হিরু অনুদা: এক জাপানি সৈনিকের অবিশ্বাস্য পরাক্রমের গল্প
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
একটি বাক্যই বদলে দিয়েছিল হিরু অনুদার জীবন, দীর্ঘ ৩০ বছর যিনি জঙ্গলে কাটিয়েছেন পরিবার-পরিজন ছাড়া!
১৯৪৪ সালের শেষ দিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। জাপানের অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। প্রশান্ত মহাসাগর জুড়ে জাপানের ক্ষমতায় থাকা দ্বীপগুলো আমেরিকান সৈন্যরা দখল করে নিচ্ছে। এমন সময় জাপানিজ ইম্পেরিয়াল আর্মির মেজর তানিগুচি ডেকে পাঠালেন এক গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে। পদে তিনি একজন লেফটেন্যান্ট, নাম তার 'হিরু অনুদা', আমাদের গল্পের নায়ক, এন আনডিফিটেড ওয়ারিয়র।
২৬ ডিসেম্বর ১৯৪৪ সালে অনুদাকে ফিলিপাইনের লুবাং দ্বীপে পাঠানো হলো। তার কাছে ছিল তার তরবারি, আইসাকা টাইপ নাইনটি নাইন রাইফেল, মায়ের দেয়া একটা ছোড়া ও তানিগুচির দেয়া শেষ নির্দেশ- 'কোনোভাবেই আত্মসমর্পণ বা আত্মাহুতি দেবে না, আমৃত্যু লড়াই করে যাবে' যে নির্দেশ পরবর্তী জীবনে হিরু অনুদা বেদবাক্যের মতোন অনুসরণ করেন এবং এই নির্দেশটিই তার জীবন পাল্টে দেয়! কীভাবে? বলছি!
১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমেরিকান সৈন্যরা প্রবল পরাক্রমের সাথে লুবাং দ্বীপ দখল করে নিলেন। হিরু অনুদা ও তার তিন সহযোগী ঘনজঙ্গলে আত্মগোপন করলেন, পুরো পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় হিরু অনুদা গেরিলা আক্রমণের ছক কষতে থাকলেন। তাকে ফিলিপাইনের জঙ্গলে রেখে আমরা ঘুরে আসি বাইরের পৃথিবী থেকে।
সময় একটু পেছানো যাক। ১৯৩৯ সাল। অটোহ্যান ও লিস মেইটনার আবিস্কার করলেন যে ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস দুভাগ করলে শক্তি পাওয়া যায়, যাকে বলে ফিশান। এই খবর পেয়ে নিলস বোর তার ছাত্র জন পিলারকে নিয়ে নিউক্লিয়ার ফিশানের কোয়ান্টাম ডাইনামিকস বের করবার চেষ্টা করতে লাগলেন। বিভিন্ন হিসাব কষে তারা নিশ্চিত হলেন যে এটম বোমা বানানো সম্ভব। তাৎক্ষণাত তারা দেখা করলেন আইনস্টাইনের সাথে।
এর ফল পাওয়া গেল ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট। ইউরোনিয়াম-২৩৫ সমৃদ্ধ লিটল বয় নিয়ে বৈমানিক পল টিবেট হিরোসিমার আকাশে পৌছালেন। তার কিছু মুহুর্ত পর হিরোসিমা মাটির সাথে মিশে গেল। আর কদিন পর নাগাসাকিও। অক্টোবরে জাপান সরকার আত্মসমর্পণ করলেন। জাপানি সৈন্যদের মাঝে অনেকেই তখনো আশেপাশের দ্বীপে গেরিলাযুদ্ধ করে যাচ্ছে। তাদের মাঝে হিরু অনুদাও একজন। তখন তিনি লুবাংয়ের জঙ্গলে দিন কাটান। সাথে তার তিন সহযোগী। আকাৎসু, সিমাদা ও কনুকা। সেই জঙ্গল থেকেই গেরিলাযুদ্ধ চালাতেন তারা। কখনো সাপ্লাই লাইনে আক্রমণ, কখনোবা স্থানীয় পুলিশদের উপর হামলা, এমনকি ত্রিশজন ফিলিপিনীও তাদের হাতে নিহত হন।
যুদ্ধ পরবর্তী সময় জাপানি সৈনিকদের হামলা চালিয়ে যাওয়া দ্বীপবাসিদের জন্য দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। জাপান সরকার তাদের সৈনিকদের ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে হাজার হাজার লিফলেট ফেলা হল হেলিকপ্টার থেকে। অনুদা ও তার সহযোগিরা সেই লিফলেট পেলেন। লিফলেটে লেখা ছিল- যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, তারা যেন বাড়ি ফেরে। কিন্তু অনুদারা সেই লিফলেট পরীক্ষা করে বাড়ি যাবার পরিবর্তে পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন। তারা মনে করলেন, এই লিফলেট আমেরিকানদের চাল বৈকি কিছু নয়। হিরু অনুদার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল সম্রাট হিরুহিকো কখনোই আত্মসমর্পন করতে পারেন না।
এভাবে পাঁচ বছর চলে যায়। বেশিরভাগ সৈন্যরা ততদিনে বাড়ি ফিরে গেছে, লুবাং থেকে আমেরিকান সৈন্যরাও সটকে গেছে। এরমাঝে অনুদার এক সহযোগী আকাৎসু অন্যদের ত্যাগ করে বের হয়ে আসেন। ১৯৪৯ সালে তিনি ফিলিপাইন সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করেন। এতে যেন অনুদা আরও ক্ষেপে উঠেন। তিনি তখনো যুদ্ধ করছেন। ফিলিপিনীও কৃষকদের গুলি করছেন, তাদের জমির ধান পুড়িয়ে দিচ্ছেন, জঙ্গলে ঘুরতে যাওয়া মানুষদের ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলছেন... ফিলিপাইনের সরকারের চোখ এড়ালো না ব্যাপারটা থেকে। তারা আবার লিফলেট ছুড়লেন জঙ্গল জুড়ে, 'যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, তোমরা বেরিয়ে এসো।'
১৯৫২ সালে জাপান সরকার আবার চেষ্টা করলেন। এবার লিফলেটের সাথে জুড়ে দিলেন পরিবারের ছবি ও চিঠি। এমনকি সম্রাটের পক্ষ থেকে আত্মসমর্পনের বিবৃতিও ছিল সেখানে। কিন্তু আবারও অনুদা মনে করলেন যে সেটা আমেরিকান সরকারের একটা চাল। জাপান যুদ্ধে হারতে পারে না। হায় অনুদা! তার জানা ছিল না, কোয়ান্টাম থিউরির শক্তি ঠিক কতোটা।
এরপর শুধু অনুদার জীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। ১৯৫৩ সালের জুনে, তার আরেক সহযোগী সিমাদার পায়ে গুলি লাগে। তারা তখন স্থানীয় জেলেদের সাথে গুলি বিনিময় করছিল। সে যাত্রায় সুস্থ হয়ে উঠলেও ১৯৫৪ সালের ৭ই মে এক তল্লাসী দলের গুলিতে মারা যান সিমাদা। তল্লাসী দল আর কাওকে খুঁজে না পেলে তাদেরকে মৃত হিসেবে ঘোষনা করা হয়। ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষনা করা হয় তাকে। যদিও তখনও হিরু অনুদা প্রাচীন প্রেতাত্মার মতোন লুবাংয়ের দ্বীপে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
১৯৭২ সালে অনুদা ও তার শেষ জীবিত সঙ্গী কনুকা স্থানীয় কৃষকদের ধান পুড়িয়ে দিচ্ছিলেন। সে সময় পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় কনুকার। তার মৃত্যুতে এ ধারণা আরও কঠিন হয় যে হিরু অনুদাও হয়তো বেঁচে আছেন। এবং সেই একমাত্র জাপানি সৈন্য যে জীবিত অবস্থায় তখনো আত্মসমর্পন করেনি। কনুকার মৃত্যুর পর ফিলিপাইন সরকার ও জাপান সরকার পর পর দুবার তল্লাসী চালায় লুবাং এর জঙ্গলে। কিন্তু কেউই অনুদার চিহ্ন দেখতে পান না।
ঠিক সে সময় মরিয়র সুজুকি, জাপানের এক ভবঘুরে ছেলে ঠিক করে সে অনুদাকে খুঁজে বের করবে। জাপান থেকে সে বের হয় তিনটি জিনিস খুঁজে বের করবে বলে- একটা পান্ডা, হিরু অনুদা ও হিংস্র বরফমানব। লুবাং এর জঙলে পৌছে সুজুকি প্রায় চারদিন ধরে হিরু অনুদার নাম ধরে চেঁচাতে থাকেন। সে বলছিল, 'হিরু অনুদা, সম্রাট আপনাকে নিয়ে চিন্তিত।' এবং চারদিন পরে অনুদা বেড়িয়ে আসেন। সুজুকি তার দেখা পান। পরবর্তী জীবনে হিরু অনুদা বলেছিলেন হিপ্পি মার্কা ছেলে এক জাপানি সৈন্যের সুখ দুঃখের কথা জানতে লুবাং গিয়েছিল। সুজুকি আমার কাছে জানতে চেয়েছিল আমি আত্মসমর্পন কেন করছি না।
হিরু অনুদার জবাব কী ছিল এই প্রশ্নের? তিনি জবাবে বলেছিলেন, কেননা মেজর তানিগুচি আমাকে কখনো আত্মসমর্পন না করার নির্দেশ দিয়েছেন। সুজুকি এরপর জাপান ফিরে আসেন, সাথে হিরু অনুদার সাথে তার ছবি নিয়ে।
জাপান সরকার অনুদার কমান্ডিং অফিসার তানিগুচিকে লুবাং পাঠান। ১৯৭৪ সালের ৯ মার্চ তানিগুচি অনুদাকে যুদ্ধ থেকে অব্যাহতি দেন। এভাবেই এই একা সৈন্যের ত্রিশ বছরের নিঃসঙ্গ যুদ্ধ শেষ হয়। ফিলিপাইন সরকারও তাকে ক্ষমা করে দেয়, জাপান সরকারও তাকে নায়কের সম্মানে বরণ করে নেয়। দেশে ফিরে তিনি তার এই অকল্পনীয় সংগ্রাম নিয়ে বই লেখেন, 'নো সারেন্ডার: মাই থার্টি ইয়ারস ওয়ার।'
ত্রিশ বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া এই সৈনিক পরবর্তী জীবনে জাপানের যুদ্ধপরবর্তী রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন মেনে নিতে পারেননি। তিনি আত্মসমর্পন করেন পুঁজিবাদের কাছে এবং চলে যান ব্রাজিলে। সেখানেই মাচি নামের এক তরুণীকে বিয়ে করে থিতু হন, যদিও লুবাংকে তিনি ভুলতে পারেননি। ১৯৯৬ সালে তিনি লুবাং ঘুরতে যান। সেখানকার একটি স্কুলে তিনি দশহাজার ডলার অনুদান দেন। হয়তো কাল্পনীক যুদ্ধের বিভীষিকা দুঃস্বপ্নের মতোন তাকে হানা দিত। কে জানে?
হিরু অনুদার গল্পের শেষটা সুন্দর। তিনি ব্রাজিলেই তার বাকি জীবন কাটান এবং বৃদ্ধ অবস্থায় সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর জাপান তাকে এক অবিস্মরণীয় যোদ্ধা হিসেবে মনে রেখেছে আজও।
-
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে