নেপালে তিনি সেদেশের রাষ্ট্রপতি বা সেনাপ্রধানের মতোই জনপ্রিয়, নেপালী তরুণ-তরুণীদের কাছে আইডল। ভারতীয়দের অভিযোগ, হু ইয়ানকি নামের এই ভদ্রমহিলার কারণেই নাকি দীর্ঘদিনের বন্ধু ভারতকে ছেড়ে চীনের সঙ্গে জোট গড়েছে নেপাল...

বেশিদিন আগের কথা নয়, এই তিন-চার মাস আগেও উপমহাদেশে ভারতের সবচেয়ে বড় বন্ধু রাষ্ট্র ছিল নেপাল। মাঝেমধ্যে যে মনমালিন্য হয়নি তা নয়, কিন্ত দিনশেষে দুই দেশের দহরম-মহরমে ভাটা পড়েনি খুব একটা। কিন্ত সম্প্রতি ভারত-নেপাল সীমান্তের কালাপানি নামের একটা জায়গায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্থাপনা নির্মাণকে কেন্দ্র করে দুই দেশের শত্রুতা চরমে উঠেছে। সীমান্তে নেপালী পুলিশের গুলিতে মারা গেছে এক ভারতীয় নাগরিক, ভারতের টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে নেপালে। এই অঞ্চলে আজীবন দাদাগিরি করে আসা ভারত স্বভাবতই চমকে গেছে নেপালের এমন চোখ রাঙানো দেখে। ভারত অভিযোগ এনেছে, তৃতীয় রাষ্ট্র হিসেবে ভারত আর নেপালের মাঝখানে নাক গলিয়ে দুই দেশের বন্ধুত্ব নষ্ট করছে চীন!

ভারতের অভিযোগটা পুরোপুরি মিথ্যে নয়। নেপালকে পেছন থেকে সাহস যোগাচ্ছে চীন, একারণেই ভারতের দিকে আঙুল তুলে কথা বলার সাহস পেয়েছে নেপাল। নইলে সামরিক বা রাজনৈতিক শক্তিতে ভারতের চেয়ে হাজার হাজারগুণে পিছিয়ে তারা, সেই নেপালের তো সাহস হবার কথা নয় ভারতকে চোখ রাঙানোর। তার ওপরে অল্প কিছুদিন আগেও ভারত ছিল তাদের পরম বন্ধু। ভারত আর নেপালের মাঝখানের এই শক্ত সেতুবন্ধনটা কেটে দেয়ার কাজ খুব পারদর্শীতার সঙ্গে করেছেন এক চীনা নাগরিক, তার নাম হু ইয়ানকি। নেপালে চীনের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি।

কখনও শুনেছেন, একটা দেশে ভীনদেশী কোন রাষ্ট্রদূতের জনপ্রিয়তা সেদেশের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির মতো? নেপালে কিন্ত এই ঘটনাটাই ঘটেছে। নেপালের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিদেশী নাগরিক এখন হু। তার ব্যক্তিত্ব, কথাবার্তা, তার ফ্যাশন সেন্স- সবকিছুরই ভক্ত নেপালের মানুষ। নেপালী তরুণ-তরুণীদের কাছে হু ইয়ানকি হচ্ছেন নতুন এক সেনসেশনের নাম। নিজের এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে হু-ও চীন-নেপাল সম্পর্ককে অন্যরকম একটা উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন ক্রমশ। 

প্রায় চব্বিশ বছর ধরে কূটনীতিক হিসেবে কাজ করছেন হু ইয়ানকি, নেপালে আসার আগে নিজেদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দক্ষিণ এশিয়া বিভাগে উঁচু পদে ছিলেন তিনি। চীনের দূত হিসেবে পাকিস্তানেও কাজ করেছেন কিছুদিন। কূটনীতিক জীবনের শুরু থেকেই হু-কে অ্যান্টি ইন্ডিয়ান জোনে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে, কাজেই ভারতের শত্রু রাষ্ট্রগুলো ভারতকে নিয়ে কি ভাবে, সেটা তিনি ভালো বোঝেন। আর সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগয়েই ভারতকে বিপদে ফেলছেন তিনি।

 হু ইয়ানকি, নেপালে চীনের রাষ্ট্রদূত

হু ভালোভাবে আলোচনায় এসেছেন মূলত নেপালে দায়িত্ব পালন করতে এসে। গত কয়েক মাসে নেপালের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক অন্যরকম একটা উচ্চতায় পৌঁছেছে, যেটা বছর পাঁচেক আগেও কেউ ভাবতে পারতো না। ভারতের এত ঘনিষ্ঠ মিত্র নেপাল কখনও চীনা বলয়ে যুক্ত হতে পারে, সেটা ভারতেরও সুদূরতম কল্পনায় ছিল না। কিন্ত এটাই এখন বাস্তব সত্য। আর এই অভাবনীয় ঘটনার পেছনে চালিকা শক্তি বলা হচ্ছে হু ইয়াংকিকে। অন্তত ভারতীয় মিডিয়ার দাবী এমনটাই। নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নষ্ট হবার পেছনে মোদি সরকারের ব্যর্থ পররাষ্ট্রনীতি যতটা দায়ী, ঠিক ততটাই ক্রেডিট দেয়া হচ্ছে হু ইয়াংকিকেও। 

নেপালের প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ থেকে শুরু করে সেনাপ্রধানের দেয়া নৈশভোজ- সবখানেই দেখা মিলছে হু ইয়ানকির। নেপাল সরকার তাকে যেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে, এতটা সম্মান বা মর্যাদা নেপালের ইতিহাসে কোন রাষ্ট্রদূতই পাননি, আমেরিকান বা ভারতীয় রাষ্ট্রদূতরাও না। আর এসব নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম মেতে আছে নানা রকমের বিশ্লেষণ ও অনুমানে। চীন-ভারত বা নেপাল-ভারত উত্তেজনা নিয়ে লেখা সেখানকার অধিকাংশ প্রতিবেদনেই হু ইয়াংকির উপস্থিতি থাকছে অবশ্যম্ভাবী হিসেবে।

অবশ্য হু এবং তার দেশ চীন যেভাবে নেপালকে সাহায্য করছে, তাতে গোটা ব্যাপারটাকে অবাস্তব বলার উপায়ও নেই। নেপাল যাতে কোনভাবেই ভারতীয় ডেরায় আর ফিরতে না পারে, সেজন্য যা যা করা দরকার সবই করছে চীন। এই অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে গেলে ভারতের বন্ধুদের হাত করতে হবে, সেটা চীন জানে। পাকিস্তান, মিয়ানমার বা আফগানিস্তান তো আগে থেকেই চীনের মিত্র, বাকী ছিল বাংলাদেশ এবং নেপাল। এই দুই দেশকেও হাত করার মিশনে নেমেছে চীন, আর সেকারণেই দু'হাত খুলে সাহায্যের মিশনে নেমেছে তারা। আর গোটা ব্যাপারটাতে সর্বক্ষণ বেইজিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে নেপালের নানা সমস্যা আর চাহিদার কথা চীন সরকারকে জানিয়ে চলেছেন হু ইয়াংকি, ঠিক করছেন কর্মপন্থা। 

নেপালে করোনাভাইরাস হানা দেয়ার পরপরই হু ইয়াংকি চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিন পিংয়ের সঙ্গে নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারির সরাসরি টেলিফোন আলাপের ব্যবস্থা করেছেন। এতেই বোঝা যাচ্ছে, চীন তাদের এই রাষ্ট্রদূতকে কতখানি ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে! সেই ফোনালাপে চীনের প্রেসিডেন্ট নেপালকে প্রচুর সুরক্ষাসামগ্রী দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। ধাপে ধাপে সেসব নেপালে আসছে এখন। 

নেপালের ট্যুরিজমের প্রচারণা চালাতেও দেখা যায় হু ইয়ানকিকে

নেপালের ইতিহাসে এর আগে কোন রাষ্ট্রদূত নেপালের রাজনীতিতে এমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেননি, যেটা হু পারছেন। নেপাল-চীন দুই দেশের সম্পর্কে হু'র এসব তৎপরতা বেশ নজর কেড়েছে কাঠমান্ডুর কূটনীতিক অঙ্গনে। দেশটিতে চীনের যেসব বড় নির্মাণ প্রকল্প রয়েছে, সেগুলো দ্রুত শেষ করতে হু ইয়াংকি নিয়মিত প্রকল্প এলাকায় গিয়ে কাজ তদারক করছেন। একজন রাষ্ট্রদূতের জন্য কাজটা বেমানান বটে, কিন্ত হু তো শুধু রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বই পালন করছেন না, তার কাজের পরিধি যে আরও অনেক বিস্তৃত্ব! 

নেপালের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে সেদেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে যতগুলো খবর ছাপা হয়, প্রায় সমান সংখ্যক খবর প্রকাশিত হয় হু-কে নিয়েও। নেপালের তরুণ-তরুণীদের কাছেও তিনি খুব জনপ্রিয়। নেপালের জন্য তার কাজকর্ম স্থানীয়দের মন কেড়েছে। লাখ লাখ নেপালি এখন হু-কে ‘ফলো’ করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এর বাইরে নেপালের বিভিন্ন জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পটে গিয়ে তিনি ছবি আপলোড দিয়ে চেকইন দিচ্ছেন, চীনের জনগনকে আহবান জানাচ্ছেন নেপাল ভ্রমণে আসার জন্য (করোনা লকডাউন শুরুর আগের ঘটনা এটা), তার এসব কর্মকাণ্ডও দৃষ্টি কেড়েছে নেপালের মানুষের। আর তাই তারা ভীনদেশী এই নাগরিককে ভালোবেসে ফেলেছে। 

তবে নেপালে হু যতোই জনপ্রিয় হন, ভারতীয়রা তাকে দুই চোখে দেখতে পারে না। পারবে কি করে, ভারতের দাদাগিরিতে চীন ভাগ বসাচ্ছে হু'র কর্মতৎপরতায়, বন্ধুরাষ্ট্র নেপালকে নিজেদের কবজায় নিয়ে গেছে চীন, পুঁচকে নেপাল এখন ভারতের সঙ্গে চোখ রাঙিয়ে কথা বলে, ভারতকে হুমকি দেয়- ভারত না পারছে সইতে, না পারছে কিছু করতে! আর গোটা ব্যাপারটার জন্য চীন এবং হু ইয়ানকির আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতিকেই দায়ী করে ভারতীয় নাগরিকরা। 

কাজেই হু ইয়ানকিকে নিয়ে প্রকাশিত যে কোন খবরের নিচে তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে কিছু ভারতীয় নাগরিক। তাতে অবশ্য হু'র কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হচ্ছে না, বেইজিং থেকে তাকে যেসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, সেগুলো পালন করে ভারতকে আঞ্চলিক রাজনীতিতে কোণঠাসা করার কাজটা তিনি করে চলেছেন সুনিপুণভাবে, আর দেখিয়ে দিচ্ছেন, একটা দেশের জন্য একজন রাষ্ট্রদূত কত বড় সম্পদ হয়ে উঠতে পারেন! 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা