যারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন, দৈনিন্দন কার্যক্রম, লাইফস্টাইল সব নষ্ট হয়ে গেছে, গুছিয়ে উঠতে পারছেন না; তাদের জন্য কিছু পরামর্শ...
হাসপাতালে গিয়েছেন কখনো? মোটামুটি সবাই গিয়েছেন নিশ্চয়ই। এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যে নিজের বা অন্যের যে কোনো কারণেই হোক, জীবনে একবার হলেও হাসপাতালে যায়নি। আচ্ছা, হাসপাতালে ভর্তি থাকে কারা জানেন তো, রোগীরা। কেউ অল্প অসুস্থ, কেউ বেশি, কেউ সুস্থ হওয়ার পথে, কেউবা মৃত্যুর পথে। কেউ হয়তো হাসিমুখে বের হয়ে যাচ্ছে আর কেউবা বের হচ্ছে লাশ হয়ে। কোন কোন বেড থেকে হয়তো হঠাৎ পরিবারের কারো গগনবিদারী আর্তনাদ ভেসে আসছে।
পঙ্গু হাসপাতালে গেলে দেখবেন সম্পূর্ণ সুস্থ রাজপুত্রের মত ছেলে কিন্তু তার একটি পা নেই, কারো হাত নেই, কেউ সব থেকেও প্যারালাইজড হয়ে অচল। যেই বাবা একসময় ছেলেকে মাথায় করে ঘুরতো আজ সেই বাবাকে ছেলেরা ধরে স্ট্রেচার থেকে বেডে রাখে। যে কিনা একদমে বাড়ির নীচতলা থেকে ছাদে উঠে যেত তার প্রস্রাব-পায়খানাও এখন করতে হয় বিছানায়। যেন বেঁচেও মৃতের মত জীবনযাপন।
বার্ণ ইউনিটে গেলে দেখবেন জীবনের আরেক রূপ, পুতুলের মত সুন্দর মেয়ে কিন্তু মুখটা ঝলসে আছে, হাত পুড়ে গেছে। কারো অর্ধেক শরীর পুড়ে হাড্ডি বের হয়ে আছে, কারো সুন্দর চুলগুলো পুড়ে মাথার সাথে মিশে গেছে। শিশু হাসপাতালে গেলে দেখবেন আরেক জীবন। গতকাল যেই বাচ্চাটির জন্ম হলো, আজই তার লাশ নিয়ে বের হলো বাবা মা। দীর্ঘদিন সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা বাবা-মা সন্তান জন্মের পর খুশীতে সবাইকে মিষ্টিমুখ করানোর আগেই সন্তান বাঁচবে কিনা তা ভেবে কান্না করে।
এখন আমাকে বলেন আপনার কষ্টটা কোথায়! আপনি মরে যেতে চান কেন? এই মানুষগুলো মৃতপ্রায় হওয়ার পরেও আপনজনেরা চায় নিজেদের শেষ সুযোগ পর্যন্ত তাকে বাঁচানোর চেষ্টাটুকু করতে, আর আপনি সুস্থ থেকে চান মরে যেতে। কেন? কিসের আনন্দে? আপনার আর্থিক, সামাজিক, মানসিক বা নিজের ডেকে আনা যেই সমস্যাগুলো সেগুলো নিশ্চয়ই এই মানুষগুলোর চেয়ে বেশি না।
ডিপ্রেশনে আছেন তাইতো? কেন আছেন সেই কারণটা খুঁজে বের করেন আগে। যদি কারণই খুঁজে না পান, তাহলে ডিপ্রেসড হওয়াটা আপনার বিলাসিতা; আর যদি কারণ খুঁজে পান তাহলে ভাবুন এটা আসলে ডিপ্রেসড হয়ে জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানোর মতো কারণ কিনা! অন্তত এই মানুষগুলোর তুলনায় আপনার অবস্থাটা আগে চিন্তা করুন। মানুষ যদি নিজেকে ও পরিবারকে ভালবেসে ঠান্ডা মাথায় বাস্তবতার নিরিখে নিজের ডিপ্রেশনের যৌক্তিক কারণ খুঁজতে যায়, তাহলেই তাদের ডিপ্রেশন ও হাল ছেড়ে দেয়ার মতো চিন্তাভাবনা প্রায় অর্ধেক কমে যাওয়ার কথা।
ভাবছেন যত দুঃখী আপনি একাই, জগতের বাকি সবাই মহাসুখী! আবার হাসপাতালেই ফিরে যাই। মোটামুটি সব রোগীর সাথেই দুইজন, অন্তত একজন হলেও আত্মীয় বা পরিবারের সদস্য থাকে। রোগীকে নিয়ে ভয়, শংকা, আতংক কোনটাই কিন্তু রোগীর চেয়ে পরিবার বা আত্মীয়দের কম না। এই একজন বা দুইজন ছাড়াও বাড়িতে চিন্তিত থাকে আরো কয়েকজন। আউটডোরেরগুলো বাদ দিয়ে ধরে নিলাম একটা হাসপাতালে বেডে ভর্তি অবস্থায় গড়ে ১০০০ রোগী থাকে। ধরলাম অন্তত ঢাকায় ১০টা হাসপাতাল আছে। তাহলে ঢাকাতেই অন্তত ১০ হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় থাকে প্রতিদিন। আর এই ১০ হাজার মানুষ ভর্তি মানে তাদের জন্য কান্না বা চিন্তা করার অন্তত ৯ জন করে মানুষও যদি থাকে তাহলে প্রতিদিন অন্তত ১ লক্ষ মানুষ এই ঢাকা শহরেই চিন্তায় দিশেহারা হয়ে ঘুরছে, কান্না করছে।
একইভাবে কবরস্থান ও শ্মশানগুলোতে দেখেন প্রতিদিন কতগুলো লাশ আসে। যতগুলো লাশ আসে বুঝে নেন লাশের সাথে এসে যারা কান্না করে তারচেয়ে কয়েকগুন বেশি মানুষ বাড়িতে কাঁদে। কারো মৃত্যুতে পুরো পরিবার অসহায় হয়ে যায়। এবার বলুন আপনিই দুনিয়ার সবচেয়ে অসুখী মানুষ? আর কেউ বাজে অবস্থায় বা দুশ্চিন্তায় নেই? আসলে আপনি নিজে যদি না বুঝেন, উপলব্ধি না করেন; তাহলে দুনিয়ার কেউ আপনার ডিপ্রেশন, ফ্রাস্ট্রেশন, মরার শখ- এগুলো কমাতে পারবে না। আমি বা আমরা বড়জোর আপনাকে উৎসাহ দিতে পারি, বাঁচার ইচ্ছাটা জাগিয়ে দিতে পারি, রাস্তাটা দেখিয়ে দিতে পারি; কিন্তু এরপর পথ চলতে হবে আপনাকেই।
যারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন, দৈনিন্দন কার্যক্রম, লাইফস্টাইল সব নষ্ট হয়ে গেছে, গুছিয়ে উঠতে পারছেন না; তাদের জন্য কিছু পরামর্শ-
* প্রতিদিন কিছু গল্প-উপন্যাস টাইপের বই পড়ুন।
* নিজেকে ব্যস্ত রাখুন সবসময়।
* প্রতিদিন দুই টাকা হলেও দান করুন।
* বাসার ছোট ছোট কাজগুলো করুন যেগুলো সচরাচর করেন না। যেমন- রুম পরিষ্কার করা, ধোয়ামোছা, বাথরুম পরিষ্কার করা।
* যেসব লেখা পড়লে অনুপ্রেরণা পাওয়া যায় সেগুলো পড়ুন।
* যেসব মানুষ মোটিভেট করে তাদের সাথে সময় কাটান, যারা মনোবল নষ্ট করে দেয় তাদের এড়িয়ে চলুন।
* পরিবার এবং কাছের মানুষগুলোর সাথে সময় কাটান, সম্পর্ক ভাল রাখুন।
* নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করুন।
* ক্রিয়েটিভ ও ব্রেইনকে ব্যস্ত রাখার মত কাজ করুন, কিছু না পেলে দুইটা অংক করুন।
* সামাজিক ও সেবামূলক কাজে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহনের চেষ্টা করুন যেখানে নিজে থেকে পরিশ্রম করে কাজ করা লাগবে।
* রাতে আগে ঘুমানো এবং ভোরে উঠার অভ্যাস করুন।
* মানুষের জন্য কাজ করুন, মানুষকে সহায়তা করুন।
* গৃহবন্দী না থেকে মাঝে মাঝে ঘুরতে যান, আড্ডা দিন।
* মাঝে মাঝে হাসপাতাল ও কবরস্থানে ঘুরে আসুন।
সর্বোপরি নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসুন, পরিবারকে ভালবাসুন, মা-বাবার চেহারা ও তাদের কথা সবসময় স্মরণ করুন। আমরা সবাই জানি প্রত্যেকের কাছে তার নিজের কষ্টকেই সবচাইতে বেশি মনে হয়। তবু, আরেকবার, স্রেফ আরেকবার ভাবুন না নিজেকে নিয়ে! তাকান না আপনার চারপাশে? কদিনই বা বাঁচব আমরা! একটু না হয় বাঁচার মতো বাঁচি?
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন