'মহাপুরুষ' শব্দটা থাকে শুধু ডিকশনারিতে!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
এই গ্রহে যেসব গ্রেটরা জন্মেছেন, যাদের আমরা শ্রদ্ধা করি, আদর্শ মানি; তারা নিজেরাও ইগো প্রবলেম, জেলাসি, মানবিক ক্ষুদ্রতা থেকে বের হতে পারেননি। অল্প একটু উদারতা দেখালে তাঁদের কৃতিত্ব কমতো না, বরং বেড়ে যেতো হয়তো। কিন্ত তাঁরা সেটা করেননি, স্বার্থের জন্য!
সাদমান জাহিন: ১. ক্যালকুলাসের জনক কে? জিজ্ঞেস করলে, সবার প্রথমে নিউটনের নামটা মুখে চলে আসে। নিউটনের নামের ভারে আরেকটা নাম আড়ালে থেকে যায়। নামটা গডফ্রে লিবনিজ।
কথিত আছে, সমসাময়িক এই দুই ম্যাথম্যাটিশিয়ানের মধ্যে ক্যালকুলাসের ক্রেডিট নিয়ে তুমুল যুদ্ধ লেগেছিল। নিউটন তখন মোটামুটি হোমড়া-চোমড়া বিজ্ঞানী, তার উপর রয়্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট। নিউটনের তোষামোদকারীদের চাপে লিবনিজের দাবী টিকতে পারেনি। নিউটন জিতে, হয়ে যায় 'ফাদার অব ক্যালকুলাস'।
উলটো লিবনিজের উপর প্লেগারিজমের দোষ চাপানো হয়। সে নাকি নিউটনের কাজ চুরি করে নিজের নামে চালিয়েছে। অথচ ডি-ওয়াই/ডি-এক্স প্রতীক থেকে শুরু করে আরো অনেক ক্ষেত্রে লিবনিজের অবদান কোনো অংশে কম ছিল না,বরং কিছু জায়গায় বেশিই ছিল।
২. এডিসন-টেসলার দ্বৈরথের সাথে মোটামুটি সবাই পরিচিত। নিকোলা টেসলা চাকরি নিয়েছিলেন এডিসনের কোম্পানিতে। এডিসন বৈদ্যুতিক বাতি সংক্রান্ত প্রাথমিক কিছু গবেষণা করেন, কিন্তু সেটি মোটেও কার্যকরী কিছু ছিল না। ওইদিকে টেসলা বেচারা চাকরি নেয়ার পর খেটেখুটে বৈদ্যুতিক বাতির গবেষণাকে কার্যকরী রূপ দেন। আজকের ফ্লোরোসেন্ট লাইট তারই পরিশ্রমের ফসল ।
কথা ছিল, এডিসন এজন্য তাকে পঞ্চাশ হাজার ডলার দেবেন। টেসলা কাজ শেষে পারিশ্রমিক চাইতে গেলে এডিসন বলেন, 'তুমি ঠাট্টাও বোঝো না!' টেসলার এসি কারেন্ট, আমরা বাসা-বাড়িতে যেটা এখন অহরহ ব্যবহার করি, সেটাকে দাবিয়ে রাখার জন্যেও এডিসনের প্রচেষ্টা কম ছিল না। এসি কারেন্ট দিয়ে এডিসন সার্কাসের হাতিকে শক দিয়ে মেরে বলেছিল, 'দেখো দেখো...এই কারেন্ট কত ভয়ংকর!' টেসলা বর্ন জিনিয়াস ছিলেন, কিন্তু ধুরন্ধর না। এক্স-রে, রেডিও, রোবোটিক্স ইত্যাদি আরো অনেক কিছু আবিষ্কার করেও বিজ্ঞানীদের রেষারেষি কিংবা চুরির শিকার হয়ে টেসলা মারা যান নিঃস্ব অবস্থায়।
৩. আইনস্টাইন দেখতে পারতেন না হাইজেনবার্গকে। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি আইনস্টাইন জীবদ্দশায় কখনো মেনে নিতে পারেননি। উলটো হাসাহাসি করেছেন।
রেষারেষির ব্যাপারটা বলতে গেলে শুধু বিজ্ঞানীরা না, এই তালিকায় লেখক, আর্টিস্টরাও চলে আসবেন। তলস্তয় বলতেন, শেক্সপিয়ার কোনো লেখকই না। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি আর মাইকেল এঞ্জেলোর মধ্যে বেশ তর্কযুদ্ধ হতো, এমনকি হাতাহাতির পর্যায়েও গিয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র মেনে নিতে পারেননি, ঠাকুরবাড়ির পুঁচকে ছেলে রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি কবিতা লিখে রাতারাতি এতো বিখ্যাত হয়ে যাবে...
৪. হঠাৎ কেন এত কিছু বলা? শুধু এইটুকু দেখাতে যে, এই গ্রহে যেসব গ্রেটরা জন্মেছেন, যাদের আমরা শ্রদ্ধা করি, আদর্শ মানি; তারা নিজেরাও ইগো প্রবলেম, জেলাসি, মানবিক ক্ষুদ্রতা থেকে বের হতে পারেননি। অল্প একটু উদারতা দেখালে তাঁদের কৃতিত্ব কমতো না, বরং বেড়ে যেতো হয়তো। কিন্ত তাঁরা সেটা করেননি, স্বার্থের জন্য। কী অদ্ভুত না?
একটা ব্যাপার আমি লক্ষ্য করি, মানুষের আইডিওলাইজ করার ক্ষমতা সীমাহীন। আমরা খুব সহজে কাউকে দেবতার আসনে বসিয়ে ফেলি, তারপর তার ভুলগুলো মেনে নিতে পারি না। বিশ্বাস করতে চাই না। 'ও এমন করেছে? আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না'- ভুল। বিশ্বাস করতে হবে। মানুষ হয়ে জন্মেছে যে, ভুল থেকে সে মুক্তি পাবে না। স্বয়ং নিউটন পারেনি, আইনস্টাইন পারেনি। তাঁদের প্রত্যেকের প্রফেশনাল লাইফ দারুণ সফল ছিল, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে খুঁত ছিল, থাকতে হবেই। যেমনটা হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন,
'মহাপুরুষ শব্দটা থাকে ডিকশনারিতে। ডিকশনারির বাইরে থাকে শুধু বিকারগ্রস্ত পুরুষ।'