জেনারেল জ্যাকব: যার চাতুর্য আর বুদ্ধিমত্তা বোকা বানিয়েছিল নিয়াজিকে!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ভারতের সৈন্য সংখ্যা মাত্র তিন হাজার, আর ঢাকাতেই পাকিস্তানী সেনা আছে সাতাশ হাজারের বেশি! আরও কিছুদিন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটা সমস্যা ছিল না, তবুও নিয়াজি আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, জেনারেল জ্যাকবের 'ব্লাফ গেমে' বিভ্রান্ত হয়ে...
আপনার ক্ষমতা নাই কিন্তু আপনি হ্যাডম নিতে জানেন? আপনি জিতবেন।
আত্মসমর্পণের দলিলের একটা খসড়া নিজেই তৈরি করেছিলেন জেনারেল জ্যাকব। দিল্লির সঙ্গে কোনও পরামর্শ না করেই! তার হাইকমান্ডের নির্দেশনা ছিল চট্টগ্রাম আর খুলনা দখলদার মুক্ত করার। মূলত ভারত সেনাবাহিনীর প্ল্যান ছিল পাকিস্তানকে ইউএন রেগুলেশনের আওতায় যুদ্ধ বিরতিতে বাধ্য করা। এদিকে পাকিস্তানেরও মানসিক প্রস্তুতি ছিল ইউএন রেগুলেশনের আওতায় যুদ্ধবিরতির দিকে যাওয়ার। মাঝেখানে কেবল শর্তগুলো নিয়ে দর কষাকষির কারবার চলছিল। কিন্তু এই পাগল লোকটা তখন অন্য প্ল্যানে হাঁটছিলেন।
কোন প্রটেকশন ছাড়াই নিয়াজির কাছে গিয়ে সোজা জানিয়ে দিলেন যুদ্ধবিরতি-ফিরতি মানা যাবে না, এই উন্মুক্ত আত্মসমর্পণের দলিল আধঘণ্টার মধ্যে মেনে নিতে হবে, নইলে ঢাকায় এক্ষুণি বম্বিং শুরু করব। আর মেনে নিলে আপনার সব সেনার সুরক্ষার দায়িত্ব আমার। তাদের গায়ে কেউ হাত দেবে না!’
নিয়াজি হতভম্ব হয়ে বসে আছে। জ্যাকব তখন দলিলের খসড়াটা তার চোখের সামনে দোলালেন। বললেন, ‘আপনি চুপ করে থাকলে আমি ধরে নিচ্ছি আপনারা এটা মেনে নিচ্ছেন।’ বলেই ব্যাস কোমরে পিস্তল ঝুলিয়ে যেমন নাটকীয়ভাবে ঢুকেছিলেন, সেভাবেই বেরিয়ে গেলেন।
জেনারেল জ্যাকব নিয়াজিকে বুঝতেই দেননি ঢাকায় তার হাতে মাত্র হাজার তিনেক সেনা ছিল। অথচ শুধু ঢাকাতেই পাকিস্তানি সেনার সংখ্যা তখন ভারতীয় সেনার প্রায় নয়গুণ! সাতাশ হাজারের কাছাকাছি।
আত্মসমর্পণ না-করেও অনায়াসে আরও অন্তত ১৫দিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারত পাক বাহিনী। ততদিনে জাতিসংঘের আলোচনায় কী ফল হয় অপেক্ষা করা যেত তার জন্যও। কিন্তু জ্যাকব এমন একটা ধারণা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন যে ঢাকার পতনের আর এতটুকুও দেরি নেই। আত্মসমর্পণ না করলে জেনারেল নিয়াজি ও তার সঙ্গীদের মৃত্যু অবধারিত।
আর একারণেই ভারতের বিখ্যাত সামরিক গবেষক ও ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজের প্রধান মেজর জেনারেল দীপঙ্কর ব্যানার্জি মনে করেন– জ্যাকব নিয়াজির সঙ্গে যা-করেছিলেন তা বিশ্বের সামরিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ‘ব্লাফ’ বা ‘ধোঁকা’গুলোর একটা। এমন একটা ব্লাফ দিয়ে তিনি পাকিস্তানিদের ওপর সাংঘাতিক একটা মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করতে পেরেছিলেন। যে কারণে তারা বেশ অপ্রত্যাশিতভাবেই আত্মসমর্পণে রাজি হয়ে যায়। তারা বোঝেওনি যে ভারতের সঙ্গে মাত্র তিন হাজার সেনা আছে। এর পেছনে পুরো কৃতিত্ব জ্যাকবের বুদ্ধিমত্তাকেই। কারণ পাকিস্তানিদের কিন্তু সারেন্ডার না করলেও চলত।
পরে যুদ্ধের তদন্তে গঠিত পাকিস্তানে জাস্টিস হামিদুর রহমান কমিশন যখন নিয়াজিকে প্রশ্ন করেছিল প্রায় সাতাশ হাজার সেনা সঙ্গে নিয়েও তিনি কেন আত্মসমর্পণ করলেন? তখন নিয়াজির উত্তর ছিল ‘জ্যাকব আমায় ব্ল্যাকমেল করেছে যে আমার পরিবারকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারার হবে’।
১৯৭৮ সালে অবসরে যান জেনারেল জ্যাকব। মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্বের বড় অংশ দাবী করে যেই ভারত সেই ভারত এই জেনারেল জ্যাকবকে সেনাপ্রধান করেনি। ১৩ই জানুয়ারি ২০১৬ সালে জেনারেল সাহেব মারা যান।