ব্লেকের জন্ম নেদারল্যান্ডে। অংশ নিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও। এরপর গুপ্তচরবৃত্তি শুরু করলেন ব্রিটিশদের হয়ে। কিন্তু আসলে তিনি আসলে ছিলেন রাশিয়ারই এজেন্ট। তার এই দ্বিচারিতার গল্প এমনই রোমহষর্ক, সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায় তা!

গুপ্তচরবৃত্তির ইতিহাসে বহু বৈচিত্র্যময় প্রজাতির মানুষ এসেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন গুপ্তচর সংস্থা যেমন- র, আইএসআই, এম আই সিক্স, কে জি বি এর নথিপত্র ঘাঁটলে এই কথার স্বপক্ষে তথ্য পাওয়া যাবে। তবে এসব মানুষদের মধ্যেও ডাবল এজেন্টরা ছিলেন আরেকটুকু স্বকীয়। চতুর্মাত্রিক বিপদ নিয়ে তারা নামতেন একের পর এক মিশনে। জলে কুমীর, ডাঙায় বাঘ... সূত্র মেনে তাদের নাভিশ্বাস ছিলো সর্বত্রই। দুই নৌকায় চলা এ মানুষগুলো জীবন বরাবরই থাকে শঙ্কার ত্রাসে। এরকমই  একজন ডাবল এজেন্ট ছিলেন জর্জ ব্লেক, যাকে ধরা হয় ইতিহাসের অন্যতম কুখ্যাত 'ডাবল এজেন্ট' হিসেবে৷ 

ব্লেককে নিয়ে কথা বলার আগে প্রথমেই জানতে হবে, ডাবল এজেন্ট কী, তা নিয়ে। ডাবল এজেন্ট নিয়ে আমাদের সাধারণ জ্ঞান যেটাই, সেটাই প্রকৃত তথ্য। অর্থাৎ যে মানুষটি একাধিক সংস্থার গুপ্তচরবৃত্তির সাথে জড়িত থাকে, তিনিই ডাবল এজেন্ট। 

জর্জ ব্লেকের জন্ম নেদারল্যান্ডসের রটারডামে। পরিবার প্রদত্ত নাম ছিলো জর্জ বেহার। ব্লেকের বাবা ব্রিটিশ বাহিনীর হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্যে তিনি ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পান। পরিবার নিয়ে ব্রিটেনে এসে তখন তিনি পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেন৷

তরুণ বয়সে জর্জ ব্লেক! 

ছোটবেলা থেকেই বাবার কাছ থেকে বিভিন্ন টেকনিকস, ট্যাকটিকস শিখে নেন ব্লেক। বাবার সংস্পর্শে থাকার কারণেই কী না, সে বরাবরই ভয়ডরহীন মানসিকতার ছিলো। পরবর্তীতে ব্লেক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণও করে। এরপর সে ব্রিটিশ-নিয়ন্ত্রিত ভূখন্ড জিব্রাল্টারেও চলে যায় একবার। 

অনেকদিন থেকেই ব্রিটিশ গুপ্তচর সংস্থা 'এম আই সিক্স' নজরে রাখছিলো ব্লেককে। যুদ্ধে অংশগ্রহণ, এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পালানো, মাথা খাটিয়ে টেকনিক আবিষ্কার করা... এসব কাজের জন্যে এই গুপ্তচর সংস্থা ব্লেককে তাদের সাথে কাজ করার প্রস্তাব দেয়।

ব্রিটিশ 'এম আই সিক্স' এর সাথে কাজ করা শুরু করে ব্লেক। এই সংস্থার সাথে কাজ করার সময়েই তিনি যুক্ত  হন রাশিয়ার 'কে জি বি' এর সাথেও। তিনি ডাবল এজেন্ট হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। শীতল যুদ্ধের সময় তিনি কমপক্ষে পাঁচশোরও বেশি পশ্চিমা গুপ্তচরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। শোনা যায়, পঞ্চাশ এর কাছাকাছি ব্রিটিশ এজেন্টকে তিনি সেসময়ে মারতে সাহায্য করেছিলেন। 

কিন্তু তার এই হঠকারিতার কথা পরবর্তীতে জানতে পারে এম আই সিক্স। মাইকেল গোলেনিয়েস্কি নামের এক পোলিশ এজেন্ট 'কে জি বি' ত্যাগ করে চলে আসে 'এম আই সিক্স' এ। এখানে আসার পরেই সে ব্লেকের গোমর ফাঁস করে দেয়। সে জানিয়ে দেয়, ব্লেক 'কে জি বি'র কাছে নিয়মিতই ফাঁস করে দিচ্ছে তথ্য। সে একজন ডাবল এজেন্ট ছাড়া আর কিছুই না! 

ব্লেককে তখন গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য বলে দেন তিনি। তীব্র নির্যাতনের পরে তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পাঁচ বছর জেলে থাকার পরে সেখান থেকে নাটকীয়ভাবে পালিয়ে যান তিনি। চলে যান রাশিয়ায়। সেখানেই ছিলেন এত বছর।

তবে ইংল্যান্ডের নাকের ডগায় বসে ইংল্যান্ডের এত বড় ক্ষতি তিনি করেছেন, অথচ কাকপক্ষীতেও কিছু টের পায় নি, এই ঘটনা 'এম আই সিক্স' এর গ্রহণযোগ্যতাকে সে সময়ে বড়সড় এক ধাক্কা দিয়েছিলো। এ কারণে ব্রিটেনে এখনো তাকে দেখা হয় ঘৃণার চোখে। অন্যদিকে রাশিয়ায়  'কেজিবি'র সদস্যরা বরাবরই তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছে একজন হিরো হিসেবে।

মুদ্রাত দুইপিঠে দুই চরিত্রের এই বিখ্যাত-কুখ্যাত মানুষটি মারা গিয়েছেন সম্প্রতি। মস্কোর গনমাধ্যমের বরাতেই জানা গিয়েছে এ সংবাদ। ব্রিটেনের কারাগার থেকে ব্লেকের নাটকীয়ভাবে পালানোর এ ঘটনা নিয়ে নির্মিত হয়েছে 'সেল মেটস' নামের নাটক। তাকে নিয়ে তথ্যচিত্রও নির্মিত হয়েছে সময়ে সময়ে। বিতর্ক, পক্ষে-বিপক্ষের যুক্তি মিলিয়ে জর্জ বেহার অথবা জর্জ ব্লেক, ব্রিটিশ 'এম আই সিক্স' এজেন্ট অথবা রাশিয়ান 'কেজিবি' গুপ্তচর হয়ে দুরন্ত অ্যাডভেঞ্চারের এক জীবনই কাটিয়েছেন এই মানুষটি।


*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন




 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা