হামজা বেনদেলাজ: দুর্ধর্ষ হ্যাকার, নাকি রবিনহুড?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ভুক্তভোগীদের কাছে হামজা বেনদেলাজ একজন অপরাধী হলেও, তার ভক্তদের কাছে তিনি হচ্ছেন ত্রাতা। তবে এই ডানপিটে হ্যাকার চোখে আঙুল দিয়ে একটা ব্যাপার পরিস্কার করে দিয়েছে- চাইলে নিজের অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে প্রতিবাদটা অন্তত করা যায়, সেটা সফল হোক বা না হোক।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বেশ ভাইরাল একটা গুজব প্রচলিত আছে। এক হ্যাকার নাকি আমেরিকার ২১৭টা ব্যাংক হ্যাক করে ৪ হাজার মিলিয়ন ডলার লুট করে সেই অর্থ ফিলিস্তিন এবং আফ্রিকার গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছে। ফলে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। এবং সে হাসতে হাসতে নিজের জীবন দিয়ে গেছে।
ঠিক এভাবে বর্ণনা দিয়ে, তার সাথে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝোলানোর একটা ছবিও ঘুরতে দেখা যায় অনলাইনে। যেটা মূলত একটা গুজব। তবে এটা কী পুরোটাই মিথ? নাকি এর পেছনেও রয়েছে কিছু বাস্তবতা? এই ফিচারের লক্ষই হচ্ছে সেটা বিশ্লেষণ করা।
প্রথমেই, একটা ব্যাপার পরিস্কার হওয়া দরকার। সেটা হচ্ছে ঐ গুজবে ফাঁসির যে ছবিটা ব্যবহার করা হয়েছে সেটা ২০০৭ সালের ইরানের ঘটনা। লোকটার নাম মাজিদ কাভোসিফার। তিনি তার ভাগ্নের সাথে মিলে ইরানের বিচারপতি মাসুদ আহমাদিকে খুন করেন। যার ফলে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। ফাঁসিতে ঝোলানোর সময় তিনি বেশ হাসিখুশি ছিলেন। আর সেই ইমোশোনাল মুহূর্তের ছবিটাকেই হ্যাকিং এর ঘটনার সাথে মিলিয়ে ঐতিহাসিক এক গুজবের সৃষ্টি হয়।
ফিরছি হ্যাকিং প্রসঙ্গে, তাহলে কি হ্যাকিং এর ঘটনাটাও গুজব? না। এর পেছনে রয়েছে বেশ চমকপ্রদ এক ঘটনা। সেটা জানতে হলে প্রথমে পরিচিত হতে হবে হামজা বেনদেলাজ এর সাথে।
কে এই হামজা বেনদেলাজ?
তার পুরো নাম হামজা বেনদেলাজ নিশান্থ। ১৯৮৮ সালে জন্ম নেয়া আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত হামজা বেনদেলাজ একজন হ্যাকার। হ্যাকিং (অনুমতি ছাড়া প্রবেশ) জগতে তিনি বিএক্স১ (Bx1) নামে পরিচিত। বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ট্রোজান হর্স ভাইরাস ‘স্পাইআই’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা তিনি। রাশিয়ার হ্যাকার অ্যালেক্সান্ডার আন্দ্রেভিচ পানিন হচ্ছেন এই স্পাইআই ভাইরাসের মূল প্রোগ্রামার। বেনদেলাজ ছিলেন মূলত তার ঘনিষ্ঠ একজন সহযোগী। তারা দুইজনে মিলে স্পাইআই এর প্রচার ও উন্নীতকরণের কাজগুলো তদারকি করতেন।
স্পাইআই হচ্ছে মূলত একটি সুপরিকল্পিত কম্পিউটার প্রোগ্রাম। যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিভিন্ন গোপন এবং অর্থসংক্রান্ত তথ্য চুরি করতে পারে। এই ধরণের তথ্যগুলোর মধ্য অনলাইন ব্যাংকিংয়ের পরিচয়পত্র, ক্রেডিট কার্ডের তথ্য, ইউজার নেম, পাসওয়ার্ড, পিন নাম্বার সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি রয়েছে।
স্পাইআই নামক এই ভাইরাসটি যে কম্পিউটারকে সংক্রমিত করে, সেটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয় হ্যাকারের হাতে। পরবর্তীতে হ্যাকার তার ইচ্ছেমতো নির্দেশনা দিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ বা তথ্য সহজেই লুট করে নিতে পারে।
বেনদেলাজ বড় হয়েছিলেন আলজেরিয়ার ওজু নামক স্থানে। হ্যাকিং শুরুর পরও প্রথমে তার পরিচয় কেউ পায়নি। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্জিত সব অর্থ তিনি ফিলিস্তিন এবং আফ্রিকার খাদ্যাভাব মেটাতে ব্যয় করতেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম, বিশেষ করে আল জাজিরার রিপোর্টে জানা যায়। তবে আদালতের মূল নথিপত্রে এই তথ্যের সত্যতা নেই।
'স্পাইআই' এর মাধ্যমে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিলো আসলে?
এই স্পাইআই ব্যবহার করেই হামজা বেনদেলাজ ২০০ আমেরিকান ব্যাংক এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এর অর্থ লুট করতে সক্ষম হন। এবং এই ভাইরাসের প্রতিটা কপি ১০ হাজার ডলারে বিক্রি করা হতো। ডার্ক ওয়েবের অন্যান্য হ্যাকাররাই এর মূল ক্রেতা ছিলো। ভাইরাসটি বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৫০ জন ক্রেতার কাছে বিক্রি করা হয়েছে বলেও জানা যায়।
এখানে উল্লেখ্য, ধরা খাওয়ার আগ পর্যন্ত বৈশ্বিক এক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিভিন্ন দেশের প্রায় ৫০ মিলিয়ন কম্পিউটার স্পাইআই ভাইরাসের আক্রমণের শিকার হয়েছে। যার ফলে স্পাইআই এর মাধ্যমে সরাসরি ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার। তবে আপেক্ষিকভাবে এই ক্ষতির পরিমাণ নাকি ৯০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। স্পাইআই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে পরিত্রাণের জন্য আক্রান্ত কম্পিউটার ও কোম্পানি মালিকদের সম্মিলিতভাবে খরচ করতে হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার।
যেভাবে আটক হলেন হামজা বেনদেলাজ
স্পাইআই ভাইরাসের একটি কপি আমেরিকান ছদ্মবেশী অফিসারের কাছে বিক্রি করতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত হন তিনি। পরে তাকে ২০১৩ সালে থাইল্যান্ডের এয়ারপোর্ট থেকে গ্রেপ্তার করে মার্কিন প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এখানে উল্লেখ্য, বেনদেলাজ আটক হবার পরের মাসেই আমেরিকার আটলান্টা বিমানবন্দরে ট্রাঞ্জিট নেবার পথে গ্রেফতার হন স্পাইআই এর মূল প্রোগ্রামার অ্যালেক্সান্ডার আন্দ্রেভিচ পানিন।
তাদের বিরুদ্ধে সাইবার প্রতারণা এবং ব্যাংক জালিয়াতির একাধিক অভিযোগ আনা হয়। তার পরের বছর, ২০১৪ সালে পানিন তার বিরুদ্ধে আরোপিত সকল অভিযোগ স্বীকার করে নেন। সেই পথ ধরে, ২০১৫ সালে বেনদেলাজও সব অভিযোগ স্বীকার করে নেন।
অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় পানিনকে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ কর্তৃক শাস্তি হিসেবে সাড়ে ৯ বছর কারাবাস প্রদান করা হয় এবং হামযা বেনদেলাজকে ১৫ বছরের কারাবাস প্রদান করা হয়। সেই থেকে আন্ডারওয়ার্ল্ডে এই দুইজনকে কিংবদন্তি মানা হয়।
বেনদেলাজের বিচারের সময়েই ঐ গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, বেনদেলাজকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। যদিও বাস্তবে তেমন কিছুই হয়নি। গ্রেপ্তার হওয়া থেকে শুরু করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েও সর্বদা হাসিখুশি দেখা গেছে হামজা বেনদেলাজকে। হ্যাকিংয়ের জন্য কখনোই তাকে দুঃখিত বা অনুতপ্ত হতে দেখা যায়নি। এ কারণে তাকে হ্যাপি হ্যাকারও বলা হয়।
হামজা বেনদেলাজের এই হাসি আর মাজিদ কাভোসিফার ফাঁসিকে মিলিয়ে দারুণ এক গুজবের সৃষ্টি হয়। তাই অনেকেই সে গুজবে সুর মিলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবাদ করতে থাকেন। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে জেল খাটছেন বেনদেলাজ। তাকে মুক্ত করার জন্য বিভিন্ন হ্যাকার গ্রুপ ও সংগঠন প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে। এর মধ্যে অনলাইনে #FreeHamzaBendellaj এবং #FreePalestine হ্যাশট্যাগ অন্যতম।
শুধুই কি হ্যাকার? নাকি একালের রবিহুড?
শেরউড জঙ্গলের সেই রবিনহুডের নাম আমরা সবাই কমবেশি শুনেছি। চলচ্চিত্র, টিভি সিরিয়াল কিংবা গল্পের বইয়ের মাধ্যমে রবিনহুডের কার্যকলাপ সম্পর্কে জেনেছি। তেমনি হামজা বেনদেলাজকেও বলা হচ্ছে আধুনিক সময়ের গরিবের রবিনহুড। ধনীদের সম্পদ তিনি লুট করে বিলিয়েছেন গরীবদের মাঝে, ঠিক যেমনটা রবিনহুড করতেন। তবে এটার কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণাদি নেই। আল-জাজিরা তাদের প্রতিবেদনেও ‘জনশ্রুতি আছে’ বলেই উল্লেখ করেছে।
ভুক্তভোগীদের কাছে হামজা বেনদেলাজ একজন অপরাধী হলেও, তার ভক্তদের কাছে তিনি হচ্ছেন ত্রাতা। তবে এই ডানপিটে হ্যাকার চোখে আঙুল দিয়ে একটা ব্যাপার পরিস্কার করে দিয়েছে- চাইলে নিজের অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে প্রতিবাদটা অন্তত করা যায়, সেটা সফল হোক বা না হোক।
আরো পড়ুন-