স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য সবজি বা ডিম খিচুড়ি রান্না করা ও সরবরাহের কাজে প্রশিক্ষণ নিতে এক হাজার সরকারি কর্মকর্তাকে বিদেশে পাঠানো হবে। আচ্ছা, খিচুড়ি রান্না শিখতে চাইলে কেকা ফেরদৌসির কাছে গেলেই তো হয়, বিদেশে যাওয়ার কি দরকার?

বাংলাদেশ হচ্ছে সব সম্ভবের দেশ, যাবতীয় অবাস্তব, ভিত্তিহীন আর আজগুবি কান্ডকারখানা এখানেই যেন ঘটবে। হলিউডি সিনেমার মতো এই দেশে সুপারহিরোরা আসে না, এলিয়েন আক্রমণ করে না, কিন্ত যেসব ঘটনা ঘটে, যেগুলোও এলিয়েন দেখা যাওয়ার চেয়ে কম আশ্চর্য্যের নয়। একটু আগেই যেমন খবরে পড়লাম খিচুড়ি রান্না শিখতে নাকি এক হাজার সরকারী কর্মকর্তা বিদেশ যাবেন। প্রথমে মনে হয়েছিল কোন ট্রল পেজের ভুয়া খবর বুঝি, পরে দেখি না, ঘটনা আসলেই সত্যি! পাঁচ কোটি টাকা নাকি বাজেটও চাওয়া হয়েছে খিচুড়ি রান্না শিখতে কর্মকর্তাদের বিদেশে পাঠানোর জন্য! মানে সরকারী টাকার হরিলুটের সব আয়োজন সম্পন্ন! 

ইংরেজী দৈনিক দ্য বিজনেস ট্রিবিউনে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য সবজি বা ডিম খিচুড়ি রান্না করা ও সরবরাহের কাজে প্রশিক্ষণ নিতে এক হাজার সরকারি কর্মকর্তাকে বিদেশে পাঠাতে চায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। মূলত বিভিন্ন দেশের স্কুলগুলোতে বাজার থেকে শুরু করে রান্না করা এবং কীভাবে তা শিক্ষার্থীদের বিতরণ করা হয়, তার জানতেই এই বিদেশ ভ্রমণের আয়োজন করা হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ছাড়াও বিশেষ এই ভ্রমণের সুযোগ পাচ্ছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন এবং বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন বিভাগের কর্মকর্তারা।

ইতোমধ্যে বিদেশে প্রশিক্ষণের প্রস্তাবিত এই 'প্রাইমারি স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম'- এ পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। খিচুড়ি রান্না করতে শুধু বিদেশ প্রশিক্ষণই নয়, স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণের জন্য ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্কুলগুলোতে কীভাবে রান্না হয়, কীভাবে শিক্ষার্থীদের বিতরণ করা হয় সেসব জানতেই নাকি আগামী পাঁচ বছরে এক হাজার কর্মকর্তার বিদেশ প্রশিক্ষণ প্রস্তাব করা হয়েছে। পুষ্টিকর বিস্কুটের পাশাপাশি প্রস্তাবিত কর্মসূচির আওতায় দেশব্যাপী রান্না করা খাবার দেওয়া হবে স্কুলগুলোতে। 

খিচুড়ি রান্না শিখতে বিদেশে যাবেন এক হাজার কর্মকর্তা!

জাতির বিবেক বলে তো কিছু অবশিষ্ট নেই আর, থাকলে তার কাছে জিজ্ঞেস করতাম- এই লোকগুলোর মনে কি লজ্জা বলে কোন বস্তু নেই? বাজার করা, খিচুড়ি রান্না, সেই খিচুড়ি ছাত্রদের মধ্যে বিতরণ- এটা শেখার জন্য বিদেশ ভ্রমণের আয়োজন করা যায়, সেটার প্রস্তাবও মন্ত্রণালয়ে পাঠানো যায়? এত পড়াশোনা করে সরকারী চাকরি পেয়েছেন এরা, এদের ক্রিয়েটিভিটির এই দশা কেন? বিদেশে যেতে চাইলে ভালো কোন অজুহাত দাঁড় করান, খিচুড়ি রান্না শিখতে বিদেশ যেতে চাইলে তো সেই প্রকল্পে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে যাবেই! আর খিচুড়ি রান্না যদি সত্যিই শিখতে হয়, দেশে কেকা ফেরদৌসি আছেন, তিনি চাল ডাল ছাড়া নুডলসের খিচুড়ি কিভাবে বানাতে হয় সেটা শিখিয়ে দেবেন; এই ছোট্ট কাজটার জন্য করোনার মধ্যে আবার দেশ-বিদেশে দৌড়াদৌড়ি কেন বাপু! 

অবশ্য যে দেশে সরকারী প্রোজেক্টে পর্দা-বালিশের দাম হয় লাখ টাকা, বটির দাম ধরা হয় কয়েক হাজার, যেখানে জুম মিটিংয়ে আপ্যায়ন খরচ ধরা হয়, সেখানে তো এরকম ঘটনা ঘটবেই। কয়েকদিন আগে দেখলাম পুকুর খনন শিখতে কর্মকর্তারা বিদেশ যাচ্ছেন। আচ্ছা, এই সাহেব-বাবুরা কি প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে প্যান্ট গুটিয়ে গাঁইতি-কোদাল নিয়ে পুকুর খননে নেমে পড়বেন? সেই কাজ তো শ্রমিকরাই করবে, যন্ত্র করবে। তাহলে এরা কোন মুখে এসব বাহারী প্রজেক্টে বিদেশ যেতে চায়? 

অল্প ক'দিন আগে খবরে পড়লাম, মহিষের প্রজনন দেখার জন্যেও নাকি একদল কর্মকর্তা বিদেশ যাবেন! দুটো প্রাপ্তবয়স্ক মহিষ একান্ত সময়ে কি করবে না করবে সেটার দিকেও ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা লাগবে? আর দেখতে চাইলে দেশে কি মহিষের অভাব পড়েছে? এই জিনিস দেখার জন্য বিদেশে যেতে হবে কেন? এর আগে আমেরিকা থেকে বিমান আনার জন্যেও কর্মকর্তারা উড়ে গিয়েছিলেন। নাসার এক প্রতিযোগীতায় অংশ নেয়া বাংলাদেশী প্রতিযোগিরা ভিসা পাননি, অথচ কর্মকর্তারা ঠিকই লজ্জার মাথা খেয়ে ঘুরে এসেছেন। সরকারী টাকায় আমেরিকায় পিকনিকের সুযোগ মিস দেয়া যায় নাকি! 

দেশ থেকে খিচুড়ি জিনিসটাই নিষিদ্ধ করে দেয়া দরকার!

এর আগে ময়মনসিং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আটজন শিক্ষক ও কর্মকর্তার লিফট কেনার জন্যে বিদেশ যাওয়ার একটা খবর প্রকাশিত হলো গণমাধ্যমে। লিফট কেনার জন্যে শিক্ষকের বিদেশ যাওয়ার কি দরকার? এটা কী কোরবানির হাটের গরু, যে দেখেশুনে হাটে গিয়ে কিনতে হবে? শিক্ষক হয়ে যারা দুর্নীতির আশ্রয় নেন, তারা কেমন শিক্ষক, এটা খুব জানতে ইচ্ছে করে।

সরকারী কর্মকর্তাদের কারো কারো কাছে সরকারী টাকায় বিদেশ ভ্রমণটা অবসেশনের মতো। সুযোগ পেলেই তারা ঝুলে পড়েন সরকারী সফরে, সেখানে তার কোন অবদান রাখার সুযোগ আছে কিনা- এটুকু ভাবতেও চান না তারা। এটাকে তারা অধিকার হিসেবেই গণ্য করেন হয়তো। সরকারী চাকুরীতে নিয়োগ দেয়ার সময় তারা শপথ করেন জনগণের সেবা করবেন, নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন। অথচ চেয়ারে বসার সঙ্গে সঙ্গেই কেউ কেউ শুরু করেন অসাধু আচরণ, এদের ভাবসাব দেখলে মনে হয় জনগনের টাকায় ফুর্তি করে বেড়ানোটা এদের জন্য মৌলিক অধিকার! এই লোভী-ইতর লোকগুলোর জন্যে যারা পুরোটা চাকুরী জীবন সৎ থেকে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করেন- তাদেরকেও গালি শুনতে হয়।

কাজের খাতিরে বিদেশ সফর হতেই পারে, কিন্ত এদেশের কিছু সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নলকূপ খনন শিখতে বিদেশে যান, ক্যামেরা কেনার জন্যে বিদেশ সফর করেন- এরকম নজিরও আছে। চক্ষুলজ্জা বলতে একটা জিনিস যে থাকা উচিত মানুষের মধ্যে, এটা তাদের মনেই হয় না। এসব নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা আবার অদ্ভুত সব সাফাই গান, দাবী করে, কেউ নাকি ‘অপ্রয়োজনে’ বিদেশ সফর করছেন না! প্রয়োজন আর অপ্রয়োজনের সংজ্ঞাটা নতুন করে শিখতে ইচ্ছে করে এসব কথাবার্তা শুনলে। খিচুড়ি রান্না শেখার জন্য বিদেশযাত্রার খবরটা শোনার পরেও একই অনুভূতি হচ্ছে... 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা