মাত্র ১৫০ স্কয়ারফিটেই একটা গোটা সংসার! খাট, রান্নাঘর, বাথরুম, সব একসাথে! হংকংয়ের সুউচ্চ অট্টালিকার ভিড়ে এ এক অন্ধকার জগত, যা দেখে আপনার আজন্ম বিশ্বাস ধাক্কা খাবে!

বাড়িগুলো দেখে আপনার মনে পড়বে কবুতর কিংবা এ জাতীয় প্রাণী রাখার খাঁচার কথা। অথচ, এই পাখির খাঁচার মতো ঘরগুলোতে অবলীলায় থাকছে হাজার হাজার মানুষ। যে খাঁচায় আকাশ দেখা তো দূরে থাক, নিজের নিঃশ্বাস টিকিয়ে বেঁচে থাকাই তো কঠিন। তবুও থাকতে হচ্ছে, থাকতে হয়, এটাই এখানকার জীবন।

জীবনটা হংকংয়ের। সেই হংকং যার সুউচ্চ অট্টালিকার চাকচিক্যে আপনি আমি মাঝে মধ্যেই ভাবি, আহা কি সুখে আছে ওরা। এটা সেই হংকংয়েরই আরেকটি অন্ধকার জগত, যাকে আপনি ঠিক হজম করতে পারবেন না, আপনার আজন্ম বিশ্বাস ধাক্কা খাবে, কি করে এত উন্নত একটা শহরেও এমন অমানবিকভাবে মানুষ থাকছে ভেবেই আপনি হয়ত শিউরে উঠবেন।

হুমায়ুন আহমেদের 'আজ রবিবার' নাটকটি দেখেছেন না? সেখানে একটি অদ্ভুত চরিত্র ছিলেন, বড় চাচা, যিনি মানসিক রোগীর চিকিৎসক বলে নিজেকে দাবি করতেন, যদিও আশেপাশের মানুষের ধারণা তার নিজেরই কিঞ্চিত মানসিক সমস্যা আছে। এই বড়চাচার মানসিক থেরাপির বিচিত্র কায়দার একটি হলো কফিন বিলাস। আজ রবিবারের বড় চাচা কফিনে শুয়ে থাকতেন বিক্ষিপ্ত মনকে কেন্দ্রীভূত করে মানসিক প্রশান্তি পাওয়ার জন্য, কিন্তু আধুনিক হংকং এর 'আদিম' মানুষরা 'কফিন' এ বসবাস করছেন একদম নিরুপায় হয়ে।

কেন? হংকং আধুনিক হচ্ছে, পাল্লা দিয়ে নগরায়ন হয়েছে। এখন অবস্থা এতোই আঁটসাঁট যে নতুন করে বাড়ি বানানোর জায়গাই মিলছে না। বসতবাড়ির ভয়ানক অভাব। কিন্তু, মানুষ তো কমছে না। এত মানুষের আবাসন ব্যবস্থা কী করে হবে? এমনিতেই জীবনযাত্রা ব্যয়বহুল হংকংয়ে। বাড়ি ভাড়া করা সহজ কথা নয়। ক্রমবর্ধমান জনগণকে একটু মাথা গোঁজার ঠাই দিতে হংকংয়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ থাকার জায়গা, তাকে আসলে জায়গা না বলেই খাঁচা বলাই ভাল। মাত্র ১৫০ স্কয়ারফিটের রুমই এসব অবৈধ ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় রুম। হ্যাঁ, মাত্র ১৫০ স্কয়ারফিট, ঢাকা-বরিশাল লাইনের লঞ্চের কেবিনের মতো, এই ১৫০ স্কয়ারফিটেই একটা গোটা সংসার, খাট, রান্নাঘর, বাথরুম, সব একসাথে! ভাবা যায়!

গোটা একটা সংসার এক রুমে

বলছিলাম ১৫০ স্কয়ারফিট এ জাতীয় রুমের মধ্যে সবচেয়ে বড়, আপনি হয়ত ভাবছেন এর চেয়েও ছোট রুমও আছে নাকি? আছে, এর চেয়েও অনেক ছোট, একেবারে কফিন সাইজের রুমও আছে হংকংয়ে। ১৫ স্কয়ারফিটের এই থাকার ব্যবস্থাকে হংকংয়ে বলা হয় 'কফিন কিউবিকল'। বিভিন্ন সাইজের এই রুমগুলোতে হংকংয়ের প্রায় দুই লাখ মানুষ বসবাস করেন, উজ্জ্বল হংকংয়ের অন্ধকারময় জগতের প্রতিনিধি যারা। ছয় ফুট বাই দুই ফুট খাঁচার মধ্যে জীবন আটকে আছে তাদের। এখানে বেশিরভাগ ঘরেই নেই রান্নার ব্যবস্থা, বাথরুম ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে হয়। কোনো কোনো ঘর এতই ছোট যে পা ছড়িয়ে ঘুমানোটাও ভাগ্যে নেই তাদের, কোনোরকমে পা ভাঁজ করে রাত কাভার করে সকালে আবার বেরিয়ে যান ভাগ্যবিড়ম্বনার ফল ভোগ করতে, মানে কর্মস্থলে। 

চিরাচরিত হংকং এর বহুতল ভবনে থাকেন উঁচুদরের মানুষেরা, যেখানে জীবন প্রয়োজন মিটিয়েও নানান অপ্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা নিয়ে বসে থাকে। তবে হংকং এর এই অংশটি যেখানে খাঁচার জীবন মেনে মানুষগুলো থাকেন তারা নিতান্তই জীবন সংগ্রামী লড়ে যাওয়া শ্রমজীবি মানুষ। একেকজন একেকজায়গায় কাজ করেন, রাতটা এসে পার করেন খাঁচার ঘরে। একেকটি দীর্ঘরাত, তবুও মানিয়ে নিচ্ছেন।

পা কোনোমতে ভাজ করে রাতটুক পার করেন অনেকে

এর মধ্যে মাঝে মাঝে আবার পুলিশি অভিযানের ভয় তো আছেই, কারণ এই আবাসন ব্যবস্থাগুলো যে বৈধ নয়। হংকং এর মতো একটি দেশেও দুই লাখ মানুষকে এভাবে বসবাসের প্রায় অনুপযোগী একটা জায়গায় মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। বিশ্বাস করেন তারা যে জায়গায় থাকে তার থেকে আপনার বাড়ির টয়লেটও বড়। এই বাড়িগুলোর অবস্থা দেখে মনে হয় জীবন্ত লাশের কফিন যেন একেকটা বাড়ি। বাথরুম সাইজের একটা রুমের ভাড়াও কম না, বাংলাদেশি টাকায় ১৮-২০ হাজারের কম হবে না নিশ্চিত। এত ভাড়া দিয়েও থাকতে হচ্ছে কারণ, তা নাহলে মাথা গোঁজার শেষ জায়গাটুকুও যে হারাতে হবে। 

আমাদের এই ঢাকায়ও তীব্র থাকার জায়গা সংকট, গ্রাম থেকে আত্নীয় আসলে তাকে থাকবার জায়গা দেয়ার মতো জায়গা নিয়ে বিপাকে পড়তে হয় মধ্যবিত্ত পরিবারকে। এছাড়া শহরে কত জায়গায় বস্তিতে কষ্টকর জীবনে অভ্যস্ত মানুষ। তবুও তো থাকা যাচ্ছে। অথচ, হংকং এর মতো একটা দেশও থাকবার জায়গা দিতে হিমশিম খাচ্ছে, অবস্থা কতটা খারাপ হলে কফিন কিউবিকলে থাকতে হয়, খাঁচায় থাকতে হয়! এই অবস্থায় গানের একটা লাইন বার বার কানে বাজছে, নিজ ভুবনে চিরদুখী, আসলে কেউ সুখী নয়!

তথ্যসূত্র- বিজনেস ইনসাইডার,  দ্য উইক

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা