জর্জিনা হক: স্রোতের বিপরীতে হাঁটা বাংলাদেশের প্রথম নারী ড্রামারের গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
বারো বছর বয়সেই থালাবাসন বাজিয়ে ড্রামের প্রাকটিস শুরু তাঁর। তিন বোনের সাথে ঘরোয়াভাবে খুললেনও এক ব্যান্ড। বঙ্গবন্ধু-পুত্র শেখ কামালের অনুপ্রেরণায় যুক্ত হলেন পেশাদার ব্যান্ডের সাথে। বাকিটা হয়ে রইলো অসাধারণ এক পথচলার গল্প...
পাকিস্তানের লাহোরে কনসার্ট চলছে। মঞ্চে উঠেছে এক ব্যান্ড। ব্যান্ডের সাথে উঠেছে এক তরুণও। মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল অথচ বেশ কোমল চেহারার এই তরুণ ড্রামার। বেশ অসাধারণ ড্রাম বাজালেন। পারফর্ম শেষ হলো। ব্যাকস্টেজ দিয়ে নেমে সেই ড্রামার, দলের বাকিদের সাথে চা খেতে ঢুকলেন দোকানে। মানুষজন অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন, সেই ড্রামার আস্তে আস্তে নিজের মুখের দাড়িগোঁফ খুলছেন। সেখানে উপস্থিত একজনের মুখ থেকে অস্ফুটেই এক লাইন বের হয়ে এলো-
আবে ইয়ার... ইয়ে তো আওরাত নিকলা।
আসলে এই ড্রামার মহিলাই ছিলেন। মেয়েদের স্টেজে উঠে ড্রাম বাজাতে দেবে, পাকিস্তান এতটা প্রগতিশীল কবেও বা ছিলো? মেয়েটিও নাছোড়বান্দা। ড্রাম তো তাকে বাজাতে হবেই। দিব্যি দাড়িগোঁফ লাগিয়ে উঠে গেলো মঞ্চে। বাজালো ড্রাম। বোকা বানালো উপস্থিত সবাইকেই৷
এই আধপাগলা, খ্যাপাটে মেয়েটির নাম জর্জিনা হক। বাংলাদেশের প্রথম নারী ড্রামার।
ষাটের দশকে 'উইন্ডি সাইড অব কেয়ার' এর ড্রামার ছিলেন সাব্বির কাদির। তিনি প্রায়ই বলতেন, ড্রাম কিভাবে একটা গানের মধ্যে আলাদা এক দ্যোতনা এবং প্রানচাঞ্চল্য এনে দেয়। এই কথাগুলোই জর্জিনার কিশোরী মস্তিষ্ককে আলোড়িত করে ফেলে। সে মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়েই নেয়, বাজাতে হলে ড্রামই বাজাবে সে। বারো বছর বয়সেই রান্নাঘরের বাসনকোসন নিয়ে সে শুরু করে দেয় ড্রাম বাজানোর এক্সপেরিমেন্ট। বাসার সবাই ধরে নেয়, এ মেয়ে হবে বদ্ধ উন্মাদ! কিন্তু জর্জিনার তাতে কোনো হেলদোল হয় না। সে ড্রাম বাজানো নিয়ে পাগলামি চালাতেই থাকে।
নিজের বাকি দুই বোন; সুলতানা ও রোকসানা'কে নিয়ে ঘরোয়াভাবেই খুলে ফেলেন একটা ব্যান্ড। ব্যান্ডের নাম দেন- দ্য থ্রি হক সিস্টারস। এ প্রসঙ্গে একটা জিনিস জানিয়ে রাখি, জর্জিনার বড় বোন সুলতানা ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম মহিলা তবলা বাদক। এছাড়াও তাদের বাকি ভাইয়েরাও ছিলেন সঙ্গীতজগতের বিভিন্ন শাখায় যুক্ত। যাই হোক, 'দ্য থ্রি হক সিস্টারস' এ ফিরি। এই ব্যান্ড নিয়ে তাদের বিশেষ কোনো পরিকল্পনা ছিলো না৷ নিজেদের মত করেই গান বাজনা করতেন তারা। জনপ্রিয় হওয়ার কোনো ইচ্ছেও ছিলো না তাদের।
জর্জিনা একবার লক্ষ্য করেন, রাস্তার পাশে বসে যেসব মহিলারা ইট ভাঙ্গছে, তাদের ইট ভাঙ্গার মধ্যে বিশেষ একটা ছন্দ আছে। অনেকটা মেট্রোনম এর মত ছন্দটা। জর্জিনা এই ইটভাঙ্গার কাজ করা শ্রমজীবী মহিলাদের সাথে দেখা করা শুরু করলেন তখন। প্রত্যেকদিন যাওয়া শুরু করলেন তাদের কাজের জায়গা গুলোতে। প্রথম দিকে এই শ্রমজীবী মহিলারা ভাবতেন, মাথাখারাপ এই মেয়েটি হয়তো এসেছে তাদের কাজ পণ্ড করতে। কিন্তু পরবর্তীতে তারা জর্জিনাকে মেনে নেন এবং বেশ ভালোও বাসা শুরু করেন। জর্জিনা এদের পাশে বসে এদের রিদমে ড্রাম বাজাতেন। এরকমই একদিন ড্রাম বাজানোর সময়ে বঙ্গবন্ধু-পুত্র শেখা কামালের চোখে পড়েন তিনি। শেখ কামাল বেশ অবাক হন জর্জিনার এই উদ্ভট পাগলামি দেখে। এরপর শেখ কামালের অনুপ্রেরণাতেই তিনি যুক্ত হন পেশাদার ব্যান্ড 'স্পন্দন' এর সাথে। শেখ কামাল নিজে ছিলেন এই ব্যান্ডের উপদেষ্টা। এভাবেই জর্জিনা যুক্ত হন ব্যান্ডের মূলস্রোতের সাথে। যুদ্ধের পরে রমনা পার্কে ড্রামও বাজান তিনি ব্যান্ড স্পন্দন এর সাথে।
এরমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় জর্জিনার। বিয়ের পর যখন শ্বশুরবাড়ি যান, শ্বাশুড়ি খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন- মা, তুমি কী পারো? জর্জিনা বুঝতে পারেন নি, প্রশ্নটা আসলে কোন দিকে ইঙ্গিত করছিলো। তিনি তার স্বভাবসুলভ উচ্ছলতায় উত্তর দেন, আমি ড্রাম বাজাতে পারি। এরপর শ্বাশুড়ির মুখটা হয়েছিলো দেখার মতন।
১৯৭২ সালে মাত্র ষোলো বছর বয়সে টিএসসিতে ড্রাম বাজিয়েছিলেন তিনি৷ বাংলাদেশের বিজয় দিবসের এক বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে এই আয়োজনে ড্রাম বাজান তিনি। এরপর মাঝখানে পেরিয়ে গিয়েছে অনেকটা বছর। তিনিও দেশ ছেড়ে থিতু হয়েছিলেন আমেরিকায়। সেখানেও গড়েছিলেন ব্যান্ড। এরপর দেশে ফিরলেন ২০১৬ সালে। আবার দাঁড়ালেন টিএসসিতে। হয়তো বয়স বেড়ে গিয়েছে অনেকটাই। হয়তো আগের সেই সময়টা নেই। কিন্তু প্রাণের আবেগকে কেই বা আটকাতে পারে? জর্জিনা হক টিএসসির সেই মঞ্চে ড্রাম বাজিয়েছেন, গানও গেয়েছেন উদাত্ত গলায়। ফিরিয়ে এনেছেন অনেক আগের এক ইতিহাসকে।
এ দেশে এখনো মেয়েদের কে রাখা হয় পারিবারিক গণ্ডির একেবারে অভ্যন্তরে। সেরকম দেশে ষাটের দশকে জন্মানো একটি মেয়ে স্টেজে উঠেছেন, ড্রাম বাজিয়েছেন, ব্যান্ডের সাথে যুক্ত হয়েছেন, এটি মোটেও সাধারণ কোনো ঘটনা না। জর্জিনা হককে তাই বাংলাদেশের প্রথম মহিলা ড্রামার বলা হলে, সেটি তাঁর তাৎপর্যকে পুরোপুরি মোটেও প্রকাশ করবেনা। বাংলা ব্যান্ডের প্রসারে জর্জিনা এক অনুপ্রেরণার নাম... সেটি বললেও তাঁর তাৎপর্যের পুরোটা আসবে না। বরং জর্জিনা হক'কে দেখতে হবে গৎবাঁধা নিয়মকানুন'কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো এক অসাধারণ মানুষের অবতারে। সেখানেই ফুটে উঠবে তাঁর অবদানের আসল চমৎকারিত্ব। সেখানেই ফুটে উঠবে জর্জিনা হক নামের রকস্টারের আসল ক্যারিশমা।
মানুষটির আজ জন্মদিন। জন্মদিনে শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো বাংলাদেশের প্রথম নারী ড্রামার ও রকস্টার জর্জিনা হকের জন্যে।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন