জর্জ স্টিনি জুনিয়র: বর্ণবাদের নির্মমতার শিকার হয়েছিল চৌদ্দ বছরের যে কিশোর!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
কেন এত তড়িঘড়ি করে মাত্র দুই ঘন্টার ট্রায়াল এবং দশ মিনিটের জুরি বিতর্কের পরেই মৃত্যুদণ্ডের রায়টি দেয়া হয়? আসামীপক্ষকে কেন সাক্ষ্য উপস্থাপনের জন্যেও সুযোগ দেয়া হয়নি? জর্জের গায়ের রঙ কালো- এটাই কি একমাত্র কারণ ছিল?
মার্চ মাসের কোনো একটি উত্তপ্ত দিন। সাউথ ক্যারোলিনার এক পরিবারের ছোট দুই ভাইবোন নেমেছে বাইরে। উদ্দেশ্য, তাদের নিজেদের গরুগুলো যেখানে বেঁধে রাখা আছে, সেখানে যাবে। রেললাইনের পাশে গরু দুটি আরামে ঘাস চিবোচ্ছিলো। দুই ভাই বোন সেখানে এসে দাঁড়ায়। মৃদু বাতাস বইছে আশেপাশে। বেশ ফুরফুরে পরিবেশ। এমন সময় দুটি মেয়ে আসে বাইসাইকেলে করে। দাঁড়িয়ে থাকা ভাইবোনকে জিজ্ঞেস করে মে-পপ (একজাতীয় ফুল) কোথায় পাওয়া যেতে পারে। ভাই-বোন দুটি বলে, তারা জানেনা মে-পপ কোথায় পাওয়া যাবে। বোন দুটি বাইসাইকেল নিয়ে চলে যায়।
গল্পের এই অংশটুকু খুব সুন্দর। এবার গল্পের দ্বিতীয় অংশ পড়া যাক। বাইসাইকেলে করে বোনদুটি চলে যায় তাদের গন্তব্যে। পরে খবর আসে, এই বোনদুটিকে কেউ খুব নৃশংসভাবে মেরে ফেলেছে। মাথা থেতলে দিয়েছে রেললাইনের গজাল দিয়ে এবং মারার পরে মৃতদেহগুলিকে চুবিয়ে রেখেছে পরিখার মধ্যে।সন্দেহের তীর আসে সেই ছোট্ট ভাইবোনের দিকে যারা দাঁড়িয়ে ছিলো রেললাইনের পাশে। এরপর সাউথ ক্যারোলিনার সেই বাড়িতে আসে পুলিশ। গ্রেফতার করে নিয়ে যায় ভাইকে। বাসায় তখন বাবা-মা কেউ ছিলোনা। ছোট বোনটি মুরগির ঘরের পেছনে লুকিয়ে থাকে। তার চোখের সামনেই পুরো দৃশ্যটা মঞ্চস্থ হয়।
এ গল্পটা কোনো লেখকের মাথা থেকে বেরোলে খুব ভালো হতো। সিনেমার গল্পকেও হার মানায় এ গল্প। কিন্তু, মার্ক টোয়েন তো বলেই গিয়েছেন- Truth is stranger than fiction. এই বাক্যটাকে মনেপ্রাণে মেনে নিয়ে আমরা দেখি, গল্পটা আসলে কাল্পনিক কিছু না। ১৯৪৪ সালে ঠিক এরকম একটি ঘটনাই ঘটেছিলো সাউথ ক্যারোলিনে।
দুই বোন- বেটি জুন বিনিকার এবং ম্যারি এমা থেমস কে নির্মমভাবে হত্যার জন্যে আটক করা হয় জর্জ স্টিনি জুনিয়র নামের চৌদ্দ বছরের এক বালককে। হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশ স্টেশনে। ইন্টেরোগেশন করা হয় বাবা-মা অথবা আইনজীবী কারো উপস্থিতি ছাড়াই। পরে পুলিশ দাবী করে, জর্জ স্বীকার করেছে সব। সে-ই খুন করেছে দুই বোনকে। অদ্ভুত বিষয় হলো, মাত্র দুই ঘন্টার ট্রায়াল এবং দশ মিনিটের জুরি বিতর্কের পরে একরকম তাড়াহুড়ো করেই তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার জন্যে বলা হয়, আদালতের পক্ষ থেকে। জর্জের উকিল এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল না করার সিদ্ধান্ত নেন।
জুন ১৬, ১৯৪৪ এ জর্জের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এবং এই ২০২০ সালে এসেও জর্জই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কমবয়স্ক মানুষ, যাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। এবং তার মৃত্যুর সময়ে যে দৃশ্যের অবতারণা হয়, তাও খুবই যন্ত্রনার। জর্জ উচ্চতায় ছিলো পাঁচ ফুটের কাছাকাছি এবং ওজন একশো পাউন্ডও না। এরকম দুবলাপাতলা দেহে ইলেকট্রিক চেয়ারের ফিতেগুলো ঠিকভাবে লাগছিলো না। তাই জর্জকে বইয়ের উপরে বসিয়ে উচ্চতা বাড়ানো হয়। এবং যখন শক দেয়া হচ্ছে, তখন তীব্র ব্যথায় ছোট্ট শরীরটা কুকড়ে দুমড়েমুচড়ে যায়। এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময়ে যারাই ছিলেন ঘটনাস্থলে, তাদের কারো জন্যেই সুখকর ছিলোনা বিষয়টি। এভাবেই জর্জের ছোট্ট জীবনের ইতি ঘটে নিদারুণ এক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে।
যদিও এই ঘটনাটি কিছু প্রশ্ন তৈরী করে দিয়ে যায় মানুষের মনে। কেন এত তড়িঘড়ি করে মাত্র দুই ঘন্টার ট্রায়াল এবং দশ মিনিটের জুরি বিতর্কের পরেই এই রায়টি দেয়া হয়? আসামীপক্ষকে কেন সাক্ষ্য উপস্থাপনের জন্যেও সুযোগ দেয়া হয়না? তাছাড়া, পুলিশ দাবী করে, জর্জকে তারা জিজ্ঞেসাবাদ করেছে। তার কনফেশনও নেয়া হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে তারা সেই কনফেশনের কোনো রেকর্ড কেন দেখাতে পারেনা? তাছাড়া জিজ্ঞাসাবাদ তো এমনি এমনি করা যায় না, সেখানে উকিল উপস্থিত থাকতে হয়। সেই সুযোগটাও জর্জকে দেয়া হয়না। কেন?
আদালতের সিদ্ধান্তের পরেই খুব দ্রুতগতিতে জর্জের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। যেখানে প্রত্যেক মৃত্যুদণ্ডের আসামীকেই কিছু সময় দেয়া হয় নতুন কোনো যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্যে, নতুন কোনো এভিডেন্স দেখানোর জন্যে, সেখানে জর্জের ক্ষেত্রে আমরা কিছুই পাইনা। কেন? তাছাড়া জর্জের ফ্যামিলির একটা এ্যালিবাই ও ছিলো খুনের সময়ে জর্জের অন্য কোথাও অবস্থানের স্বপক্ষে। সেই অ্যাালিবাইটাও আমলে নেয়না কোর্ট। জর্জের পরিবার কিছু করতেও ভয় পায়, কারন ভিক্টিমের পরিবার প্রভাবশালী।জর্জের এই মামলাটা আবার কোর্টে ওঠে, ২০১৪ সালে । এবং খুনের ঘটনাটির ৭০ বছর পর জর্জকে এই মামলার দায় থেকে অব্যহতি দেয়া হয়। যদিও জর্জ তখন পৃথিবীর যেকোনো আইনেরই ধরাছোঁয়ার বাইরে।
আইনের খুব পরিচিত একটি টার্ম, ন্যাচারাল জাস্টিস। এই ন্যাচারাল জাস্টিসের একটা খুব প্রচলিত এক নীতি হচ্ছে- No one should be condemned Unheard.
মানে হচ্ছে, দুইপক্ষের কথা শুনেই রায় দিতে হবে। কারো কথা না শুনে কোনো রায় দেয়া বেআইনি। কিন্তু জর্জের কোনো কথাই শোনা হয়না এই মামলার সময়ে। তাছাড়া সন্দেহজনক ও রেকর্ডবিহীন কনফেশন, কাউকে না উপস্থিত রেখে অভিযুক্তকে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ... সবকি্ছুই অসাংবিধানিক বলে প্রমাণিত হয়। এবং জর্জ মুক্তি পায় দায় থেকে।
আমি এই ঘটনার সবচেয়ে বড় চমকটিকে রেখেছি আমার হাতের মুঠোর মধ্যে। এবার সেটা জানাই বরং। জর্জের এই মামলার সব তাড়াহুড়ো, সব ধোয়াঁশা, তাড়াতাড়ি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর, সবকিছুর পেছনে সবচেয়ে বড় কারন, জর্জ ছিলো ব্ল্যাক এবং খুন হওয়া মেয়ে দুটি ছিলো হোয়াইট!
রুবেন হ্যারিকেন কার্টারের ঘটনা হয়তো আমরা সবাই জানি, অথবা তাঁর জীবনীর উপরে ভিত্তি করে নির্মিত সিনেমা "The Hurricane" ও আমরা দেখেছি। যিনি ছিলেন বিখ্যাত এক বক্সার। তাকে জীবনের ত্রিশ বছর কাটাতে হয় জেলে, একটি মিথ্যে মামলার অপরাধী হয়ে। অবশ্য আরেকটি অপরাধ তাঁর ছিলো, সে ছিলো কৃষ্ণাঙ্গ। আইন, সমাজ, সংস্কার সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এভাবেই দশকের পর দশক টিকে থাকে বর্নবাদ। চামড়ার বৈষম্যের বলিকাষ্ঠে নির্মম পরিণতি হয় রুবেন কার্টারের অথবা জর্জ স্টিনি জুনিয়রের। এরকম কার্টার অথবা স্টিনির সংখ্যা অগুনতি। এভাবেই আস্তে আস্তে বর্নবাদ শেকড় ছড়ায় এক কাল থেকে আরেক কালে। সময় গড়ায়। জর্জ স্টিনির জায়গায় হয়তো জর্জ ফ্লয়েড আসে, কিন্তু বর্ণবাদের বিষবাষ্প থাকে আগের মতই। স্বমহিমায়।
এই গল্পটাও দিনশেষে তাই হয়ে থাকে তীব্র এক অবিচারের সাক্ষী। সাদা-কালোর দ্বন্দ্বের।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন