পড়ুন, দেখুন, জানুন এবং বুঝুন ইসলামের গৌরবময় ইতিহাস!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
সবাই আশা করি জানেন, তারপরও কিছু মানুষ ত্যানা প্যাচান বলেই বলছি, এতক্ষন যে কথাগুলো লিখলাম, একটিও আমার মনগড়া কথা নয়। ইসলামে কারোর খেয়াল খুশিমতন কথা বলার অনুমতি নেই। এই কথা আপনি যেমন জানেন, আপনার চেয়ে বেশি ভাল করে আমি জানি। এই লেখার সব পয়েন্টই ইয়াসির ক্বাদীর সাথে ভ্যারিফাই করা। তিনি একজন বিশ্বখ্যাত স্কলার, নর্থ আমেরিকান ফিকহ কাউন্সিলের সদস্য, এবং আমার এলাকার মসজিদের ঈমাম।
২০১২ সালে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা, আমাদের প্রথম আমিরুল মুমিনীন হজরত ওমর ইবনে আল খাত্তাবের (রাঃ) জীবনী নিয়ে MBC নেটওয়ার্ক ৩০ পর্বের সিরিয়াল নির্মাণ করেছে। এখন আমার লেখার সাথে যারা যারা পরিচিত, তাঁরা নিশ্চই জানেন যে আমি হজরত উমারকে (রাঃ) কতটা ভালবাসি। শুধু সাহাবীই নন, চার খলিফার মধ্যেও আমার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিত্ব তিনি। জানি সম্মানের দিক দিয়ে আবু বকর (রাঃ) সবার উপরে, তারপরেও উমারের (রাঃ) মধ্যে কিছু একটা আছে যা আমাকে তাঁর দিকে বেশি আকর্ষণ করে। তাঁকে নিয়ে নির্মিত সিরিজ, আমি দেখবো না? সেটা সম্ভব?
সিরিজটি নির্মাণে MBC বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি। বৃষ্টির মতন টাকা খরচ করেছে। সেট নির্মাণ থেকে শুরু করে ডিরেকশন, অভিনয়, স্ক্রিপ্ট ইত্যাদি দেখলেই বুঝবেন আজ পর্যন্ত ইসলামিক কোন সিরিজ বা সিনেমায় এই কোয়ালিটির প্রোডাক্ট কেউ নির্মাণ করতে পারেনি। প্রতিটা ঘটনা অথেন্টিক সোর্স থেকে নেয়া। প্রতিটা দৃশ্যে যত্নের ছাপ স্পষ্ট। প্রতিটা ফ্রেমে প্রফেশনালিজম ও ক্রিয়েটিভিটি ঝকঝক করছে। বিশ্বখ্যাত ইরানি নির্মাতা মাজিজ মাজিদির মুহাম্মদ (সঃ) সিনেমাটিও খুব আগ্রহের সাথেই দেখেছিলাম। নির্মাণশৈলী দেখে আফসোস জেগেছিল এই ভাবে যে এই লোকটির হাতে যদি অথেন্টিক স্ক্রিপ্ট পড়তো, তাহলে কী বিস্ময়কর সিনেমাই না তিনি তৈরী করতে পারতেন! MBC এই ভুলটি করেনি।
অভিনয়, সেট ও নির্মাণ কৌশল এতটাই নিখুঁত যে আমি যেন ফিরে গেলাম সেই সাড়ে চৌদ্দশো বছর আগের প্রবীণ, রুক্ষ, প্রাণহীন শুষ্ক ভূখন্ড মক্কায়। জাহেলিয়াতের চাদরে মোড়ানো অন্ধকার এক পুণ্যভূমি। চোখের সামনে দেখলাম প্রাচীন কাবা ঘর, যার পাশেই আমার প্রিয় নবীর (সঃ) জন্মস্থান। একে একে চোখের সামনে চিত্রিত হলেন আবু বকর(রাঃ), উমার (রাঃ), উসমান(রাঃ), ছোট্ট আলী(রাঃ), হামজা(রাঃ), খালিদ বিন ওয়ালিদ(রাঃ), বিলাল(রাঃ) প্রমুখ সাহাবী! ওহী নাজেলের অন্ধকার কিন্তু মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় ও উজ্জ্বলতম রাত্রি, নীরব দাওয়াত দেয়ার সময়কাল হয়ে ধীরে ধীরে প্রকাশ্য হয়ে উঠতে থাকে আবু লাহাব, আবু জাহেলদের বিরোধিতা। সুমাইয়া, ইয়াসিরের শহীদ হওয়া, বিলালের কাতর কিন্তু দৃঢ় স্বরে পাঠ, "আহাদুন আহাদ!"
নবীর (সঃ) জীবনী যারা পাঠ করেছেন, তাঁরাই সিরিজটি দেখলে বুঝবেন কতটা ডিটেইলে কাজ করা হয়েছে সিরিজে। আবু সুফিয়ানের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করেছেন, তাঁর অভিনয়ে মুগ্ধ হবেন। আমার কাছে সবচেয়ে বেশি যা ভাল লেগেছে তা হচ্ছে কুরআনের আয়াতগুলো। কোন তিলাওয়াত নয়, কোন তাজউইদ নয়, নাটকের সংলাপের মতন পাঠ করা হয়েছে। সেই কনটেক্সটে ফেলে, যে কনটেক্সটে আয়াতগুলো নাজেল হয়েছিল। জীবনে এই প্রথম কুরআনের আয়াত পাঠ শুনে শরীরের সব রোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। মোটেও বাড়িয়ে বলছি না, বাস্তবেই আমার হৃদপিন্ড এমনভাবে কখনই কাঁপেনি। রন্ধ্রে রন্ধ্রে আমি অনুভব করেছি এর প্রতিটা শব্দ। এর আগে কখনই সেভাবে অনুভব করা হয়নি। মনে আছে কিছুদিন আগেই আবরারকে যখন হত্যা করা হলো, ও তার খুনিদের মুখে হাসি ছিল, অতঃপর লোকে কুরআনের একটি আয়াত শেয়ার করতে শুরু করে যেখানে আল্লাহ বলেছেন, "অতএব, তারা সামান্য হেসে নিক এবং তারা তাদের কৃতকর্মের বদলাতে অনেক বেশী কাঁদবে।" (তাওবাহ, ৮২), আমার নিজেরই ভয়ে কলিজা শুকিয়ে গিয়েছিল। এখানেও ব্যাপারটা তাই।
জীবনে সেই প্রথম বুঝতে পারলাম কেন ও কিভাবে শতাব্দী প্রাচীন কুরাইশদের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিল আরবি কিছু শব্দ ও বাক্য। কোন অস্ত্রের ঝনঝনানি নয়, কেবলই কিছু বাক্য! অথচ তা যেকোন অস্ত্রের চেয়ে বহুগুন শক্তিশালী, অতিলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। উমারের (রাঃ) মতন মহাবীর ও কট্টর কুরাইশী কেন সামান্য কয়েক লাইন পড়েই নিজের প্রভুর কাছে মাথানত করে ফেলেছিল সেটা বুঝতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হলো না। এর আগে কোন লেখক এত সুস্পষ্টভাবে আমাকে অন্তত বুঝাতে পারেননি।
কিছু দৃশ্যে চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি ঝরেছে। কোন বই পড়ে এর আগে কখনই এমনটা হয়নি। আমার নবীর কষ্ট আমি যে চোখের সামনে দেখতে পারছি! আমার নবীর মৃত্যু দৃশ্যে মদিনাবাসীর পাশাপাশি আমার কণ্ঠ থেকেও হাহাকার বেরিয়েছে। দুরুদ পাঠ করে বলেছি, "ইয়া রাসূলাল্লাহ (সঃ)! আমার আল্লাহ সাক্ষী, আমরা আপনাকে পৃথিবীর সবকিছু থেকে বেশি ভালবাসি! আপনাকে যে কাজে আমাদের রব নিয়োগ দিয়েছেন, আপনি সেকাজে ব্যর্থ হননি।"
বলতে দ্বিধা নেই, এই সিরিজ আমার ঈমান তাজা করেছে। এই সিরিজই প্রেরণা যুগিয়েছে নবীজির (সঃ) জীবনী লেখার ব্যাপারে। এই হচ্ছে আমার অনুভূতি। আমার কিছু বন্ধু বান্ধব, যারা সিরিজটি দেখেছেন, তাঁদেরও একই অনুভূতি। এখন কিছু প্রাসঙ্গিক কথা বলবো। মন দিয়ে শুনুন।
যেদিন থেকে এই সিরিজ প্রচার শুরু হয়েছে, সেই দিন থেকেই গোটা বিশ্ব জুড়েই ইসলামিক স্কলাররা এই সিরিজের বিরোধিতা করেছেন। চারপাশ থেকে বৃষ্টির মতন ফতোয়া ঝরেছে এই সিরিজ দেখা হারাম! টেলিভিশনের মতন "শয়তানি" মাধ্যমে উমারের (রাঃ) মতন ব্যক্তিত্বের জীবনী উপস্থাপন করে ইসলামকে অবমাননা করা হয়েছে। আরও অনেক কিছুই ছিল সেসব যুক্তির পক্ষে। আমাদের সুন্নি মুসলিম উম্মাহ বহুদিন পর কোন ইস্যুতে একতা প্রকাশ করলো। চোখে পানি আসার মতন উপলক্ষ্য।
সমস্যা ফতোয়ায় নয়। যেসব স্কলাররা ফতোয়া দিয়েছেন, ভ্যালিড রেফারেন্সের ভিত্তিতেই তাঁরা দিয়েছেন। কিন্তু মূল সমস্যা ছিল এই যে এই সিরিজটিই আরব ইতিহাসের সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় সিরিজের মর্যাদা পেয়েছে। খুব কম আরব আছেন, যারা এই সিরিজ দেখেন নি। বিশ্বজুড়ে আরও কোটি কোটি অনারব মুসলিম এই সিরিজ ডাউনলোড করে, অথবা ইউটিউব বা ডেইলি মোশন বা এইরকমই কোন না কোন ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখেছেন।
তার মানে হচ্ছে, একদিকে আমাদের স্কলাররা যেখানে কোন বিষয়কে হারাম বলছেন, উল্টোদিকে মেজরিটি অফ দ্য পপুলেশন সেই ফতোয়াকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সেই কাজটিই করছে। ইতিহাসে মুসলিমরা কখনও কি এমন আচরণ করেছিল? যখন মদ হালাল ছিল, এবং একদিন হঠাৎ করেই নবী (সঃ) ঘোষণা করলেন মদ হারাম, মদিনার রাস্তা শরাবের নহরে ভেসে গিয়েছিল। লোকের বাড়িতে বাড়িতে যা মদ সঞ্চিত ছিল, সবাই সেটা এনে ফেলে দিয়েছেন। এক ব্যক্তি উপস্থিত হলেন নবীর কাছে। বললেন "আমার দায়িত্বে দুইজন এতিম আছেন, যাদের বাবা তাঁদের সব সম্পত্তি মদের পেছনে বিনিয়োগ করেছেন। এখন যদি মদ হারাম হয়ে যায়, তাহলে সব সম্পদ ফেলে দিতে হবে। আমি কী মদগুলো বিক্রি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবো?"
সিচ্যুয়েশনটা অত্যন্ত জটিল। ইসলামে কঠিনভাবে এতিমের সম্পত্তি রক্ষার বিধান চালু আছে। যদি কখনও মদের ব্যাপারে শিথিলতা আনতে হতো, তবে এটিই হবে সেই ঘটনা। কিন্তু নবীর (সঃ) কোন ক্ষমতা নেই আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে যাবার। তিনি সেটাই জানিয়ে দিলেন। এই ছিল মুসলিমদের আনুগত্য। আর আজকে আমাদের আলেম উলামারা ফতোয়া জারি করছেন ঠিকই - সেটা পাত্তা দিচ্ছে না কেউই। এই ঘটনাই প্রমান করে আমরা আমাদের স্কলারদের থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি।
কেন হয়েছি জানেন? কারন স্কলাররা বাস্তবতা অনুধাবন করতে চাইছেন না। বাস্তবতা হচ্ছে, আজকে বিশ্বজুড়ে প্রতিটা মুসলমানের বাড়িতে টেলিভিশন আছে। মোবাইল আছে, ইন্টারনেট আছে। চ্যানেল খুললেই টিভিতে ভেসে উঠছে বলিউডের সিনেমা বা হিন্দি সিরিয়াল। আরবদের যন্ত্রনা হচ্ছে কোরিয়ান বা চাইনিজ বা অন্যান্য সিরিজ। আছে গেম অফ থ্রোনসের মতন সিরিজ, যা একই সাথে আপনাকে টানটান উত্তেজনা দিবে, একই সাথে পর্নোগ্রাফিও দেখাবে। নাহলে পর্নোগ্রাফিতো আছেই। কোথায় যেন পড়েছিলাম, পর্ন ওয়েবসাইটে ভিজিটিংয়ে আমাদের দেশ অনেক উপরের তালিকায় আছে। আমার, আপনার ছেলেমেয়েরা যদি না করে থাকে, তাহলে কাদের ছেলেমেয়েরা করছে?
সেই তুলনায় সাধারণ মানুষ দেখছে যে উমার সিরিজটি একটি ভাল সিরিজ। অথেন্টিক সিরিজ। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা ব্যক্তিত্বদের একজনের সম্পর্কে অনেক কিছুই অনেক সহজে ও কম সময়ে জেনে যাব, যা হাজার খানেক বই পড়ে জানতে হতো। মুসলিমরা মহানন্দে, নিশ্চিন্ত মনে পুরো পরিবার নিয়ে অনেকদিন পর কোন সিরিজ এইভাবে দেখতে পারলো। সুস্থ বিনোদন। ১০০% হালাল? অবশ্যই নয়। তবে better of two evils? নিঃসন্দেহে।
এখন কিছু ঐতিহাসিক ফ্যাক্ট বলি। তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে। ইসলামিক ইতিহাসে কফি এক সময়ে ব্যান ছিল, জানেন? কফির উৎপত্তি ও বিকাশ আরবদের মাধ্যমেই ঘটেছে এই কথা নিশ্চই জানেন? ইয়েমেনি বণিকেরা আফ্রিকা থেকে কফি এনে অটোম্যান সাম্রাজ্যের বাজারে বিক্রি করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে এটি জনপ্রিয় হতে শুরু করে। এবং এক পর্যায়ে মক্কা মদীনাতেও ঘরে ঘরে ছড়িয়ে যায়। মেইন স্ট্রিম ইসলামিক স্কলাররা তখন একে হারাম ঘোষণা করেন। কেন? কারন, "কফি খেয়ে মানুষ আড্ডা দেয়, সময়ের অপচয় করে। অপচয়কারী শয়তানের ভাই।" "সুফীরা কফি খেয়ে রাত জেগে নেচে নেচে ইবাদত করে। তাই এটি বেদাত।"
৯১৭ হিজরীর ২৩সে রবিউল আউয়াল (মার্চ, ১৫১১ খ্রী.) এক বিশ্বখ্যাত আলেম কাবা ঘর তাওয়াফ করার সময়ে দেখেন যে কিছু যুবক কিছু একটা পান করতে করতে মসজিদের কোণে বসে আড্ডা দিচ্ছে। তিনি তাঁদের কাছে এগিয়ে গেলে তাঁরা সেই পানীয় লুকিয়ে ফেলে। আলেমের সন্দেহ হওয়ায় তিনি সেই পানীয় বাজেয়াপ্ত করেন। যুবকদের গ্রেফতার করা হয়। এবং শাফীই, হাম্বলী, মালেকী ও হানাফী মাজহাবের বড় বড় আলেমদের জরুরি সভা ডাকিয়ে তাঁদের বিচার করা হয়। অনেক তর্ক বিতর্কের পরে ঘোষণা দেয়া হয় কফি যেহেতু হারাম, এবং যুবকরা কাবা মসজিদের ভিতর হারাম কাজ করছিল, কাজেই ওদের শাস্তি দেয়া হবে। তাঁদের বেত্রাঘাত করা হয়।
১৫৪৪ সালের দিকে অটোম্যান সম্রাট ঘোষণা দেন কফি হারাম! পরবর্তীতে ধীরে ধীরে যখন স্কলাররা বুঝতে পারেন কফিতে এমন কিছুই নেই যে কারনে আপনি একে হালাল ঘোষণা করতে পারবেন না, তখন একে হালাল ঘোষণা করা হয়। আজও এরাবিকা বিন্স, বা এরাবিকা কফি অনেক জনপ্রিয় পানীয়। "মোকা" কফির উৎপত্তিও মুসলিম বিশ্বেই। কয়েক বছর আগেও কফির বিজ্ঞাপনে আরবদের প্রতিনিধিত্ব করা হতো।
শুধু কফিই না, প্রিন্টিং প্রেসের ঘটনা কয়জন জানেন জানিনা। বহুবছর আগে এই নিয়ে বিস্তারিত লেখা লিখেছিলাম। সংক্ষেপে বলতে হলে, একটা সময়ে মুসলিম বিশ্বে এটিও হারাম ঘোষণা করা হয়েছিল। জ্ঞান বিজ্ঞানে মুসলিমদের পিছিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারনও ছিল এই যে আমাদের অঞ্চলে কোন প্রিন্টিং প্রেস ছিল না। প্রিন্টেড বই পড়ার অনুমতিও ছিল না। ভাবতে খুবই অবাক লাগে যে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জেও প্রিন্টিং প্রেস ছিল, অথচ মহাশক্তিশালী অটোম্যান সাম্রাজ্যে তা ছিল না। বিশ্বের প্রথম প্রিন্টেড কোরআন মুসলিমরা বের করেনি। যে কারনে সেটি ছিল ভুলে ভর্তি। ১৮২০-৩০ এর আগে আমাদের কোন প্রিন্টেড বই নেই। আজকে আমাদের দেশে ইসলামী বইমেলা হয়। মক্কায় প্রতি মিনিটে হাজার হাজার কপি কুরআন প্রিন্ট হয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এইসব কথা শুনে অবাক হচ্ছেন?
অবাক হবার আরও বহুকিছু আছে। যখন পুরো পৃথিবী জুড়ে দাসপ্রথা বন্ধ করা হচ্ছে, তখন মুসিম আলেমরা দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন, "যেহেতু ইসলামে দাস প্ৰথা হালাল, তাই আমরা যদি একে বন্ধ করি, তাহলে আমরা কাফির হয়ে যাব!" কিং ফয়সালের ঘোষণায় সৌদি আরবে দাস প্রথা বন্ধ করা হয় ১৯৬২ সালে, ওমানে ১৯৭০! এর আগে পর্যন্ত বাজারে প্রকাশ্যে দাস দাসী কেনাবেচা হতো। বিশ্বাস হয়? আজও অনেক আলেম ফতোয়া দেন বাল্যবিবাহের পক্ষ্যে। ভাবটা এমন যেন আমরা কেউ বাল্যবিবাহ না করলে কাফির হয়ে যাব। লুকিয়ে লুকিয়ে আজও দেশের বহুস্থানে ১৮ বছরের নিচের মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে।
কেউ বুঝতে চায় না যে, আমাদের ধর্ম একটি পারফেক্ট ধর্ম। স্বয়ং আল্লাহ এমনভাবে একে ডিজাইন করেছেন যে দাস প্রথা, বাল্য বিবাহ ইত্যাদি বাদ দিয়েও আমাদের ধর্মের ফাউন্ডেশনের কিছুই যায় আসেনা। অথচ আলেম উলামারা একে এমনভাবে বিরোধিতা করেছিলেন যে আজও অমুসলিম এবং ইসলামবিরোধীরা তাঁদেরই ফতোয়া ব্যবহার করে ইসলামকে আক্রমন করে। বর্তমানে পুরো বিশ্বে একটিও আলেম খুঁজে পাওয়া যাবেনা যিনি দাস প্রথা ফিরিয়ে আনার পক্ষে কথা বলবেন। এইটা ফ্যাক্ট।
সৌদিতে রেডিও যখন প্রথম চালু হয়, তখন একদল "উলামা" ঘোষণা দেন, "এটি সিহর" (কালো-জাদু)। নাহলে এইটা কিভাবে সম্ভব যে কেউ একজন অতি দূরে বসে কিছু একটা বলবে, আর সেটা সম্পূর্ণ বিপরীত প্রান্তে বসে শোনা যাবে? তাঁদের একদল গিয়ে এই কালোজাদু বিনষ্ট করতে রেডিও ট্রান্সমিশন টাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে কুরআন পাঠ করতেন। কিং আব্দুল আজিজ করলেন কি এক সমাবেশে তামাম আলেম উলামাদের ডেকে পাঠালেন। এদিকে রেডিও স্টেশনে বলে দিলেন কুরআন পাঠ করতে। সবাই যখন রেডিওতে কুরআন তেলাওয়াত শুনলেন, তখন তাঁরা মেনে নিলেন এতে কোন কালোজাদু নেই। থাকলে কুরআনের আয়াত এইভাবে শোনা যেত না। তাঁরা রেডিও বিদ্বেষ তুলে নিলেন।
তারপরই এলো টেলিভিশন। চিন্তা করতে পারেন? সৌদি আরবে টেলিভিশন! ফান্ডামেন্টালিস্টরা টেলিভিশন স্টেশন আক্রমন করলো। লোকজনকে জিম্মি করলো। এদের নেতৃত্বে ছিল সাউদ পরিবারেরই এক সদস্য। কিং ফয়সাল পুলিশ/সেনা পাঠিয়ে সবাইকে উদ্ধার করলেন। তাঁর নিজের ভাতিজা নিজের পাঠানো সেনার গুলিতে নিহত হলেন। একদিন এরই ছোট ভাইয়ের হাতে কিং ফয়সাল নিহত হন। পয়েন্ট হচ্ছে, টিভিকে যারা হারাম বলেন, তাঁরাই আবার এই টিভির মাধ্যমেই জাকির নায়েকের লেকচার শুনেন। ইসলামিক টেলিভিশন চ্যানেল এখন বহু দেশে জনপ্রিয় চ্যানেল। আরবেতো ইসলামিক ফিকহ আলোচনা হয় ইসলামিক চ্যানেলের মাধ্যমে।
শুধু টিভি কেন, এই কথা কয়জন জানেন যে একটা সময়ে মসজিদে মাইক ব্যবহারও নিষিদ্ধ ছিল? খুব বেশিদিন আগের কথা না। তাঁদের মতবাদ ছিল, এটি ইহুদি খ্রিষ্টানদের আবিষ্কার। আমরা খালি গলায় মুয়াজ্জিনের আজান শুনবো, খালি গলায় ইমামের তেলাওয়াত। নাহলে "বিদআত" হয়ে যাবে। যে মসজিদগুলো থেকে এইসব ফতোয়া বেরিয়েছিল, আজকে সেসব মসজিদেই BOSE - এর মাইক (দামি ব্র্যান্ড) ব্যবহৃত হয়। আজানের সময়ে মাইকের শব্দদূষণ নিয়ে একটা কথা বলে দেখেন, আম জনতা আপনাকে কাফের ট্যাগ দিয়ে ছাড়বে। মাইক ছাড়া ওয়াজ মাহফিল হয়? কেউ কল্পনা করতে পারবেন?
আরও অনেক কথা বলার আছে। যেমন, মেসওয়াক ও টুথব্রাশ, যেমন পায়ে হেঁটে হজ্ব পালন নাকি প্লেনে যাতায়াত, যেমন মাটিতে বসে খাওয়া বনাম টেবিল চেয়ারে বসা, যেমন উটের পিঠে চড়া বাদ দিয়ে গাড়িতে চড়া, পুকুরের পানিতে ওযু বনাম টেপের পানিতে ওযু, পাঞ্জাবি পাজামা লুঙ্গি বনাম কোটপ্যান্ট, ঘড়ি দেখে নামাজের সময় নির্ণয় বনাম সূর্যের আলোয় লাঠির ছায়া দেখে ইত্যাদি বহুকিছু!
সমস্যা হচ্ছে এই যে, লোকে বলবে আমি পন্ডিতি ফলাতে আসছি। নাহয় "নেক সূরতে মানুষকে গুমরাহ" করার ষড়যন্ত্র করছি। নাহয় বলবে আমি ধর্ম পরিবর্তনের কথা বলছি। আমি কাফির, আমি মুনাফেক, আমি ছদ্মবেশী ইহুদি দালাল এবং আরও ইত্যাদি ইত্যাদি। কথা হচ্ছে, যারা এমন কথা বলেন, তাঁরা নিজেরা কী নিজের ধর্ম সম্পর্কে বিন্দুমাত্র পড়াশোনা করেন? করে থাকলে অবশ্যই বুঝতেন আমি কোন ফালতু কথা লিখছি না। নর্থ আমেরিকান ফিকহ কাউন্সিলের অনুমোদিত বিষয় নিয়েই আমি লিখি। ফ্যাক্ট ছাড়া লিখিনা। রেফারেন্স ছাড়া একটা কথা বলিনা। নিজেরা পড়াশোনা করবে না, অন্য কেউ পড়াশোনা করলে জ্বলুনিতে পুড়ে মরবে। এ কেমন মেন্টালিটি?
আল্লাহ ওদের হেদায়েত দিন। কথা হচ্ছিল উমার (রাঃ) সিরিজ নিয়ে।
এই কথা আপনারা মানেন কি না মানেন, আগামী পঞ্চাশ বা একশো বছরে প্রিন্ট মিডিয়ার স্থান দখল করে নিবে ভিডিও মিডিয়া। লোকে বইয়ের বদলে ডকুমেন্টারি দেখে শিক্ষা নিবে। আমেরিকান হিস্ট্রি, গভর্নমেন্ট এমনকি একাউন্টিং ক্লাসেও আমাদের এভাবেই বেশ কিছু ডকুমেন্টারি দেখিয়ে ইতিহাস শেখানো হয়েছিল। লিখে রাখতে পারেন, ভবিষ্যতে, সব বিষয়েই আরও বেশি বেশি ডকুমেন্টারি টাইপ ভিডিও তৈরী হবে, যেখানে ভিডিও উপস্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রদান করা হবে। এমনকি ইসলামিক দাওয়াতও আজকাল এইভাবে দেয়া হচ্ছে। ইউটিউব ভর্তি এমন ভিডিও। না দেখে থাকলে সার্চ দিন।
মোট কথা, আমাদের স্কলারদের এডুকেটেড হতে হবে। শুধু ধর্মই নয়, সব বিষয়ে। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি কিভাবে কাজ করে, ইন্টারনেট কী, কিভাবে কাজ করে ইত্যাদি থেকে শুরু করে আধুনিক বিজ্ঞান কোথায় কী বলছে, সব তাঁদের জানতে হবে। "চাঁদে মানুষ গেছে, এই কথা যে বিশ্বাস করবে সে কাফের" - জাতীয় ফতোয়া আজকের যুগে ধোপে টিকবে না। উল্টো আপনার নিজের বিদ্যা বুদ্ধিতে লোকে ইসলাম নিয়ে হাসাহাসি করবে।
তাঁরা আমাদের ধর্মীয় নেতা। যেকোন নেতা তাঁদের অধীনস্থ জনতার গতিবিধি সম্পর্কে যদি খোঁজ খবর না রাখেন, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠান মুখ থুবড়ে পড়ে। দুই লাইন থিওরি অফ এভোলুশন পড়েই ইসলামকে ত্যাগ করতে দেখেছি নিজের চোখে। কার কাছ থেকে সে গাইডেন্স পাবে? আমাদের দেশের আলেমরা যে "এন্টারকোটিক মহাদেশ" থিওরি নিয়ে ব্যস্ত!
মুসলিমদের পথে রাখতে হলে অবশ্যই আমাদের নেতাদের শিক্ষিত হতে হবে। অগ্রপশ্চাদ বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যে যেই ভাষা বুঝে, তাঁকে সেই ভাষায় উত্তর দেয়ার মতন জ্ঞান অন্ততঃ থাকতে হবে। বিজ্ঞান মনষ্ক কোন ব্যক্তিকে আপনি যদি "টাইটানিক ডুবেছিল ইহুদি খ্রিষ্টানদের ষড়যন্ত্রে" অথবা "নিউটন, গ্যালিলিও, সবাই ছিলেন চোর" অথবা "আমেরিকার কথা কোরআনে লেখা আছে" টাইপ কথা বলেন, তাহলেতো ভাই সমস্যা।
নবীর জীবনীর উদাহরণ দেই। ওটা দিতে আমার ভাল লাগে। রেফারেন্স সাইটেশন বলে যারা চিল্লাফাল্লা করেন, তাঁরা দয়া করে ইবনে হিশামের সিরাতুন্নবী পড়ে নিবেন। নাহলে কষ্ট করে গুগলে হাসান ইবনে সাবিত (রাঃ) লিখে সার্চ দিবেন, হাজার হাজার রেফারেন্স পাবেন। কোথায় এইসব ঘটনা সবার মুখস্ত থাকার কথা, উল্টা চার্জ করে আমি নাকি নিজের মাথা থেকে এইসব বানাই। অদ্ভুত সাইকোলজি!
সাহাবী হাসান ইবনে সাবেত (রাঃ) ছিলেন একজন কবি। নবী (সঃ) কবিতা রচনা করতে পারতেন না, সেই ক্ষমতা ও প্রতিভা তাঁর ছিল না। কুরআন বলে, "আমি রাসূলকে কবিতা শিখাইনি। এটি তাঁর জন্য শোভনীয় নয়।" তার মানে, কুরআন কী কবিতা চর্চা করতে উদ্বুদ্ধ করে? না।
কিন্তু কবিতা ছিল তখনকার আরবদের নিউজ মিডিয়া, প্রোপাগান্ডা, বিনোদন উৎস, ব্লগিং সাইট ইত্যাদি। শ্লীল, অশ্লীল, আবেগী, প্রতিবাদী, জ্বালাময়ী সব ধরনের কবিতাতেই ওরা ছিল ওস্তাদ! কবিতার কারণেই যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারতো (ওহুদের যুদ্ধের আগে যেমন কাব বিন আশরাফের কবিতা কুরাইশদের তাতিয়ে দিত) আবার কবিতার কারণেই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতো (হিলফুল ফুদুল)। কবিতাই ছিল আবেগ প্রকাশের মাধ্যম (হিজরতের পরে বিলাল (রাঃ), আবু বকরের(রাঃ) কবিতায় মক্কাকে হারানোর কষ্ট প্রকাশ পেত), নবীজির মৃত্যুর পরে তাঁকে সম্মান জানিয়ে কতসব ক্লাসিক কবিতা যে রচিত হয়েছে, তার তুলনা নেই। আবার কাব বিন আশরাফের মতন নরপশুর মৃত্যুদণ্ডের বিধানের অন্যতম অভিযোগ ছিল এই যে সে মুসলিম নারীদের নাম উল্লেখ করে, কবিতা লিখে তাঁদের সাথে কিভাবে কি অপকর্ম করতে হবে (চূড়ান্ত অশ্লীল, পর্নোগ্রাফি বলা চলে) ইত্যাদি বর্ণনা করেছিল। গোটা আরব সমাজে সেই সমস্ত মুসলিম নারীদের মান সম্মানের শ্লীলতাহানি করেছিল।
কাজেই, কবিতা রচনাকে যদি আজকের টেলিভিশন ও ইন্টারনেট মিডিয়ার সাথে তুলনা করেন, ভুল হবেনা (ইম্প্যাক্ট সমান বলেই তুলনা করা হচ্ছে)। আমাদের নবী (সঃ) কবিতা রচনা নিষেধ করেছিলেন? না। যখন কুরাইশরা তাদের শক্তিশালী কাব্য দিয়ে মুসলিমদের আক্রমন করতো, নবী (সঃ) তখন বলতেন, "কোথায় হাসান? এগিয়ে যাও তোমার কবিতা নিয়ে! আবু বকর ও জিবরাঈল (আঃ) তোমায় সাহায্য করবে!"
হাসান ইবনে সাবেত (রাঃ) তখন কুরাইশদের কবিতার জবাব দিতেন নিজের কাব্য ভাষায়। হাসান কোন যোদ্ধা ছিলেন না। উল্টো যুদ্ধের নামে তিনি ভীত হতেন। কিন্তু কবিতা লিখে তিনি ইসলামের যে কাজে এসেছেন, আবু বকর, উমার, উসমান, আলী, খালিদ বা কোন সাহাবী সেটা করতে পারেননি। তিনি ছিলেন নবীজির (সঃ) রাজকবি/সভাকবি (অফিশিয়াল পয়েট)। তাঁর মৃত্যুর পরে মসজিদে নববীতে একবার তিনি কবিতা আবৃত্তি করছিলেন, যখন উমার (রাঃ) ছিলেন খলিফা। তিনি এসে হাসানকে তিরস্কার করে বলেন, "তুমি নবীর মসজিদে কবিতা পাঠ করছো?"
হাসান (রাঃ) জবাবে বলেন, "আমি তখনও এই মসজিদে এই কাজ করতাম যখন এই মসজিদের ইমাম তোমার চাইতেও উত্তম লোক ছিলেন (স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ))।" উমার (রাঃ) এরপরে আর কখনই হাসানকে ঘাটাননি।
সবাই আশা করি জানেন, তারপরও কিছু মানুষ ত্যানা প্যাচান বলেই বলছি, এতক্ষন যে কথাগুলো লিখলাম, একটিও আমার মনগড়া কথা নয়। ইসলামে কারোর খেয়াল খুশিমতন কথা বলার অনুমতি নেই। এই কথা আপনি যেমন জানেন, আপনার চেয়ে বেশি ভাল করে আমি জানি। এই লেখার সব পয়েন্টই ইয়াসির ক্বাদীর সাথে ভ্যারিফাই করা। তিনি একজন বিশ্বখ্যাত স্কলার, নর্থ আমেরিকান ফিকহ কাউন্সিলের সদস্য, এবং আমার এলাকার মসজিদের ঈমাম। যার যার ধারণা তিনি ইসলাম জানেন না, তিনি সহীহ মুসলমান না, তাঁদের কথা আলাদা। তাঁরা ভাল থাকুন।