"আমি জানি এই বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আমার পরিবার কি সংগ্রামটা করেছে। আমার মায়ের পরিবার আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি, কারণ আমার বাবা দেখতে কালো ছিলেন..."

খেলোয়াড়ি জীবনে তিনি ছিলেন ত্রাসের আরেক নাম, বোলিং রানআপ ধরে তার ছুটে আসাটাই বুকে কাঁপন ধরাতো প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানের। মাইকেল হোল্ডিং, যিনি ছিলেন ক্যারিবীয় ক্রিকেটের স্বর্ণযুগের সারথি, ক্যারিবীয় পেস চতুষ্টয়ের দুর্ধর্ষ এক প্রতিনিধি, সেই মানুষটাকে একদিন আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ের পর বর্ণবাদ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হতে দেখলাম, তিনি চোখের জল ঝরালেন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তার পরিবারের সংগ্রাম আর নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে। 

করোনাভাইরাস পরবর্তী যুগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মাঠে ফিরেছে সাউদাম্পটন টেস্ট দিয়ে। সেই ম্যাচে স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে চার উইকেটে হারিয়ে সিরিজে লিড নিয়েছে জেসন হোল্ডারের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ধুন্ধুমার ক্রিকেটীয় লড়াইটার সাক্ষী ছিলেন হোল্ডিং, কমেন্ট্রিবক্সে বসে তিনি দেখেছেন দুই দলের দ্বৈরথ। ম্যাচ শেষে স্কাই নিউজের স্টুডিওতে বসে ধারাভাষ্যকার মার্ক অস্টিন মাঠে থাকা হোল্ডারের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, এই জয়টা তো তোমার কাছে ভীষণ স্পেশাল, তাই না? 

সেই স্পেশাল ভিক্টোরির কথা বলতে গিয়েই কেঁদে ফেলেছেন হোল্ডিং। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করার জন্য এই টেস্ট শুরু হবার আগে দুই দলের ক্রিকেটারেরাই হাঁটু গেঁড়ে নীরবতা পালন করেছেন, আমেরিকায় পুলিশের অত্যাচারে নিহত জর্জ ফ্লয়েডের আত্মার শান্তি কামনা করেছেন। দুই দলের বাইশ ক্রিকেটার মাঠে নেমেছেন কালো ব্যান্ড পরে। করোনা পরবর্তী যুগের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচটা যেন রূপ নিয়েছিল বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হিসেবেই।

মাইকেল হোল্ডিং, সাবেক ক্যারিবীয় পেসার

সেই ম্যাচে নিজের দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতেছে, হোল্ডিংয়ের খুশিটা ছিল অন্য রকমের। সেই খুশির সঙ্গে মিশে ছিল চাপা বেদনা, আর অপমানের গ্লানিও। সেসব স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়েছেন হোল্ডিং। বিখ্যাত এই ক্রিকেটারের বাবা-মা দুজন ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন একে অন্যকে। হোল্ডিংয়ের বাবার গায়ের রঙ একটু বেশিই কালো ছিল। এ কারণে তার মায়ের পরিবারের সদস্যরা তাদের মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিল। নানা-নানী বা মামা-খালাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিল না হোল্ডিংয়ের। শুধুমাত্র গায়ের রঙ কালো হবার অপরাধে যে কেউ কারো সাথে আত্মীয়তা নষ্ট করতে পারে, সেটা তার কল্পনাতেও ছিল না। 

এসব কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে এসেছিল হোল্ডিংয়ের, একটা পর্যায়ে কথাই বলতে পারছিলেন না, স্টুডিওতে বসা মার্ক অস্টিনও ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি শুধু হোল্ডিংকে বলছিলেন একটু সময় নেয়ার জন্য। হোল্ডিং নিজে ইমোশনাল হলেন, সেই সঙ্গে আবেগাক্রান্ত করলেন টিভি পর্দার সামনে বসে থাকা দর্শকদেরও। 

এর আগেও বর্ণবাদ নিয়ে কথা বলেছেন হোল্ডিং, সাউদাম্পটন টেস্টেই বৃষ্টির কারণে খেলা যখন বন্ধ, তখন নাসের হুসেনের সঙ্গে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে উঠে এসেছিল বর্ণবাদ প্রসঙ্গ। বাল্যশিক্ষা থেকে শুরু করে নিজের অভিজ্ঞতা- সবকিছুতেই কিভাবে বর্ণবাদের ছায়া দেখেছেন, সেসব সবিস্তারে বলেছেন হোল্ডিং। স্কুলের বইতে তাদের শুধু সাদা বীরদের কাহিনী পড়ানো হয়েছে, যেন জগতে সব ভালো জিনিস সাদারাই ঘটিয়েছে, কালোদের কোন অবদানই নেই কোথাও!

বর্ণবাদ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়েছেন হোল্ডিং

ক্রিকেট খেলতে, বা ধারাভাষ্য দিতে বিশ্বের অজস্র দেশে গেছেন, অনেকবারই হোল্ডিংকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে শুধুমাত্র গায়ের রঙের কারণে। অস্ট্রেলিয়ায় তার সঙ্গে লিফটে উঠতে চায়নি এক শ্বেতাঙ্গ, লিফটের দরজা বন্ধ হবার আগে 'ব্লাডি নিগা' বলে গালি দিয়েছিল সে হোল্ডিংকে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ দেখতে স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলেন, হোটেলে চেকইনের সময় রিসিপশন থেকে তাকে বলা হয়েছে, তিনি যেন অন্য হোটেলে যান। তবে তার সঙ্গী এখানে থাকতে পারবেন। হোল্ডিংয়ের স্ত্রী লওরি শ্বেতাঙ্গ, তাকে হোটেল কর্তৃপক্ষ রাখতে পারবেন, কিন্ত হোল্ডিংকে নয়! এসব অভিজ্ঞতার কথা মাইক্রোফোনের সামনে বলেছেন হোল্ডিং।

হোল্ডিং এটাও বলেছেন, অনেকের কাছে ব্যাপারগুলো মজার মনে হতে পারে। কিন্ত যখন আপনার সঙ্গে এগুলো ঘটবে, তখন মেনে নেয়া কষ্টকর। নিজেকে খুব ছোট আর তুচ্ছ মনে হয় তখন। এগুলো এভাবে চলতে পারে না, এই রেসিজম, ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ- এগুলো চিরতরে বন্ধ হওয়া দরকার। আমরাও হোল্ডিংয়ের সাথে একমত। তার চোখে চিকচিক করা অশ্রুবিন্দু মুক্তোর মতো সুন্দর হতে পারে, কিন্ত যে বর্ণবাদ সেই অশ্রুজলের কারণ, সেটা ঠিক ততটাই কুৎসিত, আর কদর্য। 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা