একজন ম্যাজিস্ট্রেট কীভাবে কারো চুল কেটে দেয়ার আদেশ দিতে পারেন? আইন কি তাকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে? নাকি সঙ্গে পুলিশ ফোর্স ছিল বলে ম্যাজিস্ট্রেট মহাশয় নিজের পছন্দমতো আইন বানিয়ে নিয়েছেন?

সীতাকুণ্ডের গুলিয়াখালিতে আজ একটা বাজে একটা ঘটনা ঘটেছে। গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকতে ভ্রমণে আসা এক তরুণের চুল কেটে দেওয়া হয়েছে সেখানকার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মাহবুবুল হকের নির্দেশে। যখন তরুণের চুল কাটা হচ্ছিল, সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন ওই ম্যাজিস্ট্রেট। ওই সময় তোলা একটা ছবিতে দেখা গেছে, পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে গাড়ির পেছনে ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবুল হক দাঁড়িয়ে আছেন। একজন সেই তরুণের চুল কাটছেন। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন আরও কয়েকজন। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন ওই তরুণ।

একজন ম্যাজিস্ট্রেট কীভাবে কারো চুল কেটে দেয়ার আদেশ দিতে পারেন? আইন কি তাকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে? নাকি সঙ্গে পুলিশ ফোর্স ছিল বলে ম্যাজিস্ট্রেট মহাশয় নিজের পছন্দমতো আইন বানিয়ে নিয়েছেন? কেউ অপরাধ করলে তাকে তিনি গ্রেফতার করার আদেশ দিতে পারেন, স্বল্প সময়ের কারাদণ্ডও দিতে পারেন। কিন্ত চুল কেটে দেয়ার অধিকার তিনি কোথায় পেয়েছেন?

তরুণের অপরাধটা কি? কেন তার চুল কেটে দেয়া হলো? অভিযুক্ত ওই ম্যাজিস্ট্রেটের দাবী, ওই তরুণ নাকি অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘স্থানীয়দের অভিযোগ ছিল গুলিয়াখালী সৈকতে তাঁবু টাঙিয়ে রাতে অসামাজিক কার্যকলাপ চলে। সে অভিযোগের ভিত্তিতে তিনি সেখানে অভিযান চালিয়ে সাতটি তাঁবু জব্দ করেছেন। সেখানে একটি ছেলে উল্টাপাল্টা আচরণ করেছিল। স্থানীয় কেউ তার (তরুণের) চুল ছোট করে দিয়েছে।’ 

কাটা হচ্ছে তরুণের চুল, দাঁড়িয়ে দেখছেন ম্যাজিস্ট্রেট

ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব চোখে ঠুলি পরে বসে থাকতে পারেন, কিংবা টিনের চশমা চোখে দিয়ে অন্ধ সাজতে পারেন, কিন্ত আমাদের চোখে তো ঠুলি পরানো নেই, আমরা অন্ধও নই। আর তাই তো ছেলেটির চুল কাটা অবস্থায় তোলা ছবিতে জিপে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো পাঞ্জাবী-পাজামা পরিহিত ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবুল হককে চিনে নিতে আমাদের কষ্ট হয় না। তার নির্দেশে, তার চোখের সামনেই এই ঘটনাটা ঘটলো, অথচ সেটা বেমালুম চেপে গিয়ে তিনি বললেন 'স্থানীয়দের' কেউ সেই তরুণের চুল কেটে দিয়েছে! জানতে ইচ্ছে করে, চাকুরীজীবনের শুরুতে লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কি এভাবে মিথ্যা বলার শিক্ষা পেয়েছিলেন তিনি?

প্রথম শ্রেণীর কিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাঝেমধ্যেই শহরের বিভিন্ন পার্ক বা বিনোদন কেন্দ্রে ঢুঁ মারেন, তাদের সঙ্গে থাকে পুলিশ এবং আরও কিছু আইন শৃঙখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। গদাই লস্করী চালে হেলেদুলে গিয়ে তারা পার্ক থেকে জোড়ায় জোড়ায় ছেলেমেয়েদের পাকড়াও করেন 'অসামাজিক কর্মকাণ্ডে' লিপ্ত থাকার অভিযোগে। স্কুল-কলেজ পালিয়ে প্রেম করতে আসা ছেলেমেয়েগুলোর বাসায় ফোন দেয়া হয়, অভিভাবক ডেকে এনে করা হয় চরম হেনস্থা।

এই 'অসামাজিক কর্মকাণ্ড' জিনিসটার শানে নূজুল কি, সেটা আমার কাছে পরিস্কার নয়। প্রাপ্তবয়স্ক দুজন মানুষ ভালোবেসে, কিংবা ভালো না বেসেও একে অন্যকে চুমু খেতে পারে, হাত ধরে পার্কে বসে থাকতে পারে, প্রেম নিবেদন করতে পারে, সেখানে বাধা দেয়ার অধিকার তো সংবিধান কাউকে দেয়নি। প্রকাশ্যে পতিতাবৃত্তি কিংবা ওপেন সেক্স ব্যতিত অন্য ঘটনাগুলোর কোনটাই ফৌজদারী আইনে অপরাধ নয়, তাহলে এই মরাল পুলিশিং এর নামে বেড়াতে যাওয়া তরুণ-তরুণীদের হয়রানী করার মানে টা কি, সেটা কখনোই মাথায় ঢোকে না। 

ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবুল হক

আজকের ঘটনায় ফিরে আসি। আমাদের দেশে পর্যটন খাতের অবস্থা এমনিতেই নাজুক। বাটপার আর জোচ্চোরদের যন্ত্রণায় কোথাও যাওয়ার জো নেই। কক্সবাজার বা সাজেকের মতো জায়গায় বেড়ানোর খরচ দিয়ে ভারতে একটা বিলাসবহুল ট্যুর দিয়ে আসা যায়। তার ওপর এখন হাজির হয়েছে নতুন উপদ্রব, জায়গায় জায়গায় পুলিশ ধরে ধরে উত্যক্ত করে, ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে পেলে তো কথাই নেই! আজ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তো 'অনৈতিক কাজের' অজুহাত দেখিয়ে চুলই কেটে নিলেন, জব্দ করলেন তাঁবু। এরপরেও আমরা আশা করি, এদেশে পর্যটন খাত একদিন কোমর সোজা করে দাঁড়াবে! এর চেয়ে বরং বাংলাদেশ আমেরিকার চেয়ে উন্নত হয়ে যাবে, এই স্বপ্ন দেখাও ভালো! 

বাংলাদেশে ভূমি অফিসগুলো হচ্ছে দুর্নীতির আখড়া। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে ওঠে সেখানে, গণ্ডায় গণ্ডায় ঘুষ দেয়া লাগে, দরিদ্র‍্য মানুষজনের নাভিশ্বাস উঠে যায় হেনস্থা হতে হতে। সহকারী কমিশনার এবং ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মাহবুবুল হকের কাছে আকুল আবেদন থাকবে, আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমি অফিসের দূর্নীতি বন্ধ করুন। মানুষের ভোগান্তি দূর করুন, আপনার এলাকায় স্কুল-কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে যারা মেয়েদের উত্যক্ত করে, তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনুন। পর্যটকদের ধরে ধরে চুল কেটে দেয়ার কাজের জন্যে সরকার আপনাকে পাবলিক সার্ভিসে নিয়োগ দেয়নি। নিজেকে জনগনের সেবক ভাবতে শিখুন, মালিক নয়। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা