যৌনপেশা ছেড়ে যিনি এখন যৌনপল্লীর শিশুদের ভাগ্য বদলে দিচ্ছেন!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
হাজেরা বেগম একবার দেখলেন, এক যৌনকর্মীর বাচ্চা মেয়ে তার মায়ের জন্যে কনডম কিনে আনছে...
গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়, তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়? - লালনের সেই বিখ্যাত সৃষ্টি। পতিতালয়ে যাওয়া ভদ্রলোকেরা নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে আসে, কিন্তু কখনো জানে না যৌনকর্মীর জীবন কেমন। সমাজ যৌনকর্মীদের অচ্ছুৎ করে রাখে দিনের আলোয়, ভাবতে চায় না কিভাবে কাটে তাদের দিন।
আজকে একজন যৌনপেশায় যুক্ত সাবেক এক কর্মীর গল্প বলবো। তাকে নিতে গত পাঁচ বছরে অনেক পত্রিকা লিখেছে। সম্প্রতি বিবিসি 'তিরিশে ফিনিশ' সিরিজে তাকে নিয়ে একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রকাশ করার পর তা সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ ছড়িয়ে পড়ে। যার কথা বলছি, তিনি হাজেরা বেগম, কেবলই একজন সাবেক যৌনকর্মী বলে তার পরিচয় দেয়া যাবে না, তিনি দেড়শো সন্তানের মা, যে বাচ্চাগুলো আবার যৌনকর্মীদের ঔরসজাত সন্তান।
হাজেরা বেগমের জীবনের পথ বেঁকে গেছে যখন বয়স তার মাত্র সাত, তখন। বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন, মা খাবার দেয় না বলে৷ হারিয়ে গেছেন পথে। মিশে গিয়েছেন পথশিশুদের মধ্যে। তারপর একদিন ইংলিশ রোডের এক পতিতালয় হলো তার ঠিকানা। তিনি দেখেছেন, জীবন এখানে কতটা তীব্র যন্ত্রণা লুকানোর এক খেলা। প্রয়োজন মিটাবার প্রয়োজন এখানে ফুরোয় না। এখানে দিন আসে না, এখানে রাত শেষ হয় না।
অদ্ভুত এই জীবনকে কাছ থেকে দেখার কারণে তিনি জানেন, কেমন কাটে কিভাবে কাটে একজন যৌনকর্মীর জীবন। তিনি দেখেছেন জীবনের কত করুণ গল্প। একবার দেখলেন, এক যৌনকর্মীর বাচ্চা মেয়ে মায়ের জন্যে কনডম কিনে আনছে। মেয়েটা জানে তার মা এই কাজ করে, এভাবেই তাদের জীবন চলে, এই নির্মম জীবনচক্রের স্বাক্ষী হয় মেয়েটা।
হাজেরা এরকম ঘটনা দেখে গভীরে ভাবেন। তিনি জানেন একদিন হয়ত এই বাচ্চাগুলোও ওই পথে চলে যাবে। কারণ, কেউ তাদের বিকল্প পথ বাতলে দেয় না। কেউ তাদের জীবনে আলো খুঁজে দেয় না। সবাই কেবল প্রয়োজনটা বোঝে, মন বোঝার লোক কই!
হাজেরা ১৯৯০ সালের দিকে নিজে যৌনপেশা ছেড়ে দিলেন। এরপর এনজিওসহ বিভিন্ন দিকে কাজ করতেন। মানুষের জন্যে কিছু করার তাড়না কাজ করত তার। বিশেষ করে যে জীবন দেখে এসেছেন, যৌনপল্লীর শিশুদের জন্য কিছু করার ভাবনা ছিল তার।
হাজেরা নিজ জীবনের গল্প বলতে গিয়ে বলেন, "বাবা-মা থাকতেও তাদের আদর পাইনি। ছোটবেলা থেকে রাস্তায় বড় হইছি। একসময় রাস্তার মেয়েমানুষ হয়ে গেছি। নিজে কখনও সন্তান পেটে ধরিনি। কিন্তু নিয়তির খেলায় এখন আমার কত সন্তান! দেখতাম যৌনকর্মীদের বাচ্চা চুরি হয়, অনেকে তাদের মায়ের আদিম পেশায় ফিরে যায়। রাস্তায় বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়। স্বপ্ন দেখতাম এসব শিশুদের জন্য কিছু করার জন্য"।
ফলে ২০১০ সালে নিজের যতটুকু সম্বল আছে সেগুলো দিয়ে এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সহায়তায় ‘শিশুদের জন্য আমরা’ নামক সংগঠন গড়ে তোলেন হাজেরা বেগম। তিনি এই সংগঠনের মাধ্যমে যৌনকর্মীদের সন্তানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাওয়া, দাওয়া সব দেখভালের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি হয়ে উঠেছেন তাদের মা। এই সন্তানরা নিজের মায়ের আদর পায় কদাচিৎ, ফলে তাদের জীবন হয়ে যায় এতিমের মতো। হাজেরা বেগম এই মাসুম বাচ্চাদের মা হয়ে তাদের মায়ের অভাব পূরণ করছেন।
হাজেরা বেগম বিবিসির 'তিরিশে ফিনিশ' সিরিজের ভিডিও'তে তার গল্প বিবৃত করেন এভাবে,
"আমি ১৯৯০ সাল থেকে এই পেশাটা ছেড়ে দিয়েছি। এরপর আমি অন্যান্য কাজ করতাম, এনজিও-তে কাজ করেছি। তখন আমার মনে আসে যে যৌনকর্মীর বাচ্চাদের জন্য কিছু একটা করতে হবে। আর আমার তখন টাকা-পয়সা যা ছিলো সব খরচ হতো না, ব্যাংকে রাখতাম। পরে নয় লাখ টাকা দিয়ে বাচ্চাদের এই সেন্টারটা দিয়েছি।
...গত নয় বছরে কয়েকশো বাচ্চাকে পড়ালেখা ও হাতের কাজ শিখিয়েছি। কেউ গাড়ি ড্রাইভিং করে, কেউ আবার বিদ্যুতের কাজ করে। এসব কাজ করে তাদের মায়েদের সহযোগিতা করে, কারণ মায়ের বয়স হয়ে গেছে না?
এখন আমার খুব ভালো লাগে কারণ এতো বাচ্চার মা যে হবো, আমি ভাবিনি। আমার যে নিজের বাচ্চা নেই, এটা কখনো অনুভব করি না। তারা এসে আমার পায়ের কাছে বসে থাকে। বলে মা, একটু আদর করে দুই নলা ভাত খাইয়ে দাওগো মা। অনেক দিন তোমার হাতে ভাত খাই না। শিশুরা আমাকে মা বলে পরিচয় দেয়।"
হাজেরা বেগম যে কাজ করছেন, তাকে হাজার বার স্যালুট দিলেও কম হয়ে যাবে। এ ভীষণ সাহসী কাজ, এই ভীষণ মানবিকও। যৌনপল্লীর ভাসমান শিশুদের আশ্রয় দিয়ে তিনি শুধু মায়ের অভাবটাই পূরণ করলেন না এই বাচ্চাদের, তিনি তাদের জীবনটাও বাঁচালেন আসলে। হাজেরা বেগম আপনি কি জানেন, মাতৃত্ব আপনার দেহজুড়ে, মানবিকতা আপনার হৃদয় জুড়ে! হাজেরা বেগম আপনার জন্যে ভালবাসা। আপনি দীর্ঘজীবী হন মা...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন