লকডাউনের সময়টাতে দৌলতদিয়ার দুই হাজার যৌনকর্মী এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলো পড়েছে অথৈ সাগরে। করোনা আসুক বা না আসুক, না খেয়েই তাদের মরতে হবে- এরকম একটা অবস্থা তৈরী হচ্ছিল...

সরকারের নানা কাজের, নানা সিদ্ধান্তের সমালোচনা তো সবসময়ই করি। এমপি-মন্ত্রীরা ভুলভাল কথাবার্তা বললে, বিতর্কিত মন্তব্য করলে ধুয়ে ফেলি। তবে আজ এই লেখার মাধ্যমে সরকারকে একটা ধন্যবাদ দিতে চাই। লকডাউনের এই দিনগুলোতে দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা পতিতা পল্লীগুলোতে যারা পেটের দায়ে কাজ করেন, সেই মানুষগুলোকে বিনামূল্যে খাবার আর ঔষধ সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার, কাজও শুরু হয়ে গেছে। এই উদ্যোগটাকে স্বাগত না জানালে ভীষণ অন্যায় হবে।

আমাদের সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত অংশে বাস পতিতাদের। এই মানুষগুলোকে সমাজের অংশও মনে করি না আমরা, পতিতা মানেই যেন সমাজচ্যুত। অথচ আমরা ভুলে যাই, এই নারীদের কেউই শখ করে এই পেশায় আসেননি, জীবনের কঠিন বাস্তবতা তাদের এই পথ ধরতে বাধ্য করেছে, জীবন বাঁচানোর জন্যেই এই রাস্তা বেছে নিয়েছেন তারা।

পতিতাবৃত্তি যুগে যুগে সব দেশেই ছিল, আছে। বাংলাদেশেও ব্রিটিশ আমল থেকেই এই পেশার জন্ম, বেড়ে ওঠা। রাজবাড়ি জেলার গোয়ালন্দের দৌলতদিয়ায় দেশের সবচেয়ে বড় পতিতালয়ের অবস্থান, কয়েক হাজার নারী এখানে পরিবার নিয়ে বাস করেন। অথচ একদম ন্যুন্যতম নাগরিক সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত। এলাকার স্কুলে তারা তাদের বাচ্চাদের পড়াতে পারেন না, ভর্তি করতে হয় বাবা-মায়ের নাম-পরিচয়-ঠিকানা সবকিছু গোপন করে। অসুস্থ হলে তারা উন্নত চিকিৎসা সেবা পাননা, এমনকি মরে গেলে তাদের লাশ ভাসিয়ে দেয়া হতো নদীতে, শেষ সম্মানটুকুও তাদের দেয়া হতো না।

করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে দেয়া লকডাউনের এই দিনগুলোতে পুরো দেশ অবরুদ্ধ, আর সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় আছেন এই মানুষগুলো। কারণ দৌলতদিয়া সহ সারাদেশের প্রায় সব পতিতালয়ের মূল খদ্দের হচ্ছেন পরিবহন শ্রমিকরা। জরুরী সেবা ছাড়া গাড়ি চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে পড়ায় পতিতালয়ের নারীদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে, নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়। গত ২০ মার্চ থেকে বিশ দিনের জন্যে খদ্দেরদের আগমন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে দৌলতদিয়ায়, লকডাউনের মেয়াদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদও বেড়েছে। কিন্ত পেটের খিদে তো আর এতসব বোঝে না। খদ্দের ঘরে আসুক না আসুক, টাকা আয় হোক বা না হোক, চুলায় আগুন জ্বলুক বা না জ্বলুক- খিদে তো লাগবেই।

লকডাউনের দিনগুলোতে ভীষণ বিপদে পড়েছেন যৌনকর্মীরা

এই দেশে অনেক মহৎ হৃদয়ের বিত্তবান মানুষ আছেন, যারা এই বিপদের দিনে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন নিজেদের সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে। বিদ্যানন্দ বা এরকম আরও অনেক সংগঠনও দারুণ কাজ করছে আর্ত মানবতার সেবায়। কিন্ত দৌলতদিয়া বা অন্যান্য পতিতালয়ে যারা কাজ করেন, সেই নারীরা রয়ে গেছেন পাদপ্রদীপের আড়ালে, তাদের দিকে সেভাবে নজর দেয়নি কেউই। আর আমাদের মতো তথাকথিত ভদ্রলোকেরা তো জীবনেও এসব ‘রাস্তার মেয়ে’ বা ‘বেশ্যা’দের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াবে না, তারাও এসে কারো কাছে হাত পাততে পারবে না।

আর তাই ভীষণ অসহায় একটা অবস্থায় দিন কাটছিল এই মানুষগুলোর। ঘরে যা ছিল ফুরিয়ে এসেছে, জমানো টাকা শেষ হয়েছে, ধার-কর্জ করার মতো অবস্থাও নেই, কারণ সামনে কি হবে কেউ জানে না, নগদ টাকায় হাত দিতে চাইছে না কেউই। তার ওপর দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও টাকা তুলতে পারছিল না সেখানকার লোকজন। দৌলতদিয়ার দুই হাজার যৌনকর্মী এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলো তাই পড়েছে অথৈ সাগরে। করোনা আসুক বা না আসুক, না খেয়েই তাদের মরতে হবে- এরকম একটা অবস্থা তৈরী হচ্ছিল ধীরে ধীরে।

তবে গোয়ালন্দের উপজেলা প্রশাসন তড়িৎ পদক্ষেপ নিয়েছে এই যৌনকর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে। গোয়ালন্দের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবায়েত হায়াত জানিয়েছেন, ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এই নারীদের প্রত্যেককে ত্রিশ কেজি করে চাল এবং দুই হাজার টাকা করে আপতকালীন সাহায্য দেয়া হয়েছে। বিনামূল্যে চিকিৎসা সরঞ্জামও বিতরণ করা হবে সবার মধ্যে। লকডাউনের মেয়াদ বাড়লে এই সাহায্যের পরিমাণও বাড়বে, মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এরইমধ্যে যোগাযোগ করেছেন তারা। এই সাহায্যটা শুধু দৌলতদিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, দেশের সবগুলো পতিতাপল্লীতে কাজ করা নারীরাই সরকারী এই সাহায্যের আওতায় আসবেন বলে জানা গেছে।

খারাপ কাজের সমালোচনা থাকবে, ভালো কাজের প্রশংসাটাও থাকা উচিৎ। দেশের মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানোটা সরকারের কাজ, তাদের কর্তব্য। এই দুর্যোগের দিনে পতিতাপল্লীর নারীদের যখন না খেয়ে মরার অবস্থা হয়েছে, তখন তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে সরকারকে একটা ধন্যবাদ দেয়াই যায়…

আরও পড়ুন- 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা