প্রতিটা ডায়লগ, প্রত্যেকটা সিকোয়েন্স অজস্র বার দেখা মুখস্ত হয়ে গেছে, তবুও নতুনের মতো লাগে প্রতিবার। 'হেরা ফেরি' তো আমাদের কাছে শুধু সিনেমা নয়, জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটা অংশেও পরিণত হয়েছে!

নাসিরউদ্দিন শাহ এবং ওম পুরিকে ধরা হয় ভারতবর্ষে জন্ম নেয়া সর্বকালের সেরা দুই অভিনেতা হিসেবে। সেই নাসিরউদ্দিন শাহ একবার অভিনেতা পরেশ রাওয়াল সম্পর্কে বলছিলেন- 'আমাদের মধ্যে তো একটা কম্পিটিশন থাকেই। ও যে ক্যারেক্টারগুলো করলো, কিভাবে পোট্রে করলো, কতটা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারলো, আমি এই জায়গায় থাকলে কি করতে পারতাম- যে কারো অভিনয় দেখতে বসলে এসব মাথায় ঘোরে। তারপর একদিন আমি হেরা ফেরি দেখলাম। এমনিতে কমেডি ফিল্ম খুব একটা দেখা হয় না, কেন যেন সেটা দেখতে হয়েছিল। বাবুরাও গনপতরাও আপ্তে, ওই এক চরিত্রে পরেশ যা করেছিল, এটা আমি কখনও করতে পারতাম না।" 

কি এমন করেছিলেন পরেশ রাওয়াল? একটা কমেডি সিনেমাই তো, সেখানে একটা পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতার পক্ষে কি এমন করা সম্ভব যে, নাসিরউদ্দিন শাহ'র মতো অভিনেতা বলছেন তিনি কখনোই এরকম একটা চরিত্রে অভিনয় করতে পারতেন না? পরেশ রাওয়াল একা করেননি অবশ্য, করেছিল হেরা ফেরি সিনেমার পুরো টিম। বিনোদনের চূড়ান্ত যোগান দিয়েছিল সিনেমাটা, বক্স অফিসে আহামরি সফলতা না পেলেও জায়গা করে নিয়েছিল দর্শকের মনে। মুক্তির দুই দশক পরেও মানুষ হেরা ফেরির কথা স্মরণ করে, এই সিনেমার টুকরো টুকরো অংশ বা সংলাপ নিয়ে মিম বানানো হয়। মেইনস্ট্রিম সিনেমার জন্যে এটা বিশাল একটা অর্জন। 

একটা কমেডি ক্যারেক্টার যে এতটা প্রভাবশালী হয়ে পর্দায় বিচরণ করতে পারে, সেটা হেরা ফেরির বাবুরাও গনপতরাও আপ্তে ওরফে বাবুভাইয়া'কে না দেখলে জানাই হতো না। অশিক্ষিত এক মারাঠি গ্যারেজ মালিকের চরিত্রে ফাটিয়ে অভিনয় করেছিলেন পরেশ রাওয়াল, পর্দায় তার উপস্থিতি এতটাই প্রাণবন্ত আর দুর্দান্ত ছিল যে, অক্ষয় কুমার আর সুনীল শেঠির মতো নায়কও আড়ালে চলে গিয়েছিলেন অবলীলায়! একেকটা ডায়লগ, কমিক টাইমিং, চোখ-মুখের এক্সপ্রেশন- সব মিলিয়ে পুরোটা সিনেমা প্রায় একাই টেনে নিয়েছেন আমাদের বাবুভাইয়া! 

সুনীল শেঠি, পরেশ রাওয়াল এবং অক্ষয় কুমার

বলিউডের সর্বকালের সেরা কমেডি ফিল্মের তালিকায় অনেকেই হেরা ফেরিকে সবার ওপরে রাখেন। অথচ এই সিনেমাটার জন্মই হবার কথা ছিল না, অন্তত প্রযোজক-পরিচালক কারো মাথাতেই কমেডি ফিল্ম বানানোর চিন্তা ছিল না। প্রথমে পরিকল্পনা ছিল একটা অ্যাকশন ফিল্ম বানানোর, সেই কাস্টিংয়ে সুনীল শেঠি, টাবু- কেউই ছিলেন না। বরং নেয়া হয়েছিল সঞ্জয় দত্ত, কারিশমা কাপুরকে। সেই সিনেমার নাম ঠিক করা হয়েছিল 'রাফতার'। পরে  শিডিউল জটিলতায় সিনেমাটা ছেড়ে দেন সঞ্জয় এবং কারিশমা, তাদের জায়গায় নেয়া হয়েছিল সুনীল শেঠি এবং টাবুকে। 

কিন্ত অ্যাকশন ফিল্ম 'রাফতার' কি করে কমেডি ফিল্ম 'হেরা ফেরি' হয়ে গেল? শুটিং শুরু হয়ে গেছে ততদিনে, বলিউডে অ্যাকশন ফিল্মের বাজার তখন খারাপ যাচ্ছে। ফিরোজ নাদিয়াদওয়ালা ঝানু প্রযোজক, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই সময়ে এই গল্পের সিনেমা দর্শকের গ্রহণ না করার সম্ভাবনাই বেশি। বরং ওই সময়টায় কমেডি ফিল্মগুলো বক্স অফিসে ভালো করছিল। অভিনেতা-অভিনেত্রী সবার তো ডেট নেয়াই আছে, তাই তিনি শরণাপন্ন হলেন পরিচালক প্রিয়দর্শনের। 

১৯৮৯ সালে প্রিয়দর্শন 'রামজি রাও স্পিকিং' নামের একটা কমেডি ফিল্ম বানিয়েছিলেন, সেটা দারুণ সাড়া ফেলেছিল দক্ষিণে। ফিরোজ নাদিয়াদওয়ালা সেই সিনেমাটা দেখেছিলেন, তার বেশ পছন্দ হয়েছিল সেটা। প্রিয়দর্শনের সাথে কথা বললেন ফিরোজ, প্রোজেক্ট লক হয়ে গেল, 'রামজি রাও স্পিকিং' বানানো হলো হিন্দিতে, নাম হলো হেরা ফেরি। এখানে বলে রাখা ভালো, 'রামজি রাও স্পিকিং' এর রামজি রাও এবং হেরা ফেরির বাবুরাও গনপতরাও আপ্তে কিন্ত একই চরিত্র, শুধু সেটাকে মহারাষ্ট্রের আদলে সাজানো হয়েছে। আর দর্শকের কথা মাথায় রেখে মশলা হিসেবে হেরা ফেরিতে যোগ করা হয়েছিল কয়েকটা গান, সেগুলোর মধ্যে দুটোর আবার শুটিং হয়েছিল দেশের বাইরে।

এখনও হেরা ফেরিকে নিয়ে বানানো হয় ফানি মিম বা ভিডিও

সিনেমার ওপেনিং কালেকশন খুব একটা ভালো ছিল না। কিন্ত কন্টেন্ট তো দুর্দান্ত, তাকে আর থামিয়ে রাখবে কে? সেকালে তো তরন আদর্শ ছিলেন না, ফেসবুক-ইউটিউবে রিভিউর মেলা ছিল না, তাই হেরা ফেরির কথা ছড়িয়েছে ধীরে, লোকের মুখে মুখে। মানুষ হলমুখো হয়েছে আস্তে আস্তে, প্রেক্ষাগৃহের বাইরে টানানো হয়েছে হাউজফুল সাইনবোর্ড। বক্স অফিস ইন্ডিয়ার ওয়েবসাইটে অবশ্য হেরা ফেরির ভার্ডিক্ট দেয়া হয়েছে 'অ্যাভারেজ', তবে বলিউডের ট্রেড অ্যানালিস্টদের বেশিরভাগেরই অভিমত, বিশ বছর আগে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটা হিট হয়েছিল। 

কুড়ি বছর পার হয়ে গেছে এক দুই তিন চার করে, ক্যালেন্ডারের পাতা বদলেছে অজস্রবার। হেরা ফেরি নামের কাল্ট ক্ল্যাসিক সিনেমাটা আমাদের কাছে পুরনো হয়নি, এমনকি এই সিনেমার পরের ভার্সন, 'ফির হেরা ফেরি' যেটার নাম, সেটাও ভীষণ প্রিয়। আজও মন খারাপ থাকলে শরণ নেই বাবু ভাইয়ার, তার মুখে 'খোপড়ি তোড় সালে কা', 'ইয়ে বাবুরাও কি স্টাইল হ্যায়' কিংবা 'ইয়ে স্টার গ্যারেজ হ্যায়, স্টার ফিশারিজ নেহি, দেখকে ডায়াল কর কুত্তেয়া' সংলাপগুলো শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ি। প্রতিটা ডায়লগ, প্রত্যেকটা সিকোয়েন্স অজস্র বার দেখা মুখস্ত হয়ে গেছে, তবুও নতুনের মতো লাগে প্রতিবার। 'হেরা ফেরি' তো আমাদের কাছে শুধু সিনেমা নয়, জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটা অংশেও পরিণত হয়েছে!

তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা- বলিউড হাঙ্গামা, কইমই ডটকম, দেশিমার্টিনি, রাব্বী খান


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা