এক লাইনে হারশাদ মেহতাকে চোর, ঠগ, বাটপার বলে হিসেবের বাইরে ফেলে দেয়া যাবে। কিন্ত শেয়ার মার্কেটের এই অমিতাভ বচ্চনের গল্পটা জানলে, খানিকটা করুণাও জন্ম নেবে তার প্রতি। মনে হবে, হারশাদ যা করেছেন, সেসব তার পরিবারের জন্যেই করেছেন...

'হারশাদ শান্তিলাল মেহতা...'

এরপর আর কিছু না লিখতেও হয়তো চলে। কোনো এক আড্ডার মাঝখানে যদি দুম করে এই তিনটা শব্দ পরপর বলে ফেলি, খেল খতম। সব টপিক পাকিয়ে গুবলেট হয়ে একটাই টপিক হয়ে যাবে 'হারশাদ।' অবশ্য দুই-তিন মাস আগেও 'অক্টোপাস-পল' এর মত এমনভাবে হয়তো বলতে পারতাম না যে, সবাই-ই চিনবে হারশাদ মেহতা'কে। সনির টিভি সিরিজ 'স্ক্যাম ১৯৯২ঃ দ্য হারশাদ মেহতা স্টোরি' রিলিজ করার পর থেকে কী ভারত, কী পাকিস্তান, কী বাংলাদেশ... সবখানে ঢুকে গেলেন 'হারশাদ মেহতা।'

যেরকম ঠাসা মাংসের মতন লেয়ারড টিভি সিরিজ, যেরকম অসাধারণ কাস্ট আর সবচেয়ে বড় কথা যেরকম ইন্টারেস্টিং 'হারশাদ মেহতা'র গল্প, এই সিরিজ যে জমে ক্ষীর হয়ে যাবে, এটা জানাই ছিলো। এবং আমার এতক্ষণের শব্দব্যয় থেকে বোঝাই যাচ্ছে, আজকের কথাবার্তা হারশাদ মেহতাকে নিয়ে। শূন্য থেকে শুরু করে ইনফিনিটি'তে পৌঁছে আবার শূন্যে ফিরে আসার যে অবিস্মরণীয় উত্থান-পতনের গল্প তার, সে গল্প খোঁদ শেয়ার মার্কেটেরও আছে কী না, তা গবেষণার বিষয়। জোবার থেকে শুরু করে স্টক মার্কেটের অমিতাভ বচ্চন হয়ে সেখান থেকে 'দ্য বিগ বুল'... হারশাদ মেহতা'কে নিয়ে চাইলে 'গেম অব থ্রোন্স' এর মতন আট সিরিজের একটা এপিক বানানোও সম্ভব ছিলো।

'স্ক্যাম ১৯৯২ঃ দ্য হারশাদ মেহতা স্টোরি' সিরিজের পোস্টার! 

কলকাতার যারা সর্ষে ইলিশ, ভাপা-চিংড়ি আর দই-রসগোল্লা'খোর আদি-অকৃত্রিম বাঙ্গালী আছেন, তারা দুই শ্রেণির মানুষকে দেখতে পারেন না; মারোয়ারী ও গুজরাটি। এই দুইশ্রেণির মানুষ ব্যবসা করতে কলকাতায় এসে এখানকার বাঙ্গালীদেরই 'সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন' বানিয়ে  দিয়েছে। নিরীহ বাঙ্গালীদের যাপিত রাগ তাদের উপরেই। বেশ অনেকদিন ধরেই। মারোয়ারী ও গুজরাটিদের বিজনেস-সেন্স অসাধারণ এটা সবাই-ই জানেন। আমাদের 'শান্তিলাল মেহতা'ও ছিলেন গুজরাটি। এবং ব্যবসাকে তিনি  নিজের হাতের তালুর চেয়েও ভালো চিনতেন।  গুজরাটিদের নিয়ে তো রসিকতাই আছে- এরা মায়ের পেট থেকেই পড়ে হাতে একটা ক্যালকুলেটর নিয়ে; ব্যবসার সুবিধার জন্যে।

'হারশাদ মেহতা' ব্যবসা ভালো বুঝলেও ব্যবসা করে উঠতে পারছিলেন না। উত্তর মুম্বাইয়ের কান্দিভালি অথবা ভিলাইয়ের ঘিঞ্জি ঘরদুয়ার, যেখানে দুই কামড়ায় ঠাসাঠাসি করে পাঁচজন মানুষ, বাবার টেক্সটাইল ব্যবসার সামান্য উপার্জনের অবলম্বন... এভাবে দারিদ্রের সাথে মাখামাখি করতে কারই বা ভালো লাগে? কাহাতকই বা এ নির্যাতন সহ্য হয়? ক্রিকেট-পাগল মেহতা টুকটাক খেলাধুলা আর পড়াশোনা শেষে একের পর এক ছোটখাটো চাকরী করেই কাটাতে লাগলেন। আর অপেক্ষা করতে লাগলেন। কীসের? সুযোগের। বড় ধামাকার।

বিভিন্ন, বিচিত্র ছোটখাটো চাকরী করতে করতেই হারশাদ মেহতা শেয়ার মার্কেট নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ছোটভাই অশ্বিনের সাথে পরামর্শ করেন। চাকরী বাদ দিয়ে সে যাবে কী না এই কাজে। অশ্বিন সায় দেয় না। অশ্বিন যেন টেস্ট ম্যাচের রাহুল দ্রাবিড়। সেফ সাইডে খেলে উইকেট বাঁচাতেই সে বেশি মনোযোগী। ওদিকে হারশাদ, বীরেন্দ্র সেহওয়াগ। কীসের সেফ সাইড, কীসের কী! ডাউন দ্য উইকেটে এসে ছক্কা না মারলে কীই বা হলো! নিরাপদ বেতনের চাকরী ছেড়ে দিয়ে সে বের হয়ে আসে। নীল একটা কোট পড়ে ঝাঁপ দেয় হাঙ্গর, কামঠ, পিরানহা ভরা শেয়ার মার্কেটের সমুদ্রে৷ শেয়ার মার্কেটের এক এক্সপার্টের অধীনে (যাকে হারশাদ সহ বাকিরা ডাকতেন 'গুরু') 'জোবার' হিসেবে কাজ শুরু করেন। এবং খুব অল্পদিনের মধ্যেই শেয়ার মার্কেটের হালচাল আয়ত্ত হয়ে যায় হারশাদের। এরপরের দশ বছরের মধ্যে সে নিজেই হয়ে যান শেয়ার মার্কেটের কেউকেটা।

এতদিন ধরে যেসব মানুষ ছিলেন শেয়ার মার্কেটের হর্তাকর্তা, বিধাতা... তাদের একধাক্কায় ফেলে দেন হুট করেই উদয় হওয়া এই আউটসাইডার। হয়ে যান 'স্টক মার্কেটের অমিতাভ বচ্চন।' বিজনেস টুডে'র মত বিখ্যাত ম্যাগাজিনগুলোও তাকে কাভার করা শুরু করে নিয়মিত। তিনি যে সিস্টেমের মাধ্যমে এভাবে রাতারাতি সফল হচ্ছিলেন, সেটাকে আসলে 'লুপ অব দ্য সিস্টেম'কে ব্যবহারও বলা যায়। সব মার্কেটের মতন শেয়ার মার্কেটেরও কিছু 'উইক লিংক' ছিলো, যেগুলোর পূর্ন সদ্ব্যবহার করে, সেগুলোকে মই বানিয়েই হারশাদ মেহতার এভাবে ক্রমশ সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়া সম্ভব হয়। নব্বইয়ের দশকের সেই টালমাটাল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পুরোপুরি সুযোগটিই নিয়েছিলেন দালাল স্ট্রিটের এই চৌকষ নেকড়ে!

তবে সুখের সময় নিরবিচ্ছিন্ন হয় না। হারশাদ মেহতা'র 'সাফল্যের মই' মাঝপথে এসে ভেঙ্গে যায়। শেয়ার মার্কেট ক্রাশ করে। হারশাদ মেহতা'র অনেক ইনভেস্ট, টাকাপয়সা চোখের নিমেষে 'ধুলো' হয়ে উড়ে মিশে দালাল স্ট্রীটের আশেপাশে। এই আকস্মিক ধাক্কা মেহতা পরিবারের সবাই মোটামুটি সামলালেও পারলেননা হারশাদ মেহতা'র বাবা৷ নিদ্রার মধ্যেই চিরনিদ্রায় চলে গেলেন তিনি।

একটা জিনিস জানিয়ে রাখি, শেয়ার মার্কেটে 'সুনাম' এর বড্ড চাহিদা। শেয়ার মার্কেটে স্মরণকালের ভয়াবহ ক্রাশ এর ফলে হারশাদ মেহতা'র নাম খারাপ হয়ে যায়। এই ক্রাশের পেছনে হারশাদ মেহতারও পরোক্ষ ভূমিকা ছিলো বেশ। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে শেয়ার মার্কেটে সুনাম কমে যায় মিঃ মেহতার। সরাসরি শেয়ার মার্কেটে বিজনেস করা বন্ধ হয় তার। হারশাদ তখন শেয়ার মার্কেটে যারা ইনভেস্ট করে, তাদের কনসাল্ট্যান্ট হিসেবে কাজ শুরু করলেন। 'গ্রোমোর' নামে বিজনেস ফার্ম খুললেন৷ পঙ্গপালের মতন ইনভেস্টররা আসতে লাগলেন। তাদের সাহায্য করা, তাদের থেকে টাকা নিয়ে বেনামে তিনিও শেয়ার মার্কেটে বিজনেস করতে লাগলেন... হারশাদ মেহতা আবার চলে এলেন লাইমলাইটে। যেন লাঞ্চ ব্রেক এর পর ফুরফুরে হাওয়ায় আবার ক্রিজে এসে দাঁড়ালেন অপরাজিত ব্যাটসম্যান৷

এবারে আর ঠুকঠাক না৷ বোলারের প্রত্যেকটা বল উড়িয়ে মেরে গ্যালারিতে পাঠানোর তান্ডব শুরু করলেন হারশাদ মেহতা। তার নাম হয়ে গেলো 'দ্য বিগ বুল।' পত্রপত্রিকায় সয়লাব হয়ে গেলো তার ছবি, সাক্ষাৎকার, সাকসেস-স্টোরি। শেয়ার মার্কেটের সব রাঘববোয়ালেরা একাট্টা হয়ে নামাতে চাইলেন হারশাদ কে। কিন্তু হারশাদের লেভেল তখন আর এদের ধারেকাছেও নেই। হারশাদ তখন 'আপার লেভেল কা খিলাড়ি!' এসময়ে মিডিয়াতে হারশাদের বিলাসবহুল জীবনযাপনেরও অনেক খবর আসা শুরু হলো। মুম্বাইয়ের বিলাসবহুল জায়গাতে সুইমিং পুল আর গলফ কোর্সসহ পনেরো হাজার স্কয়ারফিটের বাড়ি, অজস্র সব গাড়ি; টয়োটা করোলা, টয়োটা সেরা, লেক্সাস স্টার্লেট... (এ গাড়ির অন্য গল্প আছে, অন্য কোনোদিন বলবো) সবকিছু নিয়ে প্রচুর গল্প চাউর হচ্ছিলো আশেপাশে।

ঠিক এসময়েই আরেকজন মানুষ পর্দার পেছনে থেকে কাজ করা শুরু করলেন হারশাদ মেহতা'কে নিয়ে। 'দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া'তে সদ্য যুক্ত হওয়া সাংবাদিক সুচেতা;  সুচেতা দালাল। তিনি প্রথম দিকেই আগ্রহী হয়ে উঠলেন হারশাদ মেহতা'কে নিয়ে। হারশাদের উপর গবেষণা করতে গিয়ে তিনি জানতে পারলেন হারশাদের অদ্ভুত সব ধোঁকাবাজির গল্প। ততদিনে হারশাদ শেয়ার মার্কেট থেকে চোখ সরিয়ে মনোযোগী হয়েছে ভারতের মানি মার্কেট এর দিকে। যে ব্যবসা একচেটিয়াভাবে বিদেশি কিছু ব্যাংক ও পৈত্রিকসূত্রে দখলদারিত্ব পাওয়া কিছু বিজনেস-ম্যাগনেটের দখলে। হারশাদ খুব অল্পদিনে এখানেও জাঁকিয়ে বসেছেন। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ব্যাঙ্কে ফ্রড করে টাকা কামাচ্ছেন।

সুচেতা এরকমই কিছু 'ফ্রড' অথবা 'স্ক্যাম' এর সংবাদ পেলেন, তার খাস কিছু ইনফর্মার এর মাধ্যকে। খবর ছাপতে চাইলেন হারশাদকে নিয়ে। খবরটাও বেশ বড়। হারশাদ মেহতা 'স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া' থেকে পাঁচশো কোটি টাকা নিয়ে গিয়েছেন, সে টাকা অনেক নাটকীয়তার পরে ফেরত দিয়েছেন তিনি। এটা নিয়েই লিখতে চাইছিলেন সুচেতা। কিন্তু এই নিউজটা লিক যে করেছে, তার কাছে কংক্রিট কোনো প্রমাণ নেই। আর জাতীয় এক পত্রিকায় এরকম 'বিগশট' কাউকে নিয়ে তো প্রমান ছাড়া কিছু লেখা যাবে না। সুচেতা এরপরেও নিজের চাকরী হারানোর রিস্ক নিয়ে খবরটা ছাপানোর ব্যবস্থা করলেন 'দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া' থেকে। এরপরে আরো কিছু সংবাদপত্রও সাহস পেয়ে খবর ছাপলো হারশাদ মেহতা'র বিরুদ্ধে। হারশাদ মেহতা খানিকটা ব্যাকফুটে চলে এলেন।

সুচেতা দালাল- যিনিই প্রথম লিখেছিলেন হারশাদ মেহতাকে নিয়ে! 

সিবিআই এর রেইড হলো। অফিসে। বাড়িতে। দফায় দফায় জেরা করা হলো হারশাদকে। তার ভাইকে। সব সম্পত্তি 'ফ্রিজ' করে দেয়া হলো। অনেকগুলো মামলায় জেলেও নেয়া হলো তাকে। জেল থেকে যখন একবার জামিনে বের হলেন, বোমা ফাটালেন। জানালেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট পি.ভি নরশিমহো রায়'কে তিনি এক কোটি রূপি ডোনেশন দিয়েছিলেন, তাকে স্ক্যান্ডাল মামলা থেকে বাঁচানোর জন্যে। সরকারের রোষানলে পড়লেন। এরপর আবার তাকে জেলে নিয়ে যাওয়া হলো। জেলে থাকা অবস্থাতেই মাত্র ৪৭ বছর বয়সে, ২০০১ এর ৩১শে ডিসেম্বর তিনি 'হার্ট এ্যাটাক' করে মারা যান। তিনি যখন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করছেন, তখনও তার বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন কোর্টে  ঝুলে রয়েছে অজস্র মামলা।

জীবনের শেষসময়টা পুলিশের ধ্বস্তাধস্তিতেই কেটেছে তার! 

হারশাদ মেহতার জীবনগল্প থেকে একটা জিনিস তো স্পষ্ট- তিনি ভণ্ড ছিলেন, প্রতারক ছিলেন, শঠ ছিলেন। আবার সে সাথে একটা জিনিসও দেখা যেতে পারে, যা করেছিলেন পরিবারের জন্যেই করেছিলেন। জীবনে কোনোদিন মদ খাননি, কোনোদিন নিজের স্ত্রী'কে ছাড়া অন্য কোনো মহিলার দিকেও তাকাননি... যেটা করেছেন, পরিবারকে একটা 'শক্তপোক্ত ভিত্তি' দিতে চেয়েছিলেন। অনেকটা 'ব্রেকিং ব্যাড' এর হাইজেনবার্গের মতন। কিন্তু পরিবারের জন্যে সেই 'শক্তপোক্ত ভিত্তি' এনে দিতে গিয়ে কখন যে স্বপ্নের চাকাই ব্রেকফেল হয়ে গিয়েছে, টের পাননি আর। অনুপম রায়ের গানের লাইনের মতন 'আঙ্গুলের ফাঁকে আমি কই?' খুঁজতে গিয়ে যখন হারশাদ নিজের জীবনের দিকে তাকালেন, তখন সে জীবনটিই হয়ে গিয়েছে উদ্বাস্তু।

এ্যান্ড দিস ইজ দ্য স্টোরি; দ্য মেলানকোলিক  হারশাদ মেহতা স্টোরি!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা