পুঁচকে একটা দেশ হয়েও আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়া মামলা করেছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। দেখিয়ে দিয়েছে, দেশ ছোট হলেই মানুষগুলোর কলিজা ছোট হবে- এমন কোন কথা নেই...

রোহিঙ্গা নিপীড়নের দায়ে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত- আইসিসিতে শুনানি চলছে মিয়ানমারের নামে। মিয়ানমারের দুই সেনা সদস্য সেখানে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর অভিযানের সময় কাউকে দেখামাত্রই গুলির নির্দেশ ছিল সেনা সদস্যদের প্রতি। শিশু থেকে বৃদ্ধ, কেউ যেন বাদ না যায় গুলির টার্গেট থেকে। সপ্তাহখানেক আগের ঘটনা এটা। শুনানি চলবে আরও বেশ কিছুদিন, নিপীড়িত রোহিঙ্গারা ন্যায়বিচার পাবে কিনা, সেটা সময় বলে দেবে। আজ বরং এমন একটা দেশের কথা বলি, যারা এই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পক্ষ নিয়ে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতে টেনে এনেছে। দেশটার নাম গাম্বিয়া। 

আফ্রিকার মানচিত্রে যে দেশটিকে খুঁজে পেতে গেলে মিনিটখানেক চেষ্টা করতে হয়, সেই গাম্বিয়াই কাঁপিয়ে দিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের ভিত। আমেরিকা-চীন বা ভারত-পাকিস্তান, সৌদি আরব কিংবা তুরস্কের মতো প্রভাবশালী দেশগুলো রোহিঙ্গা নির্যাতনের ইস্যুতে চুপ ছিল, নজর ফিরিয়ে নিয়েছিল অন্যদিকে, সেখানে পুঁচকে একটা দেশ হয়েও গাম্বিয়া আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করেছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। গাম্বিয়া দেখিয়ে দিয়েছে, দেশ ছোট হলেই মানুষগুলোর কলিজা ছোট হবে- এমন কোন কথা নেই।

কিন্ত গাম্বিয়া কেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে এত চিন্তিত? গাম্বিয়া মুসলিম দেশ, শতকরা ৯৬ জন নাগরিক মুসলমান, সেটা একটা কারণ হতে পারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ করার। কিন্ত সৌদি-তুরস্ক বা পাকিস্তানের মতো মুসলিম দেশ তো রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে নাক গলাতে চায়নি। নিজেকে মুসলিম বিশ্বের ত্রাতা ভাবা এরদোয়ান এক জাহাজ ত্রাণ পাঠিয়েই দায়িত্ব খালাস করেছেন। তাহলে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর পেছনে গাম্বিয়ার যুক্তিটা কী? সেটা জানতে হলে, জানতে হবে গাম্বিয়ার ভূজ-রাজনৈতিক ইতিহাস। 

মানচিত্রে সাদা রঙের সরু অংশটাই গাম্বিয়া

গাম্বিয়া নামের দেশটাকে খুঁজতে গেলে গলদঘর্ম হতে হবে। সেনেগালের একদম পেটের ভেতরে লম্বা নলের মতো ছোট্ট একটা দেশ, সেদেশের বুক চিরে বয়ে চলেছে গাম্বিয়া রিভার। আর এই নদীর দুইপাশের নীচু জমিতেই গড়ে উঠেছে জনবসতি। গাম্বিয়ার নাগরিক যারা, তাদের পূর্বপুরুষেরা এসেছিলেন সুদানের দক্ষিণাঞ্চল, কঙ্গো এবং নাইজেরিয়া থেকে। আটশো বছর আগে সর্বপ্রথম বসতি স্থাপন করা হয়েছিল এখানে, সপ্তদশ শতকে ফরাসীরা দখলে নেয়ার আগে পর্যন্ত আদিবাসীদের আবাসস্থল হিসেবেই পরিচিত ছিল জায়গাটা। 

আয়তনে গাম্বিয়া বাংলাদেশের দশ ভাগের এক ভাগও নয়। আরও স্পষ্ট করে বললে, আয়তনের দিক থেকে গাম্বিয়া আসলে আমাদের সিলেট বিভাগের চেয়েও ছোট, আর রাঙামাটি জেলার চেয়ে একটু বড়। ১৯৬৫ সালে ইংরেজরা গাম্বিয়া ছেড়ে গিয়েছিল, স্বাধীনতা পেয়েছিল দেশটা। সেই থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা অটুট ছিল গাম্বিয়ায়। 

১৯৯৪ সালে প্রেসিডেন্ট দাউদা জাওয়ারাকে এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রেসিডেন্টের পদ দখল করেন উনত্রিশ বছর বয়স্ক সেনা কর্মকর্তা ইয়াহিয়া জাম্মেহ। গাম্বিয়ার ইতিহাসের একটা কালো অধ্যায় ছিল সেটা। দরিদ্র‍্য একটা দেশ, কৃষিকাজ ছাড়া এখানকার অধিবাসীদের করার তেমন কিছু নেই, বেশিরভাগ মানুষই দিন আনে দিন খায়- তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হলো একনায়কতান্ত্রিক সেনা শাসন। রাজনীতিবিদেরা গেল জেলে, দেশজুড়ে দাপিয়ে বেড়াতে লাগলো আর্মি অফিসারেরা। 

গাম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাম্মেহ

বিপক্ষ দলের রাজনীতিবিদদের ওপর নেমে এলো অত্যাচারের স্টিম রোলার, একটা সময়ের পরে সেই নির্যাতনের শিকার হলো সংখ্যালঘু খ্রিস্টানরাও। লোক দেখানো কিছু নির্বাচন হয়েছে এর মধ্যেও, কিন্ত সেগুলোতে ব্যপকভাবে ম্যানুপুলেট করা হয়েছে ফলাফলকে। গাম্বিয়ার মানুষের মধ্যে শিক্ষার হারটা তুলনামূলক কম, তাদের মনে সাম্প্রদায়িক একটা সহিংসতার বীজ ঢোকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সাংবাদিক বা ছাত্রনেতা সহ অনেকেই গত একযুগে গাম্বিয়া ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়ে।

২০১৭ সালে জনগণ এসবের জবাব দিলো ব্যালটের মাধ্যমে, নির্বাচনে হেরে গেলেন স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া। অবসান হলো বাইশ বছরের স্বৈরশাসনের, ফিরে এলো গণতন্ত্র। ক্ষমতায় বসলেন নতুন প্রেসিডেন্ট আদামা ব্যারো। বিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করলেন তিনি। তারপর ধর্মান্ধতাকে ছেঁটে ফেলার মিশিন নামলেন। সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ভুক্তভোগী গাম্বিয়া নিজে, আর তাই মিয়ানমারে যখন রোহিঙ্গারা নির্যাতিত হচ্ছে ধর্মের কারণে, তখন সেদেশের সরকার আর মানুষ দাঁড়িয়েছে বিপন্ন এই জাতির পাশে, মামলা করেছে মিয়ানমারের বিপক্ষে। 

সেই মামলা সামলাতে গিয়ে এখন কালোঘাম ছুটে যাচ্ছে মিয়ানমারের। গতবছর শুনানিতে অংশ নিতে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচী সৈন্য-সামন্ত নিয়ে ছুটে গেছেন নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে, হত্যাকান্ডের কথা নত মস্তকে স্বীকার করে নিয়েই তিনি দাবী করছেন, এই বিচার করার এখতিয়ার আন্তর্জাতিক আদালতের নেই! সুচীর মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেছে, সেই কাজটা করেছে গাম্বিয়া। মামলার পুরো প্রক্রিয়াটা সাজিয়েছেন গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মামাদু তাঙ্গারা, এই দুটো মানুষের কাছে বিশ্ববাসী চিরঋণী হয়ে থাকবে।

আবুবকর মারি তাম্বাদু

গাম্বিয়া ছোট্ট একটা দেশ, অল্প জায়গায় অনেকগুলো মানুষ বাস করে, প্রাকৃতিক কোন সম্পদ নেই, দারিদ্র‍্যসীমার নিচে বাস করে বেশিরভাগ মানুষ। তবুও তারা জানিয়েছে, রোহিঙ্গারা যদি রাজী হয়, তাহলে কিছু রোহিঙ্গাকে তারা নিজেদের দেশে আশ্রয় দিতে পারে। আমেরিকা যখন মেক্সিকো সীমান্তে কাঁটাতার দিচ্ছে, এনআরসির নাম করে লাখ লাখ মানুষকে দেশছাড়া করার মিশন হাতে নিয়েছে ভারত সরকার; শরণার্থীর ঢল সামলাতে ইউরোপ যখন নিরাপত্তা ব্যবস্থা কড়া করছে, সাগরের তীরে পড়ে থাকছে আয়লান কুর্দীর মৃতদেহ- সেই অমানবিকতার সময়টায় গাম্বিয়ার এমন মানবতাবোধ আমাদের আপ্লুত করে ভীষণ... 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা