আন্ডারওয়ার্ল্ড শব্দটার মধ্যেই ভয়ের একটা হিমশীতল চোরাস্রোত মিশে আছে কোথায় যেন। তবে আন্ডারওয়ার্ল্ড শব্দের ব্যাপ্তি যাদের কাছে হলিউড/বলিউডের সাজানো চিত্রনাট্য, তারা শুধু সিনেমার রোমাঞ্চটাই অনুভব করতে পারবেন বড়জোর। এই জগতের বিশালতা, হিংস্র নৃশংসতা কিংবা পদে পদে মৃত্যুর ভয়াল থাবা তাদের চোখে পড়বে না সেভাবে।

শত কোটি মানুষের দেশ ভারতে আন্ডারওয়ার্ল্ডে মাফিয়াদের পথচলা সেই পঞ্চাশ-ষাটের দশক থেকেই, বিস্ময়ের ব্যাপার এটাই যে, হিন্দুপ্রধান এই দেশটির অপরাধজগতের হর্তাকর্তার আসনে বরাবর মুসলমানেরাই ছিলেন, সে মাস্তান হায়দার মির্জা থেকে শুরু করে দাউদ ইব্রাহিম কিংবা আজকের ছোটা শাকিল- তালিকাটা ক্রমশ দীর্ঘই হচ্ছে।

মাফিয়া বা গ্যাংস্টার মানেই রক্তের হোলিখেলা, ক্ষমতার শীর্ষে ওঠার দ্বন্দ্বে অন্যকে পরপারের রাস্তা দেখিয়ে দেয়া। তবে ভারতের ইতিহাসে এমনও মাফিয়া ডন এসেছেন, যিনি খুনোখুনি জিনিসটাই পছন্দ করতেন না। নাম তার সুলতান মির্জা, তবে হাজী মাস্তান হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছেন বেশী।

মিলন লুথারিয়া পরিচালিত বলিউডি সিনেমা ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন মুম্বাই যারা দেখেছেন, তাদের কাছে সুলতান মির্জা নামটা অপরিচিত নয়। অজয় দেবগন অভিনয় করেছিলেন ভারতের আন্ডারওয়ার্ল্ডের প্রথম মাফিয়া সুপারস্টারের ভূমিকায়। তবে সেলুলয়েডে তো আর পুরো সত্যিটা তুলে ধরা যায় না, সেখানে অর্ধেক বাস্তবতার সঙ্গে অর্ধেক কল্পনাও মেশাতে হয় বৈকি! 

অজয় দেবগন সুলতান মির্জা'র চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন

১৯২৬ সালের ১লা মার্চ তামিলনাড়ুতে জন্ম, পরিবারের আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। দিন আনি দিন খাই অবস্থাটাও ছিল না একটা সময়ে। ১৯৩৪ কৃষক পিতা হায়দার মির্জা কাজের সন্ধানে বোম্বে পাড়ি জমান, তার সঙ্গে চলে এলেন ছোট্ট সুলতানও। একটা সাইকেল গ্যারেজ খুলে কাজ শুরু করলেন বাপ-বেটা। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সুলতান ছুটে যেতেন বড় রাস্তায়, ঝাঁ চকচকে গাড়িগুলোর দিকে মোহাবিষ্ট নয়নে তাকিয়ে থাকতো সে।

বোম্বের অভিজাতপাড়া দিয়ে হেঁটে যাবার সময় বিলাসবহুল বাংলো দেখে হা করে চেয়ে থাকতো সুলতান, দুচোখের পাতায় তখন অজস্র স্বপ্নের ওড়াউড়ি! তবে স্বপ্ন পূরণের জন্যে বাঁকা রাস্তাটাই বেছে নিলো সুলতান। দশ বছর বোম্বেতে কাটিয়েও তেমন কোনো গতি করতে পারলো না সে। বোম্বে ডকে মাল ওঠানামার কাজ দেখভাল করতো তখন সুলতান, সেখানেই চোরাকারবারী কাজকর্মের হাতেখড়ি হলো তার।

বেআইনী পণ্য, মাদক কিংবা স্বর্ণের বারগুলো জলপথে আসতো বোম্বে পোর্টে, সুলতানের হাত ধরে বের হতো বন্দর থেকে, ছড়িয়ে পড়তো সারা ভারতে। পঞ্চাশের দশকে বোম্বে ডকের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠলো সুলতান, তখনই তার পরিচয় হলো গুজরাটের আরেক কুখ্যাত চোরাকারবারী এবং সন্ত্রাসী শুকুর নারায়ণ বখীর সঙ্গে।

বন্ধুত্ব হলো দুজনের, কাজ শুরু করলো একসঙ্গে। সেই সময়ে স্বর্নের বিস্কুট, ফিলিপস ট্রানজিস্টর এবং বিদেশী ঘড়ির দারুণ চাহিদা ছিল ভারতে, শেষের দুটি পণ্য বন্দর থেকে ট্যাক্স দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে প্রচুর খরচ পড়তো। আর তাই বিনা ট্যাক্সে ব্যবসা করে ফুলে-ফেঁপে উঠলো সুলতান মির্জা। টাকার পাহাড় গড়ে উঠলো তার।

টাকার হাত ধরে প্রভাব প্রতিপত্তিও আসে, সেটাও বাগিয়ে নিলো সুলতান মির্জা। তবে চোরাচালান ছাড়া অপরাধ জগতের অন্যকোন রাস্তায় তেমন আগ্রহ ছিল না তার, খুনোখুনী মোটেও পছন্দ করতো না সে। এ কারণে অপরাধীদের জগতেও একটা সম্মান বজায় ছিল তার জন্যে, সবাই জানতো সুলতান মির্জা হচ্ছে মন্দের ভালো। তার মূল ব্যবসাটা ছিল চোরাইপথে অর্জিত টাকা ব্যবসায় খাটিয়ে সেগুলোকে বৈধ করা। এজন্যে বোম্বে জুড়ে প্রায় সব ব্যবসাতেই টাকা ঢেলেছিল সে, রিয়াল এস্টেট ব্যবসা থেকে রাজনীতি- সব জায়গাতেই ছিল তার অবাধ বিচরণ।

হাজী মাস্তান

সুলতান মির্জা নামটা তখন ধূসর অতীত, সবাই তাকে চেনে হাজী মাস্তান নামে। সত্তরের দশকে বলিউডের দিকে নজর গেল তার। হাজী মাস্তান বুঝে গিয়েছিলেন, বলিউড মানেই কাঁচা টাকার ব্যবসা, অবৈধ অর্থগুলোকে বৈধ করার সবচেয়ে বড় রাস্তার মোড়টা এখানে, এই ফিল্মি দুনিয়াতেই। সিনেমায় লগ্নি করলে কেউ অর্থের যোগান নিয়ে কৈফিয়ত চাইতে আসবে না, অতএব ঢালো পয়সা!

নাম-যশ ততদিনে ভালোই হয়েছে হাজী মাস্তানের, বলিউডের সুবাদে সুনামটাও বগলদাবা করা শুরু হলো। দিলীপ কুমার, রাজ কাপুর, ফিরোজ খান, অমিতাভ বচ্চনদের মতো সুপারস্টারদের সঙ্গে ওঠাবসা শুরু হলো নিয়মিতভাবে। বিয়েও করলেন বলিউডেই, সোনা নামে এক অভিনেত্রীকে ভালোবেসে সংসার পেতেছিলেন। তার কয়েকটি সিনেমা প্রযোজনাও করেছিলেন হাজী মাস্তান। বোম্বের অপরাধ জগতের লোকজন দারুণ সম্মান করতো হাজী মাস্তানকে, অপরাধীদের মধ্যেও তার স্বচ্ছ ইমেজটাই ছিল এর অন্যতম কারণ।

ভারতের আন্ডারগ্রাউন্ড তখন নানা দল উপদলে বিভক্ত, তাদের নিজেদের মধ্যেকার ঝামেলা মেটানোর জন্যে সবাই হাজির হতো হাজী মাস্তানের কাছে। কথিত আছে, পাঠান ও কাসকার ভাইদের মধ্যেকার বিবাদও তিনিই মিটিয়ে দিয়েছিলেন। সত্তরের দশকের শেষ দিকে ‘ডেইলি রাজদরে’র সম্পাদক ইকবাল নাটিককে খুন করে হাজী মাস্তানের এক সাগরেদ সৈয়দ বাটলা। ইকবালের এক বন্ধু নিজেও ছিল মাস্তানের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা গুন্ডা। সে বিচার চাইতে গেল মাস্তানের কাছে, হাজী মাস্তান বাটলাকে একটা থাপ্পড় দিয়েই বিচার সেরে ফেললেন। সেটা পছন্দ হলো না খুন হওয়া ইকবালের সেই বন্ধুর। ১৯৮০ সালে বাটলাকে খুন করে বন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেয় সে। এই ঘটনা তাকে বোম্বের আন্ডারগ্রাউন্ডে জনপ্রিয় করে তোলে দারুণভাবে। এই তরুণের নাম দাউদ ইব্রাহীম কাসকার, পুরো বিশ্ব যাকে ডন দাউদ ইব্রাহিম নামেই চেনে। সে অন্য গল্প, আজ হাজী মাস্তানের গল্পেই থাকি।

১৯৭৫ সালে জরুরী অবস্থা জারি হলে হাজী মাস্তানকে আটক করে জেলে নেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে নিজের মুক্তির বিনিময়ে বিশাল অঙ্কের টাকা দিতে চেয়েছিলেন হাজী মাস্তান, কিন্ত কাজ হয়নি তাতে। আঠারো মাস জেল খেটে যখন বেরিয়ে এলেন, তখন তিনি অন্য এক মানুষ! অপরাধের সঙ্গে আড়ি দিলেন হাজী মাস্তান, ‘দলিত মুসলিম সুরক্ষা মহা সংঘ’ নামের একটা দল গঠন করে চলে এলেন রাজনীতির ময়দানে।

‘দলিত মুসলিম সুরক্ষা মহা সংঘ’ নামের একটা দল গঠন করে রাজনীতিতে এলেন

নিজের ‘রবিনহুড’ ইমেজ পুনরুদ্ধারে রবিনহুড মানুষের জন্যে কাজ করে বেড়াতে থাকলেন। মিডিয়ার সমর্থন পেতে বন্ধু দিলীপ কুমারকে নিয়ে আসতেন পার্টির সম্মেলনে, তবে বোম্বের ইলেকশনে হেরে গিয়েছিল তার দল। যদিও অঢেল কালো টাকা ঢেলেছিলেন এই নির্বাচনের পেছনে, বলা হয় বোম্বে তথা মুম্বাইয়ের রাজনীতিতে কালো টাকার অবাধ বিচরণের শুরুটা হাজী মাস্তানের হাত ধরেই।

এর মধ্যে নিজের লোকেদের জন্যেও টান কমেনি তার, মুম্বাইতে ধরপাকড় শুরু হলে অনেক অপরাধীকে, বিশেষ করে তার দলের লোকেদের ব্যাঙ্গালোর পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছিলেন তিনি।

ভালোমন্দ মিলিয়ে হাজী মাস্তান এক অদ্ভুত চরিত্র। বোম্বের অন্ধকার জগতে অনেকগুলো বছর দোর্দন্ড প্রতাপে রাজত্ব করেছেন, টাকার পাহাড় গড়েছেন, পেয়েছেন প্রভাব-প্রতিপত্তি। অথচ জীবনে নিজের হাতে কাউকে খুন করেননি তিনি, কাউকে আঘাত করেছেন বা কাউকে মেরে ফেলার আদেশ দিয়েছেন বলেও শোনা যায় না। অথচ বোম্বে ছাপিয়ে পুরো মহারাষ্ট্র প্রদেশটাই কাঁপত তার নামে! শেষ জীবনে অন্ধকার জগত থেকে নিজেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলেন তিনি, তবুও সেখানকার লোকজন নানা সমস্যা নিয়ে আসতো তার কাছে। ১৯৯৪ সালে স্বাভাবিক মৃত্যুই হয় তার।

১৯৭৫ সালে তার ঘটনাবলী অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল ‘দিওয়ার’ নামের চলচ্চিত্র, অমিতাভ বচ্চন-শশী কাপুর-পারভীন ববি-নীতু সিং অভিনীত সিনেমাটি দারুণ ব্যবসাসফল হয়েছিল। আর হাল আমলের ‘ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন মুম্বাইয়ে’র কথা তো বলা হলোই। বলিউডেও হাজী মাস্তান দারুণ আকর্ষণীয় চরিত্র ছিলেন বলতে হবে!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা