টেন মিনিট স্কুলের পর তথাকথিত 'ফেসবুক মুমিন'দের টার্গেট এবার কণ্ঠশিল্পী হাবিব ওয়াহিদ। দলে দলে ভার্চুয়াল অ্যাটাক করা হচ্ছে তাকে, গালাগালি দিয়ে নিজেদের ঈমান জাহির করতে নেমেছে একদল উজবুক ধর্মান্ধ।

শিল্পী হাবিব ওয়াহিদ নিজের একটা ছবি আপলোড দিয়েছেন ফেসবুকে, ক্যাপশনে লিখেছেন, 'আজকে শুক্রবার, তাই দাঁড়ি গুলো কে একটু ছুটিতে পাঠালাম।' ছবিটা নিউজফিডে এসে সারতে পারেনি, 'ফেসবুক মুমিন'দের দাড়িনুভূতিতে আঘাত লেগে গেছে সঙ্গে সঙ্গে। একের পর এক আজেবাজে মন্তব্যের বহর বসেছে, দলবেঁধে আক্রমণ করা হয়েছে, পাল্লা দিয়ে চলেছে গালিগালাজ। 'নবীজির সুন্নত' দাঁড়ি নিয়ে মন্তব্য করার কোন অধিকার হাবিবের নেই, একজন মুসলমান হিসেবে দাঁড়ি কাটা কেন উচিত নয়- এসব নসিহতে ভরে গেছে সেই পোস্টের কমেন্টবক্স। 

খুবই সাধারণ একটা কাজ করেছেন হাবিব ওয়াহিদ, দাঁড়ি ছোট করে নিজের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। আর তাতেই কিনা ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগে গেল এতগুলো লোকের! ধর্মানুভূতি কি এতটাই ঠুনকো, এতই সস্তা? কে নিজের দাড়ি কাটলো, সেটার ছবি ফেসবুকে দিলো, তাতেই নবীজির সুন্নতকে অপমান করা হয়ে গেল? এমন বখাট্য যুক্তির পসরা সাজিয়ে নোংরামির আসর বসিয়েছে যারা, এরা কি খায়? জন্ম থেকেই কি তারা মানসিক বৈকল্যকে সঙ্গী করে নিয়ে এসেছে, নাকি স্পেশাল কোন ট্যাবলেট খেয়ে এই গুণ অর্জন করেছে? 

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, তেরো চৌদ্দ বছর বয়সী ছেলের মতো বালাই আর নাই। আমার মনে হচ্ছে, বাঙালির ধর্মানুভূতির মতো বালাই আর নাই। বাঙালি মুসলমানের ধর্মানুভূতি যে কখন কিসে আঘাত পাবে, সেটার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। দূর প্রবাসে বসে কেউ সমকামিতার পক্ষে কথা বললে ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগে যায়, পিরিয়ড বা সেক্সের কনসেন্ট নিয়ে কথা বললেও অনেকের অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এখন দেখা যাচ্ছে, কেউ নিজের দাড়ি কাটলেও একটা দল এসে নোংরামির চূড়ান্ত নজির দেখিয়ে দিচ্ছে! অর্থাৎ কেউ এখন নিজের শরীরের চুলদাড়িও কাটতে পারবে না, সেই স্বাধীনতাও কেড়ে নেয়া হচ্ছে!  

এই অবস্থা কিন্ত একদিনে তৈরী হয়নি। ধর্মীয় উগ্রপন্থার এই বিষবাস্পকে আমরা নিজের হাতে বেড়ে উঠতে দিয়েছি, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে। সামান্য একটা কার্টুনকে কেন্দ্র করে যখন কার্টুনিস্ট এবং পত্রিকার সম্পাদককে বায়তুল মোকাররমে গিয়ে ক্ষমা চাইতে হয়েছে, সেদিনই গতিপথ নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল, আমাদের সমাজ গহীন অন্ধকার একটা টানেলে ঢুকে যাচ্ছে, যে আঁধারের শেষ নেই। 

নাস্তিক আখ্যা দিয়ে ব্লগারদের কুপিয়ে মারা হয়েছে, নির্মম সেসব হত্যাকান্ডের কোচ বিচার হয়নি আজও। সেসব মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ফেসবুকে উল্লাস দেখেছি, নাস্তিকের এমন শাস্তিই হওয়া উচিত বলে রায় দিয়েছে তৌহিদি জনতা। মডারেট মুসলমান যারা আছি আমরা, তারা মুখে বলেছি ইসলাম হত্যাযজ্ঞ সমর্থন করে না, কিন্ত প্রতিবাদ করে বলতে যাইনি যে এই দেশে একজন ধার্মিকের বেঁচে থাকার যতটা অধিকার আছে, একজন নাস্তিকেরও ঠিক ততটাই অধিকার আছে। ধর্ম পালন না করার 'অপরাধে' অন্যায়ভাবে কাউকে প্রাণে মারাটা যে সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করার শামিল, কুরআনের সেই আয়াতটা মনে করিয়ে দেইনি কেউ। 

কমেন্টবক্সে চলছে নসিহত দেয়ার কাজ

ধর্মান্ধরা তাতে লাই পেয়েছে, নব্বই পার্সেন্ট মুসলমানের দেশ বলে বুলি আওড়ে গেছে। সত্যিকার অর্থে এসব ধর্মান্ধের সংখ্যাটা ৫-১০ পার্সেন্টের বেশি নয়, কিন্ত সমস্যা হচ্ছে, এদের তান্ডবনৃত্যের সামনে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা বরাবরই চুপ থেকেছে, আর তাতে পেয়ে বসেছে এরা। নিজেদের ধর্মের ধ্বজাধারী বানিয়ে ফেলেছে, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ভেবে ইসলামী শাসনব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছে। সরকারও এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো এদের তোয়াজ করেছে, তাতে এদের গরিমা বেড়ে উঠে গেছে আকাশে। 

সেসবেরই মিলিত ফল আজকের এই পরিবেশটা। এখানে কনসেন্ট কথা বললে খুনের হুমকি দেয়া হয়, চাপের মুখে পিরিয়ডের সচেতনতা নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে নিতে হয়, মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে কন্টেন্ট বানিয়ে সেটার জন্য আবার ক্ষমা চাইতে হয়, হুমকির মুখে পরিবার নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে হয়। আয়মান সাদিক থেকে মোশাররফ করিম, কিংবা জয়া আহসান, মিথিলা থেকে হাবিব ওয়াহিদ- এদের নোংরামির রাডার থেকে মুক্ত থাকতে পারেন না কেউই।

অথচ আমাদের দেশে নাকি 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন' নামের কঠিন একটা আইন আছে, অনলাইনে হুমকি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, নাশকতার ষড়যন্ত্র বা নোংরামি বন্ধ করার জন্য যে আইনটা করা হয়েছিল, সেটার ব্যবহার আমরা শুধু সরকারের সমালোচনা যারা করে, তাদের ওপরেই হতে দেখছি। অথচ এই যে সেলিব্রেটিদের কমেন্টবক্সে এরা নিজেদের জঘন্য আর বর্বর আচরণের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে, সেসবের জন্য আজ পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার হতে শুনিনি। 

হয়তো আমাদের সাইবার ক্রাইম ইউনিট এগুলোকে সিরিয়াস কোন অপরাধ বলে মনেই করে না। কিন্ত কট্টরপন্থার এই নিদর্শনগুলোই যে নব্য জঙ্গীবাদের সূচনা, সেটা ভুলে যাওয়ার উপায় কি আছে? এদের মধ্যে থেকেই তো নিবরাস বা ফারাবীর মতো জঙ্গীরা বেরিয়ে আসে, আসবে। আজ যে কীবোর্ড চেপে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে একে-তাকে গালি দিচ্ছে, কাল ব্রেইনওয়াশড হয়ে সে যে অস্ত্র হাতে তুলে নেবে না, তার কোন গ্যারান্টি কি আছে?


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা