করোনার দিনগুলিতে ফ্রান্সে যেভাবে কাটছে এক বাংলাদেশির জীবন
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

গত সাতদিন যাবৎ ফ্রান্সে আমরা গৃহবন্দী অবস্থায় আছি। এসব নিয়ে কথা বলতে চাইনি কিন্তু এখন আর না বলে পারছি না। এখানকার বর্তমান পরিস্থিতি হয়তো লিখে বোঝানো সম্ভব হবে না। প্রতিটি দিন কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠছে আর সরকার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত কতটা আতঙ্কে আছে তা অকল্পনীয়।
শুধুমাত্র গতকাল একদিনেই এই দেশে আক্রান্তের পরিমাণ প্রায় চার হাজার মানুষ। ফ্রান্সে এই পর্যন্ত সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা ২২ হাজারের বেশি। মৃত্যুর হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে পালা করে (১১০০ জন মৃত্যুবরণ করেছেন এখন পর্যন্ত)।
শুধু ফ্রান্স নয়, ইতিমধ্যে অনেকেই জানে পুরো ইউরোপের অবস্থাই খুবই খারাপের দিকে যাচ্ছে। ইতালিতে ৭০ হাজার (মৃতের সংখ্যা সাড়ে'ছয় হাজার+), স্পেনে ৪০ হাজার, জার্মানিতে ৩৩ হাজার মানুষ আক্রান্ত। এছাড়া ইউরোপের বাকি সব দেশেই ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এই করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। প্রতিটি দেশ হিমশিম খাচ্ছে এই মহামারী থেকে তাদের জনগণকে রক্ষার জন্য। অদূর ভবিষ্যতেও কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না আপাতত। এভাবে চলতে থাকলে (যেহেতু আমদানী বন্ধ) মাস কয়েক পর এই দেশেও খাদ্য সংকট দেখা দিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ফ্রান্সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠিত, প্রার্থনালয়, অফিস, আদালত, বিমানবন্দর, পানশালা, রেস্তোরাঁসহ এই দেশের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই বন্ধ। নিত্য প্রয়োজনীয় খাবারের দোকান আর ঔষধের দোকান ছাড়া প্রায় সব কিছুই বন্ধ এই দেশে। মানুষের জীবনযাত্রা অচল হয়ে আছে। সরকার থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েও করোনায় আক্রান্তের পরিমান কমানো সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশি টাকায় পঁচিশ হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ প্রায় সাত লক্ষ পর্যন্ত (শ্রেনীভেদে) জরিমানা করার ঘোষণা এসেছে সরকারের পক্ষ থেকে, অন্যথায় দুই বছরের জেলও হতে পারে।
প্রতি সপ্তাহে একদিন বাজারে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে ফ্রান্স সরকার, তবু সেই নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট এলাকার কাউন্সিলের অনুমতি পত্র নিয়েই কেবল বাজারে অথবা ফার্মেসিতে যাওয়া সম্ভব, তাছাড়া নয়। অন্যথায় গুণতে হবে জরিমানা অথবা জেল। সবাই গৃহবন্দী থাকলেও এখন ঘরের ভেতরেও পরিবারের সদস্যদের থেকে যে যতটা পারে দূরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে সরকার।
ফার্মেসিগুলোতে কোনো ধরনের মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার জনসাধারণের জন্য মাস্ক বিক্রি বন্ধ করেছে। শুধুমাত্র হাসপাতালগুলোতে এখন মাস্ক দেয়া হচ্ছে। পর্যাপ্ত মাস্ক মজুত করা হচ্ছে হাসপাতালের জন্য। বিশেষজ্ঞদের ধারণা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে। ফরাসি গণমাধ্যমে চোখ রাখলে জীবনকে আরো অসহায় মনে হয়। মৃত্যু কতটা কাছে এসে ঘুরঘুর করছে তা দেখে বেঁচে থাকাটাও ক্রমশ হয়ে উঠছে ভয়ঙ্কর বিভীষিকাময়।
আমরা সবাই এখানে ইউরোপে মাথার উপর মৃত্যুর মিছিল নিয়ে প্রতিদিন বেঁচে আছি। আরো কত প্রাণ যাবে, আরো কত মায়ের বুক খালি হবে, কত সন্তান এতিম হবে তার কোনো ঠিক নেই। এই ভয়াভয় সময়টায় বুকের ভেতরে কতটা তোলপাড় হয়ে আছে তা বোঝানোর ক্ষমতা নেই, কাকেই বা বোঝাবো? প্রতিটা মানুষের ভেতরে এখন শুধু মৃত্যুভয়।
এই সবকিছুর পরও বাংলাদেশ নিয়ে প্রচণ্ড ভয় হয়। প্রতিটা মুহূর্তে চিন্তায়, আতঙ্কে থাকি আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যাতে বাংলাদেশ ভালো থাকে, বাংলাদেশের মানুষ ভালো থাকে, এই ভাইরাস বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়ানোর আগেই যাতে আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করে দেন! মুক্তির পথ করে দেন! বাংলাদেশকে সুস্থ রাখেন!
আপনারা সবাই যে যার মতো পারেন সাবধানে থাকবেন। পর্যাপ্ত দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করুন সবার সাথে। নিজে সুস্থ থাকুন, সমাজ ও দেশ সুস্থ রাখুন। সবাই ভালো থাকুন। সৃষ্টিকর্তার নিকট দোয়া করুন যাতে পৃথিবীর সবাই এই মহামারী থেকে রক্ষা পায়। ধন্যবাদ সবাইকে।
- সাব্বির নাইম
২৪/০৩/২০