ওদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বনাম আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী...
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

ব্যর্থতার দায়ভার কাঁধে নিয়ে পদত্যাগ করেছেন নেদারল্যান্ড, ব্রাজিল এবং চিলির স্বাস্থ্যমন্ত্রী। নিউজিল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তো সফল হয়েও পদ ছেড়েছেন আইন ভাঙার কারণে। আর আমাদের এখানে...
করোনাভাইরাসের মোকাবেলা যথাযথভাবে করতে না পেরে বিশ্বের অনেক দেশেই স্বাস্থ্যমন্ত্রীরা পদত্যাগ করেছেন। নেদারল্যান্ডের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ব্রুনো ব্রুইন্সের নামটা এই তালিকায় সবার আগে থাকবে। ইউরোপে করোনা যখন তাণ্ডব চালাচ্ছিল, মৃতের সংখ্যা বাড়ছিল প্রতি সেকেন্ডে, তখন এই ভদ্রলোক পদত্যাগ করেছিলেন নিজের চেয়ার থেকে, বলেছিলেন, দায়িত্ব পালনে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। শুধু তাই নয়, সংসদ অধিবেশনে বিরোধী দলের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে তিনি লজ্জায় জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়েছিলেন, তারপরেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজের পদত্যাগপত্র বুঝিয়ে দিয়ে দায়িত্ব থেকে ইস্তফা নিয়েছেন।
ইউরোপ আমেরিকা ঘুরে করোনা ভয়াবহ রূপ নিলো ব্রাজিলে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যেতে থাকলো। সেদেশের প্রশাসন ব্যর্থ হলো কার্যকরী লকডাউন জারী রাখতে, করোনা মোকাবেলায় সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারেনি তারা। সেকারণেই ফুটবলের জন্য বিখ্যাত এই দেশটিতে করোনা প্রভাব বিস্তার করেছে ভালোভাবেই। দুর্নীতির জন্য ব্রাজিলের রাজনীতিবিদদের সুনাম আছে। তবুও করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় ক্রমাগত সমালোচনার মুখে পদত্যাগ করেছিলেন সেদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী নেলসন তাইশ।
দক্ষিণ আমেরিকার আরেক দেশ চিলি, সেখানেও করোনা হানা দিয়েছিল। জনসংখ্যার বিচারে বেশ ভালোই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এই ভাইরাসের প্রকোপে। প্রায় তিন লাখ মানুষ আক্রান্ত এবং ছয় হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে সেদেশে। চিলির স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাইমি মানালিচ পদত্যাগ করেছেন করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার ব্যর্থতা মাথায় নিয়ে। মানালিচ বলেছেন, করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে দেশের পক্ষে তিনি ছিলেন নেতা, যেহেতু এতগুলো মানুষের মৃত্যু তিনি ঠেকাতে পারেননি, কাজেই এই পদে থাকার নৈতিক অধিকার তার আর নেই।
করোনা মোকাবেলায় সবচেয়ে সফল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নিউজিল্যান্ড। সরকার এবং জনগনের যৌথ প্রচেষ্টায় ভাইরাসের ব্যাপ্তি রোধ করতে সক্ষম হয়েছে তারা, সেই কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্নের পাশাপাশি সেদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডেভিড ক্লার্কও পাবেন। কিন্ত আজ যখন নিউজিল্যান্ড করোনাকে বাই বাই বলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে, তখন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডেভিড ক্লার্ক। কেন জানেন?

নিউজিল্যান্ডে লকডাউন চলাকালে একদিন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়েছিলেন ডেভিড ক্লার্ক। সরকার যখন বারবার জনগনকে অনুরোধ করছে ঘরে থাকার জন্য, তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এমন প্রমোদ ভ্রমণ নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়েছিল। সমালোচনার মুখে ডেভিড ক্লার্ক তখনই পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্ত প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা তখন তাকে কাজ চালিয়ে যেতে বলেছিলেন, কারণ এই লড়াইতে ডেভিড ক্লার্ককে তার দরকার ছিল। এখন করোনার লড়াই শেষ, নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েছেন ক্লার্ক, সেটা গৃহীতও হয়েছে। আজ থেকে ডেভিড ক্লার্ক নিউজিল্যান্ডের 'সাবেক' স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
এত এত স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের কথায় মনে পড়লো, আমাদেরও তো একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী আছেন। করোনা আসার দুই মাস আগেই যিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, করোনা মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুত। সংক্রমণ শুরু হবার পর দেখা গেল হাসপাতালে অক্সিজেন নেই, ডাক্তারদের জন্য পিপিই নেই, এই নাকি আমাদের প্রস্তুতির নমুনা! আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী পিপিইকে উচ্চারণ করছেন পিপিপি, লাইভ ইন্টারভিউতে এসে বলছেন, ফার্মাসির গ্র্যাজুয়েটরা নাকি ফার্মেসিতে কাজ করে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবদান রাখতে পারেন!
চিকিৎসকদের সেবা সরঞ্জাম নিয়ে তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতিতে জড়িত থাকার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে, তিনি এরপরও পদ আঁকড়ে ধরে আছেন। উল্টো চিকিৎসকদের সংক্রমণের পেছনে ভুলভাবে পিপিই (তার ভাষায় পিপিপি) পরাকে দুষছেন। অর্থাৎ সুবে বাংলার ডাক্তার-নার্সদের এসে এখন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে শিখতে হবে কিভাবে পিপিই পরতে হয়! সংসদে তার পদত্যাগের দাবী উঠেছে, সেসবকে নাকচ করে দিয়ে তিনি পদ আঁকড়ে ধরে আছেন। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিবর্তে তিনি তার সমালোচকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসেছেন!

প্রতিদিন শত শত মানুষ অসুস্থ শরীর নিয়ে করোনা পরীক্ষা করার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছেন, কেউ কেউ সপ্তাহখানেক ঘুরেও টেস্ট করাতে পারছেন না, কেউবা টেস্ট করিয়ে দশদিন পরেও ফল হাতে পাচ্ছেন না। টেস্টের রেজাল্ট ছাড়া হাসপাতালে রোগী ভর্তি নিচ্ছে না, বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে মানুষ, চারপাশে প্রচণ্ড ম্যাসাকার একটা অবস্থা। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যে ভেঙে পড়েছে, সেটা দিনের আলোর মতো পরিস্কার। সেই ধ্বংসস্তুপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজের অবস্থানে অনড় আছেন, পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাকে অফিসে টেনে আনতে হচ্ছে, এমনই ভয়াবহ অবস্থা! অফিসে এসে তিনি আবার বলছেন, আমি যেখানে বসি সেটাই অফিস!
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এমন গর্বিত বয়ানে আমাদের হাসি আসে না এখন। যেমন দেশ, যেমন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, তেমনই যে তার স্বাস্থ্যমন্ত্রী হবেন, তাতে অবাক হবার কি আছে? আমরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগও চাই না। পদত্যাগের কালচার কি আমাদের দেশে আছে? মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে কে কবে নিজের ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে পদত্যাগ করেছিল এদেশে? নিউজিল্যান্ড-ব্রাজিল কিংবা চিলি-নেদারল্যান্ডের উদাহরণ টেনেও তাই আসলে হতাশ হওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। মুখে মুখেই আমরা নিউইয়র্ক-সিঙ্গাপুর-প্যারিস হয়ে যাই, বাস্তবে যে আমাদের অবস্থান যে আফ্রিকার নিম্ন আয়ের কোন দেশের চেয়ে ভালো কিছু নয়, সেটা করোনাভাইরাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে...
আরও পড়ুন-
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- https://www.egiyecholo.com/contributors/write-for-us