আমেরিকা-ভারত পাত্তা দেয়নি, চীন উল্টো মিয়ানমারের পাশে দাঁড়িয়েছে। সৌদি, পাকিস্তান, তুরস্ক- কেউই ঝামেলায় যেতে চায়নি। অথচ আফ্রিকান দেশ গাম্বিয়া রোহিঙ্গা-কান্ডে মিয়ানমারকে আদালতে তুলে ছেড়েছে!

কাজটা করার কথা ছিল পরাশক্তিগুলোর, আমেরিকা, চীন বা রাশিয়ার। করার কথা ছিল মুসলিম বিশ্বের ধ্বজ্বাধারী দেশ সৌদি আরব, তুরস্ক বা পাকিস্তানের। প্রতিবাদটা আসা উচিত ছিল শক্তভাবে। তারা কিছুই করেনি, কেউ নির্লিপ্ত থেকেছে, কেউবা এক-দুই জাহাজ ত্রাণ পাঠিয়ে লোকদেখানো হাততালি কুড়িয়ে নিয়েছে, কাজের কাজ না করে উল্টো হিরো সাজার চেষ্টা করেছে এরদোয়ানের মতো রাষ্ট্রপ্রধানও। 

রোহিঙ্গারা যখন গুলি খেয়ে মরছিল, তখন বাংলাদেশ নিজেদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও এই বিশাল জনসংখ্যাকে আশ্রয় দিয়েছে। আর সুদূর আফ্রিকার এক দেশ গাম্বিয়া, নামটা শুনে মানচিত্রে খুঁজে নিতে যাদের অবস্থান, সেই দেশটা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করেছে, সেই মামলার রায়ে আন্তর্জাতিক আদালত বলেছে, রোহিঙ্গা গনহত্যা ও নির্যাতন নিয়ে সব নথিপত্র আদালতের কাছে জমা দিতে হবে, রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে মিয়ানমারকে। অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে মানবতার এই জয়ে গাম্বিয়া সবচেয়ে বড় ধন্যবাদটা ডিজার্ভ করে।

রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে গাম্বিয়া হুট করেই মাথা ঘামাচ্ছে না, সেই ২০১৭ সালে যখন কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গাদের ঢল নেমেছিল, স্বজনহারা ঘর-বাড়ি ছাড়া মানুষগুলো প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে যখন পাড়ি দিচ্ছিল জন্মভূমি, তখন গাম্বিয়া হয়তো টাকার বস্তা নিয়ে হাজির হতে পারেনি, জাহাজ ভর্তি করে ত্রাণ সামগ্রী পাঠাতে পারেনি, কিন্ত তারা খোঁজখবর রেখেছে পুরো ঘটনাটার, গাম্বিয়ার মন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্তারা কয়েক দফাত ঢাকায় এসেছেন, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে গিয়েছেন।

মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের বাইরে তৃতীয় কোন দেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যেতে চাইলে গাম্বিয়া যে তাদের একটা অংশকে আশ্রয় দিতে ইচ্ছুক, সেটাও তারা জানিয়েছিল তখন। গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হয়েছে, দ্বিপাক্ষীয় আলোচনায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে না, কারণ মিয়ামনার চায় না রোহিঙ্গারা সেদেশে ফিরে যাক। 

আন্তর্জাতিক আদালতে অং সান সু চি

গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু এবছর ঢাকায় ওআইসি সম্মেলনে এসে বলেছিলেন, রুয়ান্ডার গণহত্যা আর মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধন একই পর্যায়ের অপরাধ, কাজেই এটার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে হওয়া দরকার। সেই কাজটাই গাম্বিয়া করেছে, নভেম্বরে তারা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা করেছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। 

সেই মামলা সামলাতে গিয়ে কালোঘাম ছুটে গেছে মিয়ানমারের। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চী তার সৈন্য-সামন্ত নিয়ে ছুটে গেছেন সেখানে, হত্যাকান্ডের কথা নত মস্তকে স্বীকার করে নিয়েই তিনি দাবী করছেন, এই বিচার করার এখতিয়ার আন্তর্জাতিক আদালতের নেই! সুচীর মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেছে, সেই কাজটা করেছে গাম্বিয়া। শেষমেশ মিয়ানমারকে মামলায় হারিয়ে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচার পাবার একটা আশা জাগিয়ে তুলেছে তারা। 

মামলার পুরো প্রক্রিয়াটা সাজিয়েছেন গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মামাদু তাঙ্গারা, এই দুটো মানুষের কাছে বিশ্ববাসী চিরঋণী হয়ে থাকবে। মামাদু তাঙ্গারার কথা একটু বিশেষভাবেই বলতে হবে এখানে। অতীতে দুই দফায় জাতিসংঘে নিজের দেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন ভদ্রলোক। খুব স্বাভাবিকভাবেই, রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি সম্পর্কে তিনি আগে থেকেই জানতেন। ফলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনিও রোহিঙ্গাদের জন্যে গাম্বিয়ার ভূমিকা রাখার বিষয়ে অবদান রেখেছেন। 

গাম্বিয়ার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করছেন মামাদু তাঙ্গারা

মামাদু জানতেন, গাম্বিয়ার একার সামর্থ্য নেই মিয়ানমারকে আদালতে তোলার, এটা বিশাল খরচের ব্যাপার, তাছাড়া মিয়ানমারের পেছনে আছে পরাশক্তি চীনের সমর্থন। তাই বিষয়টা যাতে জটিল না হয়, তাই মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে বারবার বসেছেন তিনি, তাদের বুঝিয়েছেন, নিজের ঘাড়ে বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ করার অঙ্গীকার করেছেন, শুধু বলেছেন, পেছন থেকে তাদেরকে যেন সমর্থন দেয়া হয়।

সেই সমর্থন দিতে রাজী হয়েছে ওআইসি। এর আগে সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান বা তুরস্কের মতো দেশকে সংস্থাটি অনুরোধ করেছিল মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। কিন্ত সুবিধাবাদী এই দেশগুলো রাজী হয়নি তাতে। গাম্বিয়া যখন নিজ থেকেই এই কাজটা করতে রাজী হয়েছে, তখন ওআইসি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, ফান্ড গঠন করে মামলার খরচ যোগাচ্ছে, তাতে সাহায্য করছে তুরস্ক আর সৌদি আরবও। 

আদালতের রায় মিয়ানমারের বিপক্ষে গেছে, শেষ পর্যন্ত সেই রায়ের বাস্তবায়ন কতটুকু হবে আমরা জানিনা। কিন্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে গাম্বিয়া যে পদক্ষেপটা নিয়েছে, সেটাকে সবাই মনে রাখবে নিশ্চয়ই। স্বার্থের পৃথিবীতে আমেরিকা যখন নিশ্চুপ থাকে, চীন যখন মিয়ানমারের কাঁধে হাত রাখে, ভারত যখন 'রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের আভ্যন্তরীন ইস্যু' বলে ব্যাপারটাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চায়, কিংবা পাকিস্তান-সৌদি-তুরস্কের মতো মুসলিম দেশগুলোও যখন রোহিঙ্গাদের ওপর হওয়া নির্যাতন নিয়ে আদালতে যাওয়াটাকে দরকার মনে করেনি, তখন গাম্বিয়ার এই পদক্ষেপটাকে দুঃসাহস বললেও বোধহয় কম বলা হবে। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা