সম্প্রতি মাদক সংক্রান্ত এক মামলায় হাইকোর্ট দিয়েছে ব্যতিক্রমী রায়। ৫ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামীকে যেতে হবে না কারাগারে। পরিবারেই থাকতে পারবেন। তবে মানতে হবে অন্যরকম তিনটি শর্ত!

আমাদের দেশে অপরাধীর শাস্তি বিধানের ক্ষেত্রে আদালতের নানারকম চমক আমরা দেখতে পাচ্ছি বেশ কিছুদিন ধরে। অপরাধ করলেই জেল/জরিমানা'র গৎবাঁধা চৌহদ্দি অতিক্রম করছেন ইদানীংকালের অনেক বিচারকেরা। সম্প্রতি কক্সবাজারের চকরিয়ার এক আদালতের বিচারক যেমন অপরাধীকে শাস্তির বদলে বলে দিলেন গাছ লাগাতে, মুক্তিযুদ্ধের বই পড়তে। সেরকমই আরেকটি অন্যরকম বিচারের উদাহরণ দেখি আমরা হাইকোর্টের ক্ষেত্রেও।

সম্প্রতি উচ্চ আদালতের রায়ে মতি মাতবর নামে এক আসামীকে দেয়া হয়েছে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের এক শাস্তি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এরকম 'ভারডিক্ট ফর কমিউনিটি রিফর্ম' সিস্টেম অনেকদিন থেকেই চালু থাকলেও, আমাদের দেশে এ কনসেপ্ট অতটা জনপ্রিয় হয়নি আজও। তবে বিচারকেরা সাম্প্রতিক সময়ে দুই একটি মামলায় কমিউনিটি রিফর্মকে মাথায় রেখেই রায় দিচ্ছেন। হাইকোর্ট যেটির সাম্প্রতিক উদাহরণ। 

মাদক সংক্রান্ত এই মামলার আসামীর রিভিশনের আবেদনের ভিত্তিতে ট্রায়াল কোর্টের দেয়া পাঁচ বছরের কারাদণ্ডকে স্থগিত করে সম্প্রতি উচ্চ আদালত রায় দিয়েছে, আসামীকে জেলে যেতে হবে না। সে নিজের পরিবারের সাথেই থাকত পারবে, যদি সে আদালতের দেয়া তিনটি আদেশ মেনে চলতে পারে।

প্রথম নির্দেশ- আসামীকে তার দুই ছেলের পড়াশোনা শেষ করার দায়িত্ব নিতে হবে৷ আসামীর এক ছেলে ক্লাস টু, আরেক ছেলে ক্লাস টেনে পড়ে। তাদের পড়াশোনায় যাতে কোনোরকম বিঘ্ন না ঘটে, সেটা দেখার দায়িত্ব নিতে হবে তাকে। দ্বিতীয় নির্দেশ- তার বয়স্ক মা'কে দেখাশোনা করতে হবে৷ তৃতীয় নির্দেশ- আসামীর পনেরো বছর বয়সের এক মেয়ে আছে। সে মেয়েকে আঠারো বছর বয়সের আগে বিয়ে দেওয়া যাবে না।

আসামী যদি এই তিনটি নির্দেশ ঠিকঠাকভাবে পালন করতে পারে, তাহলে তাকে আর জেলেও যেতে হবে না, শাস্তিও মওকুফ হবে।

উচ্চ আদালতের এরকম রায়ে আমরা আসলেই আশান্বিত হই। এই আশাবাদের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ আছে৷ আমাদের কারাগার-ব্যবস্থার দিকে যদি আমরা তাকাই, তাহলে দেখবো, শাস্তি হিসেবে আসামীকে কারাগারে আটকে রাখা, এখন অনেকটাই অফলপ্রসূ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধারণক্ষমতার তিনগুণ অতিরিক্ত কয়েদীর ভারে কারাগার এখন অনেকটাই ন্যুব্জ। তাই বিচারকদের যে গতানুগতিক শাস্তির বিধান থেকে এখন অনেকটাই সরে আসতে হবে, সেটা অনেকটাই সময়ের প্রয়োজনে।

এছাড়াও যে শাস্তির বিধান আমরা চকরিয়ার ক্ষেত্রে দেখি, হাইকোর্টের ক্ষেত্রে দেখি, এই শাস্তিগুলোর মূলসূত্র একই; অপরাধীকে সরাসরি সমাজের কাঠামোর সাথে সংশ্লিষ্ট হতে হবে। সমাজের কল্যানে কাজ করতে হবে৷ এরকম শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে, একই সাথে তিনটি কাজ হয়। সমাজের কিছু উপকার হয়, অপরাধীর শাস্তির ভার কিছুটা লাঘব হয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সমাজের মূলধারার সাথে যুক্ত হয়ে অপরাধীর মানসিক বিকাশটাও আরেকটু জোরদার হয়।

উচ্চ আদালতের এই রায় তাই আমাদের আলো দেখায়। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, যারা এখনো বিচারের আশায় আদালতের কাঠামোতে ক্রমাগত, নিয়মিত ঘুরপাক খাচ্ছেন, তাদের প্রতি বিচারকেরা আরেকটু মানবিক হবেন, রায় দেয়ার ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক এবং সমাজের কল্যানের সাথে সম্পর্কযুক্ত রায় দেবেন। এতে করে বিচার ব্যবস্থার পরিক্রমা সরাসরিভাবেই যুক্ত হয়ে যাবে সমাজ, রাষ্ট্রের মানসিক বিকাশ-প্রক্রিয়ার সাথে। যাতে করে মঙ্গল হবে সবারই। নিশ্চিত হবে রাষ্ট্রীয় সাম্যাবস্থাও।

আমরা আদালতের এরকম সিদ্ধান্ত বারবার প্রত্যাশা করি। সমাজ পরিবর্তনে আদালতের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণও কামনা করি। 

তথ্যসূত্রদ্য ডেইলি স্টার

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা