কী ধরণের কনটেন্ট পিন করে রাখে, কিংবা তারা অন্যান্য কোন ধরণের ওয়েবসাইট বেশি ভিজিট করে, সার্চ ইঞ্জিনগুলোতে কী সার্চ দেয় বেশি, সেগুলোর ডেমোগ্রাফিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে পিন্টারেস্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট ব্যবহারকারীর ফিডে ওই একই ধরণের বিজ্ঞাপন বা পেইড কনটেন্ট পিন করে রাখে, যাতে ক্লিক করলেই আয় হয় পিন্টারেস্টের।

২০১৩ সাল পর্যন্ত নিজেদের ওয়েবসাইট ভিজিট ছাড়া পিন্টারেস্টের আলাদা কোনো আয়ের উৎস ছিল না। কিন্তু তারপরই তারা যুক্ত করে প্রোমোটেড পিন ফিচারটি। এবং এখন তারা এই ধরণের পেইড পিনের মাধ্যমেই প্রচুর অর্থ আয় করতে সক্ষম হচ্ছে। এর পাশাপাশি বাজার মূল্যায়নের মাধ্যমে পিন্টারেস্ট নিজেই যদি কখনও পুরোদস্তুর একটি ই-কমার্স সাইটে পরিণত হয়, তবে একসময় এটি হয়ত ছাড়িয়ে যাবে আলিবাবা বা অ্যামাজনকেও।

এর মাধ্যমে মানুষ ভাবের আদান-প্রদান করতে না পারলেও ঈর্ষনীয় জনপ্রিয় সাইট পিন্টারেস্ট

অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মত পিন্টারেস্ট ব্যবহার করে মানুষ ভাবের আদান-প্রদান করতে পারে না ঠিকই, তারপরও এর যে জনপ্রিয়তা, তা নিঃসন্দেহে ঈর্ষনীয়। মিলওয়ার্ড ব্রাউন ডিজিটালের করা একটি জরিপের ফলাফল বলছে, এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সর্বশেষ ছয় মাসে যারা পিন্টারেস্ট ব্যবহার করেছে, তাদের ৯৬% মানুষেরই প্রধান লক্ষ্য ছিল গবেষণা বা তথ্য সংগ্রহ। এছাড়াও ৯৩% মানুষ কোনো কিছু কেনার পরিকল্পনায়, আর ৮৭% মানুষ কী কিনবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যবহার করেছে পিন্টারেস্ট।

সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির হার অনুযায়ী, পিন্টারেস্ট আসলেই বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ওয়েবসাইট। ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেখানে বছরে ব্যবহারকারী বৃদ্ধির হার কখনও সিঙ্গেল ডিজিটও পার হতে পারে না, সেখানে পিন্টারেস্টে প্রতি বছর নতুন ব্যবহারকারী বাড়ছে ৫০% হারে।

পিন্টারেস্টের এমন অভাবনীয় সাফল্য দৃষ্টান্ত হতে পারে যেকোনো স্টার্ট-আপের জন্যই। ফেসবুক, টুইটারের মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাফল্য দেখে পরবর্তীতে একই ধরণের নতুন সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্র তৈরী হয়েছে প্রচুর, কিন্তু সেগুলো কখনও টেক্কা দিতে পারেনি ফেসবুক, টুইটারকে। কারণ একই ধারণা থেকে উদ্ভূত সৃষ্টি খুব বেশি হয়ে গেলে, সেগুলোর প্রতি মানুষের আগ্রহ খুব কমই জন্মায়। সেদিক থেকে পিন্টারেস্ট একদমই ভিন্নধর্মী। এটিও একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই বটে, কিন্তু কার্যকারিতার দিক থেকে এটি ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের চেয়ে একদমই আলাদা।

যেহেতু একদমই সজীব ধারণা থেকে এর পথচলা শুরু, তাই সহজেই এটি যেমন সর্বসাধারণের নজর কাড়তে পেরেছে, তেমনই এর পথের কাঁটা হয়েও আসেনি অন্য কেউ। তাই নতুন স্টার্ট-আপদের বোঝা উচিৎ, গৎ-বাঁধা ধারণা বাস্তববায়নের দিন এখন ফুরিয়েছে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে সম্পূর্ণ নতুন কোনো ধারণা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে, নইলে পূতিগন্ধময় অন্ধকারেই পচে মরতে হবে।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা