গাব্বার সিং এর মতো ভয়ঙ্কর খলনায়ক হিন্দি চলচ্চিত্র আগে দেখেনি। আমজাদ খানকে বেশিরভাগ লোকে গাব্বার নামেই চিনতো, তার আসল নামটা ঢাকা পড়েছিল ফিল্মি ক্যারেক্টারের আড়ালে...

জন্ম হয়েছিল শিল্পীর পরিবারে, বাবা ছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা। নিজেও অভিনেতা হতে চেয়েছেন সবসময়, নায়ক হবার বাসনা নিয়ে এসেছিলেন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রীতে। কিন্ত ভাগ্যের লিখন ছিল অন্যরকম, নায়ক নয়, ভাগ্য তাকে খলনায়ক বানিয়েছিল। রঙিন পর্দায় নায়ককে বাধা দেয়াই যার কাজ। তাতে মানুষটার আক্ষেপ ছিল না কোন। হিন্দি সিনেমা যতদিন থাকবে, থাকবে নায়কের সঙ্গে খলনায়কের অবশ্যম্ভাবী দ্বন্দ্বও। আর সেইসাথে উচ্চারিত হবে তাঁর নামও। উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে খলনায়কের সংজ্ঞাটাই পাল্টে দিয়েছিলেন যিনি, ভিলেন রোলটাকে নিয়ে গিয়েছিলেন অন্যরকম এক উচ্চতায়, সেই মানুষটার নাম আমজাদ খান, গাব্বার সিং নামে যাকে সবাই চেনে! 

ব্রিটিশ ভারতের পেশোয়ারে জন্ম তাঁর, আবার অনেকের মতে, তিনি জন্মেছিলেন হায়দরাবাদে। বাবা জয়ন্ত খান অভিনয় করতেন সিনেমায়, ছেলেরাও বাবার পতেই হাঁটলো সবাই। মাত্র এগারো বছর বয়সেই আমজাদ খান শিশুশিল্পী হিসেবে হাজির হলেন পর্দায়, সিনেমার নাম 'নাজনীন'। থিয়েটারে ভর্তি হলেন, এরমধ্যে চলছিল পড়াশোনাও। তবে কলেজে পড়াশোনা নয়, রাজনীতিটাই তাঁর কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাগতো।

কলেজের ছাত্রসংঘের জেনারেল সেক্রেটারীও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি, বড়ভাই সুলভ একটা ভাব নিয়েই ক্যাম্পাসে ঘুরতেন। হাবভাব আর গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বরের জন্যে অন্য ছাত্ররা বেশ ভয় করতো তাঁকে। 

১৯৫৭ সাল, বয়স তখন সতেরো। বাবার সঙ্গে একই সিনেমায় হাজির হলেন তিনি, নাম 'আব দিল্লি দূর নাহি'। সেখানেও খুব বেশী স্ক্রীনটাইম ছিল না তাঁর। সেভাবে ব্রেক পাচ্ছিলেন না সিনেমা জগতে, বলিউডের অবস্থাও তখন তেমন ভালো নয়। চলছিল থিয়েটারে কাজ, মাঝে এক পরিচালকের সহকারী হিসেবেও কাজ করেছেন কিছুদিন।

অবশেষে ১৯৭৩ সালে পরিপূর্ণ অভিনেতা হিসেবে ইন্ডাস্ট্রীতে অভিষেক হলো তাঁর, 'হিন্দুস্তান কি কসম' নামের সিনেমায়। রাজ কাপুর অভিনীত সেই চলচ্চিত্রে আমজাদ খান অভিনয় করেছিলেন পাকিস্তান এয়ারফোর্সের একজন পাইলট হিসেবে। কিন্ত হিসাব-নিকাশ সবকিছু পাল্টে দিলো এর দুইবছর পরে মুক্তি পাওয়া একটা সিনেমা। 

যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বলিউডের সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংলাপ কোনটা? দিলীপ কুমার, অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ-সালমান-আমির নন, এতসব নায়ককে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সেরা সংলাপটা এক খলনায়কের। 'শোলে' সিনেমার 'আরে ও সাম্বা, কিতনে আদমী থে' ডায়লগটা এখনও ঘুরেফেরে লোকের মুখে, অমিতাভ-ধর্মেন্দ্র দুই সুপারস্টারের সিনেমায় সবটুকু আলো নিজের দিকে টেনে নিয়েছিলেন আমজাদ খান, ছয় ফুট উচ্চতার মানুষটা এই এক সিনেমা দিয়েই জয় করে নিয়েছিলেন কোটি ভারতীয়র হৃদয়।

ডাকু গাব্বার সিং-এর রোলটা পর্দায় ঠিকঠাকভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্যে মোটামুটি আদাজল খেয়ে পড়েছিলেন আমজাদ, বইপত্র পড়ে প্রস্ততি নিয়েছিলেন। সেটার প্রতিফলন সবাই দেখেছে, বলিউডের ইতিহাসে ভিলেন বলতে সবাই গাব্বার সিংকেই বোঝে। 

শোলে-কে বলা হয় বলিউডের অলটাইম ব্লকবাস্টার সিনেমাগুলোর একটি। অমিতাভ বচ্চন-ধর্মেন্দ্র কিংবা হেমা মালিনী নয়, আমজাদ খানের অভিনয়েই অনবদ্য হয়ে আছে শোলে। গাব্বার সিং-এর মতো ভয়ঙ্কর খলনায়ক হিন্দি চলচ্চিত্র আগে দেখেনি, ভিলেন রোলে এমন অসাধারণ অভিনয়ও পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে পারেননি কেউ, আমজাদ খান তাই অনন্য একজন।

সিনেমার গাব্বারের ভয় দেখিয়ে বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতেন মায়েরা, আর রঙিন পর্দায় আমজাদ খানের অভিনয়কে স্ট্যান্ডার্ড ধরেই বিচার করা হতো অন্য ভিলেনদের অভিনয়ের। ‘শোলে' করার পরে ভিলেন রোলে নিয়মিত হয়ে পড়লেন, ১৯৭৫ সালে যখন শোলে মুক্তি পায়, আমজাদ খানের বয়স তখন মাত্র পঁয়ত্রিশ! গাব্বার সিং হিসেবে তিনি হাজির হয়েছেন বিজ্ঞাপনেও! পার্লে জি বিস্কুটের বিজ্ঞাপনে অভিনয় করেছিলেন আমজাদ খান, খলনায়ক চরিত্রের কাউকে দিয়ে সেটাই প্রথম বিজ্ঞাপণ নির্মাণ!

ক্যারিয়ারে ওড়ার সময়টাতেই তাঁর জীবনে নেমে এলো দূর্যোগ। ১৯৭৬ সালে সিনেমার শুটিঙে অংশ নিতে বোম্বে-গোয়া হাইওয়ে ধরে নিজেই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। একটা গাছের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় তাঁর গাড়ির, কোমায় চলে যান এই বরেণ্য অভিনেতা। মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যায় তাঁর, মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় হয় ফুসফুস। তবে কোমা থেকে ফিরে আসেন তিনি। কিন্ত অপারেশন আর ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় শরীর মোটা হতে শুরু করেছিল তাঁর।

এরমধ্যেও খানিকটা সুস্থ হয়ে শুটিং চালিয়ে গেছেন তিনি। খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন শতাধিক সিনেমায়। নিজের অভিনয় নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নীরিক্ষাও চালিয়েছেন তিনি, সত্যজিৎ রায়ের 'শতরঞ্জ কে খিলাড়ি'র মতো সিনেমায় চ্যালেঞ্জিং রোলেও দেখা গেছে তাঁকে। ক্যারিয়ারজুড়ে মোট একশো ত্রিশটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি, দর্শকদের দেখিয়েছেন, ভিলেন আসলে এমন হয়, সমসাময়িক আর অনুজদের বার্তা দিয়েছেন, খলচরিত্রে অভিনয়টা এভাবে করতে হয়! 

পর্দায় নানারকমের শয়তানীতে মত্ত থাকলেও, ব্যক্তিজীবনে একদম নিপাট ভদ্রলোক ছিলেন মানুষটা। ১৯৭২ সালে বিয়ে করেছেন, এক ছেলে আর এক মেয়ের জনক তিনি, কখনও তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে জলঘোলা হয়নি মিডিয়ায়। ছিলেন অ্যাক্টরস গিল্ডের সভাপতি, সবাই দারুণ শ্রদ্ধা করতো তাঁকে। নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়েই সেটা আদায় করে নিয়েছিলেন তিনি।

অভিনেতাদের স্বার্থরক্ষায় বরাবরই ছিলেন আপোষহীন, অভিনেত্রী ডিম্পল কাপাডিয়াকে যখন প্রযোজক সমিতি বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তখন তিনিই মধ্যস্ততা করেছিলেন দুই পক্ষের মধ্যে। পর্দায় না হলেও, বাস্তব জীবনে তিনি ছিলেন অনুকরণীয় আদর্শ। ওজন ক্রমাগত বেড়েই চলছিল, শরীরও খারাপ হয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। কাজের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯২ সালের সাতাশে জুলাই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে পরপারে পাড়ি জমান এই গুণী অভিনেতা, সিনেমা জগতে খলনায়কের সংজ্ঞাটা বদলে গিয়েছিল যাঁর হাত ধরে, ভিলেন শব্দটা উচ্চারিত হলেই এখনও যাঁর চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা