ওয়াচম্যান ফ্রাঙ্ক উইলসের তাৎক্ষণিক বিচক্ষণতার কারণেই ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ব্যাপারটি নজরে এসেছিল গোটা পৃথিবীর, পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন মহা-ক্ষমতাধর মার্কিন প্রেসিডেন্ট। অথচ হাওয়ার্ড ইউনিভারসিটি তাকে চাকরী দেয়নি, কারণ তাকে নিয়োগ দিলে ফেডারেল ফান্ডিং বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় ছিল তাদের। টেকেনি জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির সিকিউরিটি গার্ডের চাকরীটাও। হঠাৎ পাওয়া খ্যাতি তার জীবনে ভালো কিছু বয়ে আনেনি। দিয়েছে দারিদ্র, হতাশা, একাকীত্ব। মুদ্রার আরেক পিঠ বুঝি একেই বলে! 

১৭ জুন, ১৯৭২। হোটেল ওয়াটারগেট,ওয়াশিংটন ডি.সি.। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তখন বইছে নির্বাচনের হাওয়া। ওয়াটারগেট হোটেলের ৬ষ্ঠ তলায় ছিল ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির কার্যালয়। ভোরবেলায় রুটিন টহলে নিয়োজিত ছিলেন ওয়াচম্যান ফ্রাঙ্ক উইলস। টহল দিতে গিয়ে অদ্ভুত একটা বিষয় লক্ষ করেন তিনি। তিনি দেখেন ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির কক্ষের দরজায় লক ডাক্টটেপ লাগানো। এটা এমন এক ধরণের টেপ যেটা দরজার লকে লাগানো থাকলে দরজার লক লেগে যাবে না। অর্থাৎ নির্ঘাত ভিতরে কেউ আছে। ফ্রাঙ্ক উইলস ব্যাপারটাকে প্রথমে গুরুত্ব দিলেন না, ভাবলেন কোন কর্মী হয়তো ইচ্ছা করে এভাবে টেপ দিয়ে গেছে যেন ভিতরে ঢুকতে সুবিধা হয়। তিনি টেপটা তুলে ফেললেন। কিন্তু ঘন্টাখানেক পর এসে আবারো দেখলেন একই জায়গায়, একই রকম টেপ লাগানো। সাথে সাথেই পুলিশকে ফোন করলেন তিনি। পুলিশ এসে সেই কক্ষ থেকে গ্রেফতার করলো পাঁচ ব্যক্তিকে। আর এভাবেই জন্ম হলো বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত ঘটনা- ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি! 

পরবর্তীকালে তদন্তে এবং ওয়াশিংটন পোস্টের দুই সাংবাদিক কার্ল বার্নস্টেইন এবং বব উডওয়ার্ডের ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বেড়িয়ে আসে- অনুপ্রবেশকারী ঐ পাঁচ ব্যক্তি ছিল ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান দল এবং প্রশাসনের সাথে যুক্ত, যারা গোপনে ডেমোক্রেটিক দলের কার্যালয়ে প্রবেশ করে তাদের নির্বাচনী প্রচারণা কৌশল সম্পর্কিত গোপন তথ্য হাতিয়ে নিতে চেয়েছিলেন! ঐ পাঁচ ব্যক্তির রিপাবলিকান দলের সাথে সম্পৃক্ততার কারণেই অভিযোগের আঙুল ওঠে তৎকালীন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের বিরুদ্ধে। কিন্তু তিনি এটাকে ষড়যন্ত্র এবং বিরোধীদের অপপ্রচার হিসেবে অস্বীকার করেন। শুধু তাই নয়, সেবার নির্বাচনে তিনি ৫০ রাজ্যের মধ্যে ৪৯ টিতেই জয়ী হয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেও ওয়াশিংটন পোস্টের ঐ দুই সাংবাদিক কিন্তু থেমে থাকেননি। তারা তাদের মত করে তদন্ত চালিয়ে যান। গ্রেফতার হওয়া ঐ পাঁচ ব্যক্তির কাছে পাওয়া গিয়েছিল নগদ ২৩০০ ডলার, যার প্রায় সবই ছিল ১০০ ডলারের নোট। পরবর্তীতে এই ১০০ ডলারের নোটের নাম্বার মিলিয়ে দেখা যায় এগুলো ব্যাংক থেকে নিক্সনের নির্বাচনী প্রচারণার কাজে ব্যবহারের জন্য তোলা ডলারের সিরিয়াল নাম্বারের সাথে মিলে যাচ্ছে! এই ঘটনা তখন সিনেট পর্যন্ত গড়ায় এবং সিনেট তদন্ত কমিটি গঠন করে। সিনেটের তদন্তে পরবর্তীতে এর সাথে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়। অবশ্য নিক্সনের নিজের তৈরি নিয়মের কারণেই ফেঁসে যান তিনি। নিক্সন প্রেসিডেন্ট হবার পর হোয়াইট হাউজের যাবতীয় কথাবার্তা রেকর্ড করে রাখার নিয়ম চালু করেছিলেন। এরকম ফাঁস হয়ে যাওয়া এক টেপ থেকেই জানা যায় নিক্সন এই ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন!

১৯৭৪ সালের ২৭ জুলাই ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে নিক্সনের জড়িত থাকার ব্যাপারটি সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হবার পর, নিক্সনকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অভিসংশনের জন্য সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। কিন্তু তার আগেই ৯ আগস্ট রিচার্ড নিক্সন পদত্যাগপত্র জমা দেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কোন রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ করার ঘটনা ছিল ঐ প্রথম! সাহসী এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য  কার্ল বার্নস্টেইন এবং বব উডওয়ার্ড পুলিৎজার পুরষ্কারে ভূষিত হন। কিন্তু এই কেলেঙ্কারি যে মানুষটির জন্য সবার নজরে আসে সেই ফ্রাঙ্ক উইলসের কী হয়েছিল? ওয়াটারগেট হোটেলের ঐ ঘটনার পর তিনি ওয়াচম্যানের চাকরি ছেড়ে দেন, কারণ তিনি মনে করেছিলেন তিনি তার উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। পরবর্তীতে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে যখন মিডিয়া সরগরম ছিল তখন সেই দিনের অভিজ্ঞতার কথা বলার জন্য বিভিন্ন মিডিয়াতে ডাক পেয়েছিলেন তিনি।

ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র All the President's Men –এ নিজের ভূমিকাতেই অভিনয় করেছিলেন তিনি। হয়ে উঠেছিলেন ‘হিরো’। কিন্তু এই হিরোর পরবর্তী জীবন কেটেছে অর্থাভাবে এবং সংগ্রাম করে। কোন চাকরিতেই বেশিদিন থাকা হয়নি তার, ন্যূনতম বেতনটাও পেতেন না। দোকান থেকে জিনিস চুরির দায়ে জেল-জরিমানার শিকার হতে হয়েছিল তাকে। শুধু তাই নয়, মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের মৃতদেহটা তিনি মেডিকেলে দিয়ে দিয়েছিলেন, কারণ সৎকার করার মত পর্যাপ্ত অর্থ তার ছিল না! ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ২০ বছর পূর্তিতে আবারো মিডিয়ার আলো এসে পরে তার উপর কিছুদিনের জন্য। একটি সংবাদ মাধ্যমকে তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন-

“সবাই বলে আমি নাকি হিরো। কিন্তু সেটা সত্যি নয়। আমি তাই করেছি, যা করার জন্য আমাকে সেখানে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও মনে হয়, সকলে আমাকে উপযুক্ত ক্রেডিট দিতে রাজি নয়”।

এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি যদি আবারো এ ধরণের পরিস্থিতির মুখোমুখি হন তিনি একই কাজ করবেন কিনা? ফ্রাঙ্ক উত্তর দেন- “এটা অনেকটা আমাকে এমন প্রশ্ন করার মতো- আমি কালো না হয়ে সাদা হলে কী করতাম! যা হয়েছিল সেটা ছিল পূর্বনির্ধারিত”। ২০০০ সালে ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ফ্রাঙ্ক উইলস। ওয়াচম্যান ফ্রাঙ্ক উইলসের তাৎক্ষণিক বিচক্ষণতার কারণেই ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ব্যাপারটি নজরে এসেছিল গোটা পৃথিবীর, পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন মহা-ক্ষমতাধর মার্কিন প্রেসিডেন্ট। অথচ হাওয়ার্ড ইউনিভারসিটি তাকে চাকরী দেয়নি, কারণ তাকে নিয়োগ দিলে ফেডারেল ফান্ডিং বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় ছিল তাদের। টেকেনি জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির সিকিউরিটি গার্ডের চাকরীটাও। হঠাৎ পাওয়া খ্যাতি তার জীবনে ভালো কিছু বয়ে আনেনি। দিয়েছে দারিদ্র, হতাশা, একাকীত্ব। মুদ্রার আরেক পিঠ বুঝি একেই বলে! 

তথ্যসূত্র- নিউইয়র্ক টাইমস    


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা