এদেশের মানুষ ধর্ষিতার চেয়ে ধর্ষকের পাশে দাঁড়াতেই পছন্দ করে বেশি। তাই কনস্টেবল হালিমারা গায়ে আগুন লাগিয়ে মরে গেলেও, ধর্ষক মিজানুল, মজনু বা দিহানের পক্ষে এই বিপুল জনমত দেখে এখন আর অবাক লাগে না। ইতর আর অমানুষে ভর্তি এই দেশে তো এরকমটাই হবার কথা ছিল...
আপনাদেরকে হালিমা বেগমের গল্পটা বলি। পঁচিশ বছর বয়সী এই ভদ্রমহিলা পুলিশের কনস্টেবল হিসেবে চাকরি করতেন। ময়মনসিংহের গৌরিপুর থানায় ছিল তার পোস্টিং। চার বছর আগের কথা, ১৭ই মার্চ, ২০১৭ সাল। সারাদেশে সেদিন বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে। সেদিন থানার ভেতর এসআই মো. মিজানুল ইসলাম ধর্ষণ করেছিলেন হালিমাকে।
আগে থেকেই তাকে উত্যক্ত করতেন মিজানুল। এক নারী ইয়াবা পাচারকারীকে গ্রেপ্তারের জন্য লেডিস কনস্টেবল লাগবে- এই কথা বলে হালিমাকে থানায় আসতে বলেছিলেন মিজানুল। কিন্ত থানায় গিয়ে মিজানুলের হাতে ধর্ষণের শিকার হন হালিমা। পরদিন তিনি মিজানুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চাইলে সেই অভিযোগ গ্রহণ করেননি গৌরিপুর থানার ওসি দেলোয়ার হোসেন, উল্টো হালিমাকেই অপবাদ দেয়া হয়, মিজানুলের সঙ্গে নাকি তার অবৈধ সম্পর্ক আছে, তিনি নাটক করছেন, এসব বলে। মিজানুলের তিন বন্ধু এসআই রিপন, এসআই খালেকুজ্জামান, এসআই হাসান এবং তার সঙ্গীরা ঘটনা শুনে হালিমাকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করেন।
ধর্ষণের পর বিচার পাননি, চোখের সামনে ঘুরে বেড়াতে দেখছেন ধর্ষককে, উল্টো নিজের কপালে জুটেছে অপবাদ- এভাবে বারবার অপদস্থ হওয়াটা মেনে নিতে পারেননি কনস্টেবল হালিমা। এপ্রিলের দুই তারিখে তিনি গৌরীপুর থানার ব্যারাকে নিজ কক্ষে দরজা বন্ধ করে গায়ে কোরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। সহকর্মীরা তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পাঠায়। সেখান থেকে ঢাকা নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। পরদিন আত্মহত্যায় প্ররোচনা ও ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন হালিমার বাবা হেলাল উদ্দিন। এসআই মিজানুলকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।
মৃত্যুর আগে হালিমা নিজের ডায়েরিতে স্পষ্ট করে লিখে গেছেন, তার মৃত্যুর জন্য এসআই মিজানুল ইসলাম দায়ী। ধর্ষণের অভিযোগ পেয়েও থানার ওসি যে কোন ব্যবস্থা নেননি, উল্টো হালিমাকেই গালমন্দ শুনতে হয়েছে- সেসবও লেখা ছিল ডায়েরিতে। বিচার না পেয়ে, প্রতারিত হয়ে মানবজাতির প্রতি তীব্র অভিমান নিয়ে হালিমা নিজেকে শেষ করে দিয়েছেন, কিন্ত তাতেও তো কোন লাভ হয়নি। বিচার কী হালিমা মরে গিয়েও আদায় করতে পেরেছেন?
আপনি যদি গুগলে সার্চ করেন হালিমার কেসের অগ্রগতি কি, মামলার কি অবস্থা- কোনো আপডেট খুঁজে পাবেন না। ধর্ষণের অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, সেই মিজানুর এখন কারাগারে আছেন, নাকি জামিনে বেরিয়েছেন, সেটারও কোন আপডেট নেই। হালিমা যখন নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করলেন, তখন একটা চাঞ্চল্য ছিল চারপাশে, মিডিয়াও মনোযোগ দিয়েছিল। কিন্ত সময়ের সাথে সাথে আগ্রিহ ফুরিয়েছে সবার, নিত্যনতুন ইস্যুর ভীড়ে হারিয়ে গেছে হালিমার ঘটনাটা। মামলাটা নিয়েও কোন প্রতিবেদন নেই কোথাও।
আপনারা যারা ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাককে দায়ী করেন, যারা ধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগীর দোষ খুঁজে পান, তারা একটু বলে যান, এই ঘটনায় হালিমা বেগমের অপরাধটা কোথায়? ধর্ষণের জন্য ধর্ষকের বিকৃত মানসিকতা আর ক্ষমতার দম্ভ দায়ী, বিচারহীনতার সংস্কৃতি দায়ী- সেটারই একটা নিদর্শন হয়ে আছে হালিমা বেগমের ঘটনাটা। যে কারনে পুলিশ কনস্টেবল হয়েও, নিজের থানার ভেতর ধর্ষণের শিকার হয়েও তিনি বিচার পাননি, তাকে গায়ে কেরোসিন ঢেলে জানান দিতে হয়েছে যে, তার সঙ্গে অন্যায় হয়েছিল।
ধর্ষক মিজানুল ইসলাম ক্ষমতাবলে হালিমার চেয়ে ওপরে ছিলেন, সবকিছু ধামাচাপা দিয়ে ম্যানেজ করার মতো সক্ষমতা তার ছিল, সেটা তিনি করেও ফেলেছিলেন। আর তাই বিচার তো দূরের কথা, বিচারের আশ্বাসটাও না পেয়ে, উল্টো গালমন্দ শুনে ক্ষোভে, অভিমানে, অপমান সইতে না পেরে হালিমা নিজেকে শেষ করে দেয়ার পথ বেছে নিয়েছিলেন। সব আত্মহত্যার পেছনেই নাকি এক বা একাধিক খুনী লুকিয়ে থাকে। হালিমার এই আত্মহননের পেছনের খুনিটা ছিলেন মিজানুল, তাকে সঙ্গ দিয়েছেন থানার ওসি, মিজানুলের অন্যান্য সহকর্মীরা।
মিজানুল এখন জেলে আছেন কিনা, সেই খোঁজ কেউ রাখেনি। যে ওসি মিজানুলকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধেও কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। মিজানুলের যেসব সহকর্মীরা হালিমাকে ঘটনার পর হালিমার পাশে না দাঁড়িয়ে উল্টো তাকে উত্যক্ত করেছিলেন, অপবাদ দিয়েছিলেন- তারাও মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যে দেশে ধর্ষিতাকে বিচার না পেয়ে আত্মহত্যা করতে হয়, আর ধর্ষক এবং পটেনশিয়াল রেপিস্টরা ঘুরে বেড়ায় মুক্ত বাতাসে- সেই দেশে ধর্ষণের বিচার চাওয়া ব্যাপারটাই কৌতুক মনে হয়। এদেশের মানুষ ধর্ষিতার চেয়ে ধর্ষকের পাশে দাঁড়াতেই পছন্দ করে বেশি। কাজেই ধর্ষক মজনু বা দিহানের পক্ষে এই বিপুল জনমত দেখে এখন আর অবাক লাগে না। ইতর আর অমানুষে ভর্তি এই দেশে তো এরকমটাই হবার কথা ছিল...