ব্যাঙ্গচিত্র, ফ্রিডম অফ স্পিচ ও ফরাসী পণ্য বয়কট- যা হচ্ছে, কিংবা হতে পারতো!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
আমি চেষ্টা করবো নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে ফ্রান্স ও ইসলাম বিষয়ক যে ক্রাইসিস চলছে তা উল্লেখ ও বিশ্লেষণ করতে। লেখাটা অনেক বড় হবে, ধৈর্য্য ধরে পড়লে সম্পূর্ণ ব্যাপারটি আপনার কাছে পরিষ্কার হবে।
ঘটনার শুরু এই মাসের শুরুর দিকে। সামুয়েল পাতি নামক একজন ইতিহাসের স্কুল শিক্ষক তার ফ্রিডম অব স্পিচ লেসনে ছাত্রদের হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর একটি ব্যাঙ্গচিত্র বা কার্টুন প্রদর্শন করেন। ব্যাঙ্গচিত্রটি তার করা নয়। এটি শার্লি এব্দো নামক একটি স্যাটায়ার পত্রিকায় ছাপানো কার্টুন।
এই ব্যাঙ্গচিত্র শার্লি এব্দো প্রকাশ করে ২০১৫ সালে। সেই সময় ফ্রান্সের মুসলিমরা এর সমালোচনা করে। এর জের ধরে এক মুসলিম যুবক শার্লি এব্দোর অফিসে এট্যাক করে বসে। সেদিনের হামলায় ও পরদিনের একটি সুপারমার্কেটে হামলায় ঐ অফিসের বেশ কয়েকজন কার্টুনিস্টসহ মোট ১৭ জন নিহত হয়।
এই হামলায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে ফ্রান্সসহ পুরো বিশ্ব। ফরাসিরা এই হামলাকে ফ্রিডম অব স্পিচের উপর হামলা বলে আখ্যায়িত করে। চলে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। ফ্রান্স ও বিশ্ব মিডিয়াতে এই হামলা ফলাও করে প্রচারিত হয়। যে শার্লি এব্দো পত্রিকার নামও কেউ শোনেনি, সেই পত্রিকা রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠে। জনগনের সিমপ্যাথি নিয়ে এটি হয়ে যায় ফ্রান্সের অন্যতম জনপ্রিয় সাপ্তাহিক।
তো ইতিহাসের শিক্ষক স্যামুয়েল পাতি যখন ঐ ঘটনা উল্লেখপূর্বক তার ফ্রিডম অব স্পিচের ক্লাসে এই ব্যাঙ্গচিত্র প্রদর্শন করেন, তখন ঐ ক্লাসে কয়েকজন মুসলিম ছাত্র ছাত্রী ছিলো। ঐ স্কুলের এক মুসলিম ছাত্রীর বিবৃতি থেকে জানা যায় যে, শিক্ষক তাদের বলেছিলো প্রফেট মুহাম্মদ (সঃ) এর কন্ট্রোভার্শিয়াল ব্যাঙ্গচিত্র দেখানো হবে, কারো অফেন্স থাকলে যেন বাইরে চলে যায়। এই ঘোষণার পরেও কিছু উৎসাহী মুসলিম শিক্ষার্থী ঐ ক্লাসে ছিল। এবং তারা বাসায় গিয়ে এই ব্যাঙ্গচিত্রের কথা শেয়ার করে তাদের প্যারেন্টসদের সাথে।
এই ঘটনার জেরে প্যারেন্টসরা ক্ষিপ্ত হয়। তারা স্কুলের সামনে আন্দোলন করে ঐ শিক্ষকের বরখাস্ত চেয়ে। এক শিক্ষার্থীর বাবা নিজের ফোন নাম্বারসহ এই বিষয়টি তুলে ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেটি আবার নর্থ প্যারিসের একটি ইসলামিক সেন্টারের খতিবের চোখে পড়ে। তিনি ঐ ছাত্রীর বাবাকে সাথে নিয়ে হেট স্পিচ সহ ফতোয়া দিয়ে ভিডিও আপলোড করেন।
ফেসবুক শেয়ারের কল্যাণে এই ভিডিও চোখে পড়ে চেচনিয়ার বংশদ্ভূত মুসলিম রিফিউজি আব্দোল্লাখ আবোইয়েজেদোভিচের। প্যারিস থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে তার ও তার পরিবারের বসবাস। ফুটবল খেলায় পারদর্শী ছিলো, স্বপ্ন ছিলো UFC খেলার। কিন্তু তুলজ ডিপার্টমেন্টে অডিশন দিতে গিয়ে সিলেক্ট না হয়ে আবার ফিরে আসে বাড়িতে। বাবা চাপ দেয় তার ব্যাবসায় যোগ দিতে৷ গাড়িও কিনে দেয়, লাইসেন্স না থাকায় চালানো হয়নি।
ঐ ইসলামিক সেন্টারের ফতোয়ার ভিডিও দেখে সে যোগাযোগ করে ঐ ছাত্রীর বাবার সাথে। দুই বন্ধুকে নিয়ে ৬০ কিঃমিঃ গাড়ি চালিয়ে নর্থ প্যারিসে আসে। এক বন্ধুকে নিয়ে ২-৩ ঘন্টা অপেক্ষা করে সামুয়েল পাতির স্কুলের সামনে। ঐ স্কুলের দুই শিক্ষার্থীকে ৩০০ ইউরো ঘুষ দেয় যেন ঐ শিক্ষককে চিনিয়ে দেয়। এরপর সামুয়েল পাতি যখন স্কুল থেকে বের হয়, চাকু দিয়ে আক্রমণ করে আব্দোল্লাখ। গলা কেটে হত্যা করে শিক্ষককে। দ্রুত পুলিশ চলে আসে ঘটনাস্থলে৷ পুলিশের গুলিতে নিহত হয় হত্যাকারী।
ফ্রান্সে শিক্ষকদের বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়। আর শিক্ষক হত্যার ঘটনায় ফুঁসে উঠে ফরাসি জনগণ। পুলিশ দ্রুত হত্যাকারীর সাথে থাকা বন্ধু, গাড়ি চালিয়ে আনা বন্ধু, শিক্ষককে চিনিয়ে দেয়া দুই ছাত্র, হেট স্পিচ ছড়ানো সেই ছাত্রীর বাবা ও ইসলামিক সেন্টারের খতিবকে গ্রেফতার করে। পরে জানা যায় যে ছাত্রীর বাবা অভিযোগ তুলে ভিডিও আপলোড করেছে, সেই ছাত্রী ব্যাঙ্গচিত্র দেখানোর দিন ক্লাসে অনুপস্থিত ছিলো। সে শুনেছে অন্য ছাত্র ছাত্রীদের কাছে, তারপর গিয়ে বলেছে বাবাকে।
এই ঘটনায় শুধু ফরাসিরা না, ফ্রান্সে থাকা মুসলিম কমিউনিটিও হতবাক হয়ে যায়। ফ্রান্সের জনগণ ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে৷ প্রেসিডেন্ট জনগণের পালস ধরতে পারেন। তিনি শিক্ষককে সর্বোচ্চ সম্মাননা দেয়ার ঘোষণা দেন। এবং দুইদিন পরে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে গিয়ে বলেন, এই হামলা ফ্রান্সের ফ্রিডম অব স্পিচের উপরে হামলা। ফ্রান্স কার্টুন প্রদর্শন অব্যাহত রাখবে।
এছাড়াও তুলুজ ও মঁপিলিয়ে নামক দুটি শহরে ঐ ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টরের ইন্ধনে দুটি ভবনে সেই ব্যাঙ্গচিত্র প্রজেকশন করে দেখানো হয়।
এই বক্তব্যের পরে ফুঁসে উঠে আরব দেশের জনগণেরা। নবী (সঃ) মুসলমানদের আবেগ ও স্পর্শকাতর ব্যাপার। বিভিন্ন আরব দেশের জনগণ ফরাসি পণ্য বর্জনের ডাক দেয়। এই ডাক ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে।
এরই মধ্যে ঘটে যায় আরেক হেট ক্রাইম। আইফেল টাওয়ারের কাছে কিছু মদ্যপ মেয়ে কুকুর নিয়ে বসেছিলো। সেখানে ছিলো একটি মুসলিম পরিবারও। কুকুর যেয়ে মুসলিমদের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করছিলো তাই অবজেকশন জানায়। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে মুসলিম পরিবারটির উপর ছুড়ি নিয়ে হামলা করে মদ্যপ মেয়ে। দুইজন মুসলিম নারী আহত হয়। পুলিশ তাদের উদ্ধার করে। গ্রেফতার করা হয় হামলাকারীকে। তার বিরুদ্ধে হেট ক্রাইম ও এটেম্পট টু মার্ডারের চার্জ আরোপ হয়। প্রসিকিউশন থেকে এক যুগের বেশি সময়ের জেল দেয়া হয়।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে মানসিক ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দেন। ফ্রান্স প্রতিক্রিয়ায় তুরস্ক থেকে তাদের এম্বাসেডর প্রত্যাহার করে। তুরস্কের একটি পত্রিকায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের ব্যাঙ্গচিত্র প্রকাশ করা হয়। পরদিন ফ্রান্সের শার্লি এব্দো এরদোয়ানের একটি অশ্লীল ব্যাঙ্গচিত্র প্রকাশ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে তুরস্ককে সতর্ক করা হয়। এবং টার্কিশ মুদ্রা লিরার ইতিহাসের সর্বোচ্চ দরপতন ঘটে।
বয়কট আন্দোলনের ডাক বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। দলে দলে মানুষ প্রতিবাদ ও শেয়ার করতে থাকে। এর মধ্যে একটি ইসলামিক দল প্রায় দশ হাজার মানুষ নিয়ে ফ্রান্স এম্বাসি বরাবর মার্চ করে। আরব অন্যান্য দেশ ফেসবুকেই বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে এবং সত্যিই তারা বয়কট করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মত এত বড় জনসমাগম কোথাও হয়নি৷ এই খবর ফলাও করে প্রচার করে ইন্ডিয়ান মিডিয়া। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব মিডিয়াতে৷
গতকাল সকালে ফ্রান্সের নিস শহরের একটি গির্জায় হামলা করে বসে এক তিউনেশিয়ান মুসলিম তরুণ৷ গির্জার ভিতরেই গির্জার রক্ষকসহ তিনজনকে ছুড়িকাঘাত করে হত্যা করে সে। এই ঘটনায় ফ্রান্সের ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ধর্মালম্বীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। ফ্রান্সে সর্বোচ্চ সতর্কতা ঘোষণা করা হয়। সেনাবাহিনীর ৩-৭ হাজার সদস্যকে অপারেশনে নামানো হয়৷
এই হচ্ছে গত কিছুদিনের ঘটনাবলী। এবার এই ঘটনা ও তার কনসেকোয়েন্সের বিশ্লেষণে যাই।
ক্ষতির দিক বিবেচনা করলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ফ্রান্সেরই। তাদের শিক্ষককে হত্যা করা হয়েছে, তাদের দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর হেট ক্রাইম বৃদ্ধি পেয়েছে, যার জেরে দুই মুসলিম নারী স্ট্যাবড হয়, গির্জায় সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, যাতে তিনজন নিহত হয়। মিডল ইস্ট ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় বাজার, বয়কটের কারণে ফ্রান্সের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
এবার আসি স্কুলে কেনো ব্যাঙ্গচিত্র দেখানো হলো সেই বিষয়ে। এই ব্যাপারটা বুঝতে হলে আপনাকে আগে ফ্রান্সের রাষ্ট্র কাঠামো বুঝতে হবে। তাদের রাষ্ট্র ও ধর্ম অন্যান্য দেশের মত একীভূত না। তাদের রাষ্ট্র সম্পূর্ণ আলাদা ধর্ম থেকে, সেটা ক্যাথলিক হোক আর ইসলাম। রাষ্ট্রের সকলের মত প্রকাশের অধিকার আছে এখানে৷ তেমনি যার যার ধর্ম তার তার পালনের অধিকারও আছে। কিন্তু মত প্রকাশ বা ধর্ম পালনের দোহাই দিয়ে কারো ক্ষতি করা বা রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অধিকার কারো নেই।
এখানে সকলের আন্দোলন করার অধিকার আছে। গত এক বছর ধরে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ইয়েলো ভেস্টের আন্দোলন চলছে। এর মধ্যেই ছিলো ট্রান্সপোর্ট কর্মচারীদের আন্দোলন, রিটায়ারমেন্ট রিফর্মেশনের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেটগুলোর আন্দোলন, ডাক্তারদের আন্দোলন হয় করোনা চলাকালীন সময়ে। ব্যাঙ্গচিত্র দেখানো শিক্ষকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে মুসলিম ছাত্রদের প্যারেন্টসরা। এই মাসেই ফ্রান্সে বসবাস করা অবৈধ অভিবাসীদের একটি বড় আন্দোলন বিভিন্ন শহর থেকে প্যারিসে ঢুকে। পুলিশ চাইলে তাদের ধরে নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দিতে পারতো, কিন্তু এখানে তা করে না। বরং পুলিশ তাদের সিকিউরিটি দিয়েছে। এখানে আন্দোলন করার অধিকার সবার আছে। নিজের মত প্রকাশের অধিকার আছে। কিন্তু ভাঙচুর বা বিশৃঙ্খলা করা যাবে না। পাবলিক বা প্রাইভেট প্রপার্টির কোন ক্ষতি করা যাবে না।
ফরাসিরা নিজেদের সেক্যুলার বলে দাবী করে। তাদের রাষ্ট্রকাঠামো দাঁড়িয়ে আছে ধর্ম যার যার, দেশ সবার নীতির উপর। এই নীতি অন্যান্য ধর্ম প্রধান দেশের নীতির সাথে সাংঘর্ষিক। এজন্য অনেক অভিবাসী যারা মাইগ্রেট হয়ে ফ্রান্সে আসে বা অনেকে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ফ্রান্সে আসে তারা সিনক্রোনাইজ করতে পারে না।
এই সেকুলারিজম বা মত প্রকাশের অধিকার ব্যাবহার করে জীশু খ্রিষ্টের ব্যাঙ্গচিত্র প্রকাশ করে তারা, ইহুদিদের রাব্বীদের ব্যাঙ্গচিত্র প্রকাশ করে, পোপের অশ্লীল কার্টুন প্রকাশ করে, এমনকি প্রেসিডেন্ট সহ বিশ্বনেতাদের ব্যাঙ্গচিত্রও প্রকাশ করা হয়। যাদের সেন্টিমেন্টে আঘাত করে, তারা সমালোচনা করে, আন্দোলন করে, কিন্তু খুন হত্যা করে না। এখানে সিস্টেমটা হচ্ছে তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যবহার সে করেছে, আপনি আপনার স্বাধীনতা ব্যবহার করে সেটা প্রটেস্ট করবেন। কিন্তু এতে কারো জান মালের ক্ষতি হতে পারবে না।
একটা জাতিতে সবাই সাধু হবে, এটা ভাবার কোন অবকাশ নেই। তেমনি এই জাতিতে সব ধরণের চিন্তার মানুষই আছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর ব্যাঙ্গচিত্রে প্রকাশ ফরাসিরাও ভালো ভাবে নেয়নি। একজন প্রফেটের সম্মানহানী করায় তারাও ঐ পত্রিকার সমালোচনা করে। কিন্তু যখন ঐ পত্রিকার অফিসে বর্বর হামলা করা হয়, একটা বড় অংশের সেন্টিমেন্ট ঘুরে যায়। তারা চলে চলে যায় পত্রিকার পক্ষে।
এরপরে ২০১৫ সালের শেষদিকে আইএস প্যারিস এট্যাক করে। নিহত হয় ১৩০ জন বেসামরিক নাগরিক। জারি করা হয় জরুরি অবস্থা। এই ঘটনার পরে ফ্রান্সে ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষীর সংখ্যা আরো বেড়ে যায়।
এর প্রভাব পড়ে ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। বড় দুই দল রিপাবলিকান ও সোসিয়ালিস্টদের পেছেনে ফেলে ডানপন্থী, অভিবাসীবিরোধী, বর্ণবাদী মারিন লোপেন এগিয়ে যায় প্রথম ধাপে।
ফরাসিরাও এই ডানপন্থী ফার রাইটদের পছন্দ করে না। বড় দুই দলের প্রথম ধাপেই পতনের পরে নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে তারা ভোট দিয়ে একদম নতুন রাজনীতিতে আসা ম্যাক্রোঁ ও তার দলকে নির্বাচিত করে। তারা জানতো ম্যাক্রোঁর দলও সাধু না, কিন্তু মন্দের ভালো তাদেরকেই নির্বাচিত করে এবং ডানপন্থীদের হাত থেকে দেশ রক্ষা করে।
কিন্তু ম্যাক্রোঁ সরকার দুই বছরের মাথাতেই জনপ্রিয়তা হারায়। ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলন শুরু হয়। তারপর রিটায়ারমেন্ট রিফর্মেশনের আন্দোলন। এরমধ্যেই আবার করোনার থাবা। অবস্থা অনেকটা টালমাটাল বলা যায়।
এরই মধ্যে ইতিহাসের শিক্ষক সামুয়েল পাতিকে হত্যা করা হয়। দেখুন এখানে মত প্রকাশের অধিকার সবার আছে। এবং তার ঐ লেসনও ছিলো মত প্রকাশ নিয়ে। ঐ শিক্ষক মুসলিম ছাত্র ছাত্রীদের বলেও দেন, এটা সেন্টিমেন্টে আঘাত করতে পারে, চাইলে তোমরা ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে পারো। এখানে কিন্তু সে আগেই সাবধান করে দিয়েছে, তারপরেও অতিউৎসাহী কিছু ছাত্র ছাত্রী ক্লাসে রয়ে যায়। বাসায় যেয়ে অভিভাবকদের এই ঘটনা বলে।
পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে মুসলিম প্যারেন্টসরা যখন আন্দোলন করে, সে ক্ষমাও চায়। দেখুন সে শিক্ষার্থীদের সাবধান করেছে। আবার ক্ষমায় চেয়েছে। তার দিক থেকে এরপরেও দোষ দেয়া যায় না। আপনারা বলতে পারেন নবী (সঃ) এর কার্টুন কেনো দেখাবে?
ঐ যে বললাম, আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো আর তাদের রাষ্ট্র কাঠামো এক না। আমরা সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বললে ৭ বছরের জেল হয়, আর তারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। এটা তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলেই তারা মনে করে। আমদের যেমন মুক্তিযুদ্ধ বা ৭১ আবেগের স্থান, এর বিরুদ্ধে যাওয়া অপরাধ গণ্য হয়, তাদের তেমন লিবার্টি ও ফ্রিডম অব স্পিচ। এর জন্য তারা রেভ্যুলেশন করেছে, রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। এই ফ্রিডম অব স্পিচের উপর হস্তক্ষেপ তারা তাদের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ বলেই মনে করে।
তো ঐ হত্যাকান্ডের পরে পুরো ফ্রান্স আলোড়িত হয়। জনপ্রিয়তায় ভাটা ধরা ম্যাক্রোঁ এই সুযোগ লুফে নেয়। সে ভালো করেই জানে জনগণের সেন্টিমেন্ট কীভাবে কাজে লাগাতে হয়। সে পলেটিক্যাল সাইন্স ইন্সটিটিউটের ছাত্র ছিলো, যেটা আমার কর্মস্থলের বিপরীত মুখে অবস্থিত। তো সে পলেটিক্যাল গেইম খেলে দেয়। জাতীর সেন্টিমেন্ট কাজে লাগানোর খেলায় মেতে উঠে। সে জানতো এই সুযোগটা যদি না নেয়, ডানপন্থী ফার রাইট মারিন লোপেন নিবে৷ এবং এই সুযোগটা নিয়েই সে ঘোষণা করে কার্টুন প্রদর্শন অব্যাহত রাখবে ফ্রান্স। তিনি কিন্তু এটাও বলেন যে, আমাদের দেশের সাধারণ মুসলিমদের র্যাডিক্যাল এক্সট্রিমিস্টদের থেকে রক্ষা আমাদেরকেই করতে হবে।
সেদিনই ফ্রান্সের রাজধানী থেকে দূরে দুইটা ডিপার্টমেন্টের সিটি হল থেকে নবী (সঃ) এর সেই ব্যাঙ্গচিত্র ঘন্টাব্যাপী প্রদর্শন করা হয়। এখানে বলে রাখা ভালো, সিটি হলের কার্যক্রম এখানে স্বাধীন, সরকার হস্তক্ষেপ করে না। কিন্তু ঐ প্রজেকশন ছিলো নিন্দনীয়। সিটি হলের কাজ হলেও ঐ কাজের পেছনে সরকারের বক্তব্য থেকে পাওয়া ইন্ধন যে ছিলো, সেটা বোকাও বুঝতে পারবে। ঐ ঘটনার পরে মুসলিম কমিউনিটিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ফরাসিদের একদল সাপোর্ট দেয়, আরেকদল নিন্দা করে। এবং দ্রুতই প্রেসিডেন্টের বক্তব্য ও ঐ প্রজেকশন বিশ্ব মিডিয়াতে চলে আসে।
এরমধ্যেই ঘটে যায় আরেক হেট ক্রাইম। ঐ যে আগেই বললাম, দুই মুসলিম নারীকে ছুড়িকাঘাত করা হয়। তো এই তিনটি ঘটনা দ্রুত ছড়িতে পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এরসাথে কিছু গুজবও ছড়ায়, যেমন ফ্রান্সে সব মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হবে।
তো এসব ঘটনার জেরে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকেরা ফরাসী পণ্য বয়কটের ডাক দেয়। কিন্তু সেসব দেশের সরকার নীরব থাকে, এখনো আছে। মিডলইস্টের বাজারে এই বর্জনের ডাক ভালোই প্রভাব ফেলে ফরাসি এক্সপোর্টে। বাংলাদেশেও এই বর্জনের ডাক দেয়া হয়, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশে ফরাসি পণ্যের বাজার নেই, উল্টো ইউরোপ বাংলাদেশের অন্যতম বড় রপ্তানির বাজার। আমরা তাদের পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছি, কিন্তু রপ্তানি বর্জনের ডাক কিন্তু দেই নাই। দিলে অবশ্য নিজেদের পায়েই কুড়াল মারা হতো।
কিন্তু এই বর্জনে অংশ নেয়াটা কী বাংলাদেশের মুসলিমদের জন্য ভুল ছিলো? আমি বলবো অবশ্যই না। একজন মুসলিম হিসেবে এই বর্জন ভুল ছিলো না। বরং এতে করে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের বক্ত্যব্যের ত্রুটি উঠে আসে এবং এটি তাদের রাষ্ট্রীয় ভবনে নবী (সঃ) এর ব্যাঙ্গচিত্র প্রদর্শনের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবাদে রূপ নেয়। ফ্রান্স মিডল ইস্টকে বয়কট বন্ধের আহ্বান করে। এবং শান্তিপূর্ণ বয়কটের মাধ্যমেই ফ্রান্সকে উচিৎ জবাব দেয়া হয়েছে। তারা ভবিষ্যতে উস্কানিমূলক বক্তব্য ও কাজ থেকে বিরত থাকবে এটাও আশা করা যায়।
কিন্তু বিপত্তি হচ্ছে এক্সট্রিমিজমে। এই যে জিহাদি জোসে একজন শিক্ষককে হত্যা করা হলো, এর কনসেকোয়েন্সে ফ্রান্সের জনগণ উল্টো মুসলিমদের বিরুদ্ধে চলে গেলো। হেট ক্রাইম বৃদ্ধি পেলো মুসলিমদের উপর। তারপর ঘটলো গতকালের চার্চে হত্যাকান্ড। এই সর্বশেষ হত্যাকান্ডের কোনসেকোয়েন্স তো এখনো বাকী।
এবার একটু ভিন্নদিকে আমরা নজর দেই। বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যারা ফিজিক্যালি প্রায় দশ হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছে। আমার চোখে এটাও ভুল কিছু না। ধর্মীয়ভাবে যে আঘাত করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের অধিকার অন্যতম বৃহত্তর মুসলিম দেশ বাংলাদেশের মুসলমানদের আছে। এবং প্রতিবেশী দেশ ইন্ডিয়ার মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্ব ও ফ্রান্সের মিডিয়াতেও এই খবর ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় নথিতে বাংলাদেশ বিষয়ক এফেয়ারে এই আপডেট সংযুক্ত হয়েছে। এই তথ্য নেটে ফ্রান্সের ডিপ্লোম্যাটিস সাইটেই আছে।
ওদিকে এই সংবাদের ভিত্তিতে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের কোন মেম্বার নাকি বাংলাদেশের পণ্য বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন। আমার মনে হয়না এর কোন প্রভাব পড়বে। কারণ ফ্রান্সের সরকার এতে কোন প্রতিক্রিয়াই দেখায়নি। তাদের লিবারেজম অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখাবে না, যতটুক বুঝি। তবে মিডিয়াতে ঢালাও প্রচার হওয়ায় ফ্রান্সের জনগণ বিরূপ বাংলাদেশের উপর।
তবে কিছু জিনিস আপনাকে মাথায় রাখতে হবে, একলাখের উপরে অবৈধ বাংলাদেশি ইউরোপে আছে। ইউরোপ বরাবরই বাংলাদেশকে চাপ দিয়ে আসছে তাদের ফেরৎ নিতে। সরকার সমঝোতার মাধ্যমে এই বিষয় হ্যান্ডেল করছে। এছাড়াও রপ্তানিতে বড় শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশ। যেটা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত শক্ত রেখেছে।
তার উপরে আছে প্রতিবেশী দেশ দুইটির চাপ। একদেশ রোহিঙ্গা চাপিয়ে দিয়েছে, আরেক দেশ সেটাকে সমর্থন দিয়েছে। সরকারের উপর চাপটা অনেক বড়। আর ভারতের অর্থনৈতিক সূচক বাংলাদেশের নীচে নেমে যাওয়ার সঙ্কা তো ভারতের মাথায় জমের মত ভর করে আছে।
ভারতের একটা মজার দিক বলি। তারা প্রতিযোগিতায় না পারলে প্রতিযোগিকে ধ্বংসের পথে নামে। যেমন পাকিস্তানকে বিশ্ব মিডিয়াতে টেরোরিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপনে ভূমিকা কিন্তু ভারতেরই। আরেকটা উদাহরণ দেখেন, পাকিস্তানের ক্রিকেট কিন্তু বিসিসিআই সন্ত্রাসী ট্যাগ দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। তাদের দেশে খেলার আয়োজন বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের প্লেয়ারদের কোন টুর্নামেন্টে ডাকা হয় না। এগুলো রাষ্ট্রীয় প্রতিহিংসা।
সেই একই পথে বাংলাদেশকে র্যাডিক্যাল ইসলামিস্ট দেশের তালিকাভুক্ত করতে উঠে পড়ে লেগেছে ইন্ডিয়ান মিডিয়া। আর আমরা না বুঝেই তাদের হাতে রিজন তুলে দিচ্ছি।
আপনি ফ্রান্সকে শান্তিপূর্ণ বয়কট করুন, যেহেতু আপনি দূর্বল। আপনার তো পাশের দেশের সাথেই যুদ্ধের কথা চিন্তা করার মত শক্তি নেই। আপনি নয় হাজার মাইল দূরের কোন দেশের প্রতি জিহাদি জোশ দেখাচ্ছেন, এতে আপনার কোন লাভ হয়েছে? না ইসলামের কোন লাভ হয়েছে? লাভ যতটুক হয়েছে ঐ বয়কটেই হয়েছে। এক্সট্রিম চিন্তাভাবনা কোন ভালো ফল বয়ে আনে না। আপনি যেদিন দুর্বার শক্তিশালী হবেন, সেদিন যুদ্ধের ডাক দিয়েন। অযথা এখন পরিস্থিতি ঘোলা করে সরকার ও দেশের উপর চাপ বৃদ্ধি করা ছাড়া কোন লাভই আনতে পারছেন না।
আমি বলবো শান্তিপূর্ণ পথে হাঁটাই ভালো, যেখানে অশান্তির পথ ক্ষতি ছাড়া কোন লাভ আনবে। আর শান্তিপূর্ণ পথটা আপনাকে ক্ষতি নয় বরং সামান্য হলেও লাভ এনে দিচ্ছে।
আর শেষ কথা এটুক বলতে চাই, আমি নিজেও মুসলিম, প্রাকটিসিং মুসলিম। আমি আল্লাহ ও রাসুলুল্লাহর দেখানো শান্তির পথে বিশ্বাস করি। আমাকে মাওয়া নামের গিয়েনার এক আফ্রিকান মুসলিম মহিলা ছেলে বলে ডাকে, আবার সেলিন নামের কংগোর এক খ্রিষ্টান মহিলাও ছেলে বলে ডাকে। মেলাজ নামের আলজেরিয়ার এক মুসলিম মহিলা ভাই ডাকে, রমজানে ট্রেডিশন অনুযায়ী গরুর দুধ চিনি পাঠায়। আবার ক্লার নামের ইটালির এক মহিলাও ভাই ডাকে। তিউনিশিয়ার মুহাম্মেদ, মরোক্কোর রাশিদ যেমন আমার বন্ধু, ফ্রান্সের সার্জ আর কামিলও আমার বন্ধু।
সুতরাং আমার চিন্তাভাবনার সাথে অনেকের অনেক চিন্তাভাবনা মিলবে না। আমি ইসলামের শান্তি ও ভাতৃত্বের পথ বেছে নিয়েছি। আবার অনেকে বেছে নেয় হিংস্র ও উগ্রতার পথ।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন