পাহাড়ের উন্নয়ন করতে চাইলে সেখানে স্কুল-কলেজ বানান, হাসপাতাল বানান। নিজেদের বিনোদনের জন্য, ফুর্তির জন্য পাহাড় ধ্বংস করে, প্রকৃতির বারোটা বাজিয়ে ফাইভ স্টার হোটেল বানিয়ে কি এমন উন্নয়ন করতে চান আপনারা?

শুরুতে খবরটা জানানো যাক- বান্দরবানের নীলগিরির চিম্বুক পাহাড়ে পাঁচ তারকা ম্যারিয়ট হোটেল বানানোর কাজ শুরু করেছে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সিকদার গ্রুপের আর এন্ড আর হোল্ডিংস লিমিটেড। জ্বি, সেই সিকদার গ্রুপ, যে প্রতিষ্ঠানের মালিকের দুই ছেলে ব্যাংকের ঋণ না পেয়ে এমডি এবং ম্যানেজারকে আটকে রেখে নির্যাতন করেছিল, গুলি চালিয়েছিল, তারপর আইন-শৃঙখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগা দিয়ে এয়ার এম্বুলেন্সে চড়ে করোনার লকডাউনের মধ্যেই দেশ ছেড়েছিল। এই প্রকল্পে আর এন্ড আর হোল্ডিংসের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪তম ডিভিশন, ৬৯তম ব্রিগেড সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট। 

সাজেকের গল্প দিয়ে লেখাটার শুরু করি। যে সাজেকে এখন আমরা মেঘবিলাস করতে যাই, ছুটির দিনগুলোতে গহীন পাহাড়ের ভেতরে যে জায়গাটাকে ফার্মগেট বা বিজয় সরণী বানিয়ে ফেলি- সেই সাজেক দশ-বারো বছর আগেও ছিল একদমই নিভৃত এক পাহাড়ি পল্লী। মানুষজনের আনাগোনা ছিল না, সেখানে বাস করতো আদিবাসী খুকি সম্প্রদায়ের ষাটটি পরিবার। পাহাড়ে জুম চাষ করে খাবারের ব্যবস্থা করতো তারা। বংশ পরম্পরায় কয়েকশো বছর ধরে এখানেই ছিল তাদের বসতি। রোদ-বৃষ্টি গায়ে মেখে শত প্রতিকূলতা সয়ে এই জায়গাটাতেই রয়ে গিয়েছিল তারা। 

কিন্ত আচমকা একদিন দখলদারেরা হানা দিলো সেখানে, যে পাহাড়ে বছরের পর বছর ধরে খুকি সম্প্রদায়ের মানুষগুলো বাস করে আসছিল, যারা এখানকার বৈধ অধিবাসী ছিল, এই মাটির ওপর যাদের অধিকার ছিল সবচেয়ে বেশি- তাদেরকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করা হলো। কারন এই পাহাড়ে এখন ট্যুরিস্ট স্পট বানানো হবে, সারাদেশ থেকে মানুষ সেখানে যাবে 'প্রাকৃতিক সৌন্দর্য' দেখতে। পাহাড়ে আগুন জ্বললো, পুড়লো জুমের ক্ষেত, ঘরবাড়ি, মরলো মানুষ। প্রাণ বাঁচাতে বাধ্য হয়ে আদিবাসীরা চলে গেল আরও গভীর জঙ্গলে, কেউ কেউ অভিমানে সীমান্তই পাড়ি দিলেন, চলে গেলেন ত্রিপুরায়। 

আজ আমরা দলবেঁধে সাজেকে যাই, ভীড় জমাই, আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী জামাকাপড় পরে ফটোসেশন করি, সাজেকের মেঘ নিয়ে আহ্লাদে মত্ত হই, ব্যাম্বু চিকেন খেয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেই, তারপর একগাদা ময়লা-আবর্জনা পেছনে ফেলে সাজেক ছাড়ি- আমরা কখনও জানার চেষ্টা করি না, আমাদের বিনোদন দিতে যে সাজেক বানানো হয়েছে, সেখানকার পাহাড়ে কত আদিবাসী অসহায় মানুষের নীরব কান্না মিশে আছে। আমরা খোঁজ নেই না, জনপ্রতি পাঁচ-সাত হাজার বা তারও বেশি টাকা খরচ করে যে এত এত মানুষ প্রতিবছর সাজেকে যাচ্ছে, সেই টাকার কত শতাংশ আসলে সেখানকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের পকেটে ঢুকছে? উন্নয়নের আলো তাদের গায়ে কতটা লাগছে? 

সাজেকের মতো ঘটনা আরও অজস্র আছে এই তিন পার্বত্য জেলায়। যদি খুঁজতে চান, এমন হৃদয়ভাঙা গল্প আরও অনেক পাবেন। বন্দুকের নলের মুখে, জোর জবরদস্তির ভয়ে, কিংবা নির্যাতিত হবার আতঙ্কে ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন- এমন অনেক আদিবাসীকেই খুঁজে বের করা সম্ভব। আজ যে নীলগিরি-নীলাচলে গিয়ে বাঙালি ছুটি কাটায়, বন্ধুবান্ধব নিয়ে 'চিল' করে, সেই জায়গাগুলোতে এমন হাজারো মানুষের কান্না আর আর্তনাদ মিশে আছে। আপনারা নীলগিরি থেকে ঘুরে এসে ফেসবুকে অভিজ্ঞতার গল্প লিখে ফেলেন, আপনারা জানেন না 'তেংপ্লং চূট' নামের জায়গাটা কিভাবে নীলগিরি হলো। আপনারা চন্দ্রপাহাড়ের ছবি তোলেন, আদিবাসীদের 'শোং নাম হুং' কিভাবে চন্দ্রপাহাড় হলো, সেই গল্প আপনাদের অজানা। 

নীলগিরিতে তৈরী হচ্ছে ফাইভ স্টার হোটেল

যৌক্তিক একটা প্রশ্ন- নীলগিরিতে কেন পাঁচতারা হোটেল বানাতে হবে? পাহাড়ের বুকে, প্রকৃতিকে ধ্বংস করে কেন বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে? কেন সেখান থেকে আদিবাসী ম্রো সম্প্রদায়ের অন্তত পাঁচটি পাড়াকে উৎখাত করে হোটেল বানাতে হবে? পাহাড়টাকে পাহাড়ের মতো থাকতে দিলে কি হয়? কেন সেখানে হাইকমোডওয়ালা এসি রুম, বিলাসবহুল আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে? কেউ আয়েশ করে পাহাড় দেখতে চায় বলে পাহাড়কে কেন বদলাতে হবে? আরাম-আয়েশের মোড়ক ছেড়ে মানুষগুলো কি একটু কষ্ট করে পাহাড়ের সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে না? পাহাড়ের মানুষগুলোর কণ্ঠ হয়তো রুদ্ধ করে দেয়া যাবে, কিন্ত প্রকৃতি কি ক্ষমা করবে এই অপরাধের? সে কি প্রতিশোধ নেবে না কখনও? 

যারা বিলাসবহুল হোটেল বানানোর পক্ষে রায় দিয়ে যুক্তি দেখান যে, এতে পাহাড়ের মানুষগুলোর কাজের সংস্থান হবে, তাদের উপার্জনের রাস্তা খুলবে- আপনারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। পাহাড়ের বুক চিরে সাজেক হয়েছে, কাপ্তাই লেকে রিসোর্ট হয়েছে, নীলগিরি-নীলাচল হয়েছে, তাতে পাহাড়ে বসবাস করা মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন আসেনি। মুনাফার সবটাই কামিয়েছে বিভিন্ন সংস্থা, আর সেটেলার বাঙালীরা। পাহাড়ের মানষের প্রাপ্তি বলতে গেলে নিজের ভূমি থেকে উচ্ছেদ হবার যন্ত্রণাটাই। 

পাহাড়ের উন্নয়ন করতে চাইলে পাহাড়ে স্কুল-কলেজ বানান, হাসপাতাল বানান। চিকিৎসার অভাবে সেখানে মানুষজন সাধারণ রোগব্যাধিতেও মারা যায়। গর্ভবতী মা মারা যায় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে, কারন যোগাযোগব্যবস্থা দুর্গম। সেখানকার শিক্ষার হার কম, কারন স্কুল-কলেজ নেই, যে কয়টা আছে সেগুলোও অনেকের জন্য দূরে হয়ে যায়, শিক্ষকেরা স্কুলে আসতে চান না, ঠিকমতো পাঠদান হয় না। এজন্যেই দেশের যে কোন জেলার চেয়ে শিক্ষার হাতে বান্দরবান বা খাগড়াছড়ির মতো জেলাগুলো পিছিয়ে। উন্নয়ন করতে চাইলে স্কুল আর হাসপাতালের পেছনে খরচ করুন, কর্পোরেট আর রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে ফাইভ স্টার হোটেল বানালে পাহাড়ের উন্নয়ন হবে না, পার্বত্য তিন জেলার উন্নতি হবে না। সাজেক-নীলগিরি-নীলাচল দিয়ে খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি-বান্দরবানের কোন উন্নয়ন হয়নি, এই ফাইভ স্টার হোটেল দিয়েও হবে না। 

এই লেখা পড়ে একদল ক্ষেপে উঠবে, যুক্তি দেখাবে, এই দেশে সবার অধিকার সমান, পাহাড়ি-বাঙালি বলে কোন কথা নেই, সরকার তো দেশের নানা জায়গাতেই ভূমি অধিগ্রহণ করে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, বাঙালিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাহলে পাহাড়ে একটা প্রকল্প নিয়ে কেন সবার এত আপত্তি- ইত্যাদি ইত্যাদি। এই জায়গায় আদিবাসী ম্রো সম্প্রদায়ের জায়গায় বাঙালি পাড়া থাকলেও যে কোন সচেতন নাগরিকের প্রতিবাদের ধরণটা একই হতো। পদ্মা সেতু বানানো, ব্রিজ-কালভার্ট বানানো আর বিনোদনের জন্য, ব্যবসার জন্য ফাইভ স্টার হোটেল বানানোটা এক জিনিস নয়। একটা ডাল-ভাত, অন্যটা বিরিয়ানি। একটা নেসেসিটি, অন্যটা লাক্সারি। দুটোর মধ্যে তুলনা চলে না, চলবেও না। 

চাকমা-মারমা-ম্রো বা অন্য যে কোন আদিবাসীর কথা ভুলে যান। নিজেকে একবার সাজেকের সেই খুকিস সম্প্রদায়ের বিতাড়িত হওয়া মানুষগুলোর জায়গায় বসিয়ে ভাবুন। কিংবা কল্পনা করুন, আপনি কাপ্রুপাড়া, নাইতং পাহাড় বা জীবননগর এলাকার বাসিন্দা। আপনাকে বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে এখানে ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে বেড়াতে আসা, ছুটি কাটাতে আসা মানুষের জন্য হোটেল বানানো হবে। যেখানে আপিনার ঘর পুড়বে, সেখানে একদিন তারা বারবিকিউ করবে। ভাবতে থাকুন, দৃশ্যটা যদি সহ্য করার মতো হয়, তাহলে চুপ করে থাকুন। আর যদি সহ্য করতে না পারেন, তবে প্রতিবাদ করুন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসহায় মানুষগুলোর সঙ্গে ঘটতে যাওয়া এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা