উড়োজাহাজ আসার আগে বাংলার আকাশজয়ের এক বিস্ময়কর ঘটনা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

তখনো উড়োজাহাজের প্রচলন ছিল না। তাই আকাশে মানুষ ভেসে বেড়ানো বিশাল এক ব্যাপারই। আর বাংলার আকাশ জয় করেছিলেন এক ভিনদেশী ইউরোপীয় নারী! এক অদ্ভুত ইতিহাস, আকাশ জয়ের ইতিহাস!
ঘটনার সময়কাল- ১৮৯২ সাল। মার্চের এক উষ্ণতম দিন। স্থান - আহসান মঞ্জিল। নবাবদের আমল। নবাব আহসানউল্লাহ ছাদে বসে আছেন, সাথে তার পরিবার পরিজন। আজ শহরে এক আচানক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। যা আগে কখনো ঘটেনি। বুড়িগঙ্গার এদিকটা লোকে লোকারণ্য। সবাই খুব কৌতূহলী, খানিকটা উত্তেজিতও বটে। কি হবে আজ না দেখলেই নয়। এ জাতীয় ঘটনার স্বাক্ষী তারা আগে কখনোই হয়নি। তাই বাড়তি উৎসাহ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। দেওয়ান গনিউর উৎসাহী জনতাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি শহরে এই প্রথমবারের মতো এসেছেন। ট্রেনের টিকেট কাটতে গিয়েই তিনি প্রথম জানতে পারলেন আজকে কি হতে যাচ্ছে! শুনেই তিনি বেশ উৎফুল্ল, নিজেকেই নিজে বাহবা দিচ্ছেন, ঢাকায় আসবার জন্যে। না আসলে কিভাবে দেখতেন এই ঐতিহাসিক দৃশ্য।
স্থান - নারিন্দা খৃষ্টান কবরস্থান। মার্চের ১৮ তারিখ মারা গেলেন জেনি। ঢাকায় যে ঘটনাটি নিয়ে এতো মাতামাতি, সেই ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন জেনি ভ্যান তাসেল। সবাইকে মুগ্ধ করতে গিয়ে তিনি নিজেই বিপদের মুখে পড়লেন। কেউ কেউ বলে নবাব পরিবারের খামখেয়ালির কারণে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে এই মেয়েটিকে। দেওয়ান গনিউর এই পুরো ঘটনার স্বাক্ষী ছিলেন৷ তিনি তার দিনলিপিতে লিখে গিয়েছেন এই পুরো বিত্তান্ত। বলে রাখি, এই দেওয়ান গনিউর সম্পর্কে বিখ্যাত মরমি সাধক হাসন রাজার পুত্র! নবাব আহসানউল্লাহ এমনিতে ভীষণ বিখ্যাত নবাব। তিনি আমোদ ফূর্তি বেশ পছন্দ করেন। হাসিখুশি থাকা তার স্বভাবজাত। মানুষকে চমকে দিতে তার বিশেষ ভাল লাগে। তাই, তিনি প্রায়ই বিভিন্ন রকমারি আয়োজন করে থাকেন। সেসব আয়োজনে বিভিন্ন চমক অপেক্ষা করে, মানুষ সেসব গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখে।
এবার তিনি ভাবলেন একেবারে ভিন্ন কিছু দেখাবেন। যা দেখে মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ বয়ে যাবে। শহরে দ্রুতই ছড়িয়ে গেল খবরটা। ইউরোপ থেকে এক রমনী আসবেন, যিনি গ্যাস বেলুন চড়ে আকাশে ভেসে বেড়িয়ে দেখাবেন। এটা একই সাথে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটি কাজও বটে। কারণ যেকোনো সময় দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া, এই ধরণের গ্যাস বেলুনে চড়ে আকাশ চরে বেড়ানোর প্রদর্শনী আধুনিক কয়েকটি দেশে হয়েছে, কিন্তু এই বাংলায় এবারই প্রথম। মানুষের কোনো ধারণাই নেই এই ব্যাপারে। এখনো এখানকার মানুষের মধ্যে এই ধারণা জন্মায়নি যে, মানুষও আকাশে পত পত করে উড়ে বেড়াতে পারে। আবার যেহেতু তখন ইন্টারনেট, টেলিভিশন কিছুই নেই, তাই মানুষের কাছে আগ্রহ জাগানিয়া ঘটনা খুব কম।
এ ধরণের একটা কিছু ঘটবে শুনার পর শহরে এটাই হয়ে যায়, টক অব দ্যা টাউন! গ্যাস বেলুন কোম্পানিটির মালিক পার্ক ভ্যান তাসেল। তার কোম্পানি এর আগে অনেকগুলো প্রদর্শনী করেছে বিভিন্ন দেশে। খুব কৌশলে, প্রশিক্ষণ নিয়ে এই কাজ করার পরেও মাঝে মধ্যেই তাদের ছোটখাটো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়। আকাশের কথা কে বলতে পারে! এত উঁচুতে উড়বার পর আতংকেই তো অবস্থা খারাপ হওয়ার কথা। তবুও তারা এটি করেন, মানুষ যে এসব খুব পছন্দ করে। তাদেরকে ঢাকায় নিয়ে আসা কম দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়। বিশাল খরচাপাতির বিষয় আছে। নবাব পরিবার ছাড়া আর কে পারে এই আমোদ প্রমোদের খরচের যোগান দিতে। অতএব, বেলুন কোম্পানির সাথে নবাব আহসানউল্লাহর চুক্তি হলো। দশ হাজার টাকার চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী এক বিকেলে পার্ক ভ্যান তাসেলের কোম্পানি বেলুনে আকাশ জয় করার প্রদর্শনী দেখাবে।
১৮৯২ সালে দশ হাজার টাকা মানে আজকের দিনে সেটা কত টাকা একটু আন্দাজ করেই দেখুন! বিশাল বিলাসিতাই বটে! ঢাকঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানানো হলো এই ঘটনা সম্পর্কে। নগরবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। চারদিকে চাপা উত্তেজনা। দিন ধার্য হলো ১৭ই মার্চ। দেওয়ান গনিউর দেখতে পেলেন, নবাব বাড়ির চারধার আজ লোকে লোকারণ্য। বুড়িগঙ্গার এইদিকটায় আজ অসংখ্য মানুষের ভিড়। অনেকে এতটাই উৎসাহী যে, মাঝ নদীতে নৌকা নিয়ে অবস্থান নিয়েছে ঘটনা প্রত্যক্ষ করবার বাসনায়। নবাব আহসানউল্লাহ সপরিবারে নবাববাড়ির ছাদে বসে আছেন। নবাবকে খুব আদবের সহিত সালাম জানিয়ে হ্যান্ডশেক করলেন বেলুন কোম্পানির মালিক দীর্ঘকায় ব্যাক্তি পার্ক ভ্যান তাসেল।

জনাব পার্কের সাথে দুইজন নারী আছেন, একজন মধ্যবয়স্কা নারী, আরেকজন জেনি ভ্যান তাসেল। গনিউর ভেবেছেন জেনি বোধহয় পার্ক ভ্যান তাসেলের বোন হবে হয়ত। কিন্তু, জেনির সাথে পার্কের ছিল প্রণয়ের সম্পর্ক। যা হোক, দেখা যাচ্ছে নবাব কিছু একটা বলছেন বেলুন সওয়ারিদের। কিন্তু, তারা রাজি হচ্ছে না। যারা কাছাকাছি ছিলেন নবাবের তাদের মারফত জানা গেল, নবাব বেলুন সওয়ারিদের বলেছেন, তারা বেলুন নিয়ে বুড়িগঙ্গার ওপার থেকে এপারে আসবে, শুধু তাই নয় বেলুন অবতরণ করতে হবে নবাব বাড়ির ছাদে। কারণ, এটা নবাবের পরিবারের ছোট বাচ্চারা বেশ পছন্দ করবে। বাড়ির অন্দরমহলের পর্দার আড়ালে থাকা নারীরাও তাহলে এই আচানক দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হবে না।
কিন্তু, পার্ক বোঝাতে চাইলেন চুক্তিতে এমন কিছু ছিল না শর্ত হিসেবে। তারা শুধু বেলুন নিয়ে আকাশে উড়ে বেড়াবেন, আবার নেমে আসবেন। নবাব তাদের বোঝাতে থাকলেন। পার্ক বললেন, এমনটা করলে সেটা খুব রিস্কি হয়ে যাবে। আজকের বাতাস এমনিতেও অনুকূলে নেই। তাছাড়া, নবাবদের বাড়ির ছাদেই অবতরণ করতে হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা দেয়া যায় না এই অবস্থায়। তাছাড়া জেনি ভ্যান তাসেল, এমনিতেও অতটা ঝুঁকি নেবার মতো পারদর্শী এখনো হয়ে ওঠেনি। নবাব মানলেন না। তিনি জানালেন, তার কথামতো কাজ করতে পারলে চুক্তির বাইরেও আরো বাড়তি সাড়ে চার হাজার টাকা দেয়া হবে৷ বেলুন সওয়ারির দল ব্যাপারটা রফা করলো পাঁচ হাজার টাকায়। তারা টাকার মোহে রাজি হয়ে গেল।
পার্ক ভ্যান তাসেলের দল গ্যাস বেলুনে আকাশে ভেসে বেড়াবে নদীর দক্ষিণ পাড়ের দিক থেকে। সমবেত জনতার দল সবাই নদীর দক্ষিণ পাড়ের দিকে যেতে থাকলো। গনিউর নিজে একটা নৌকা নিয়ে মাঝ নদীতে গিয়ে বসে থাকলো। সে খুবই উত্তেজিত কী হয় দেখবার জন্যে। নদীর দক্ষিণ পাড়ে বিশাল আয়োজন। বেলুন ফোলানোর কারসাজি চলছে। গনিউর দেখতে পেলেন, কেরোসিন ব্যবহার করে লাকড়ি জ্বালানো হলো প্রথমে। লাকড়ির ধোঁয়া দিয়ে পূর্ণ করা হলো বেলুনকে। দেখতে দেখতে বেলুন ফুলে ফেঁপে বিশাল হয়ে গেলো। দড়ি দিয়ে বেলুন আটকে রাখা হয়েছে। হঠাৎ করে বন্দুকের বিকট আওয়াজ। বন্দুকের গুলি দিয়ে বেলুনের দড়ি কেটে দেয়া হলো। সমবেত জনতা দেখতে পেলো, বেলুন ধীরে ধীরে আকাশের দিকে উর্ধ্বমুখী যাত্রায় সওয়ার হয়েছে।
গনিউরের মনে হলো, সাধারণত যে উচ্চতায় চিল শকুন দেখা যায় তারও ওপরে উঠে গেল বেলুন। গ্যাস বেলুনটি ধেয়ে চলল উত্তরদিকে, উর্ধ্বমুখী বাতাসের হাওয়ায় হাওয়ায়। কিন্তু, তারপরই দেখা গেল বিপত্তি। আজ বাতাসের প্রকোপ অনেক বেশি৷ ফলে, উত্তরদিকে নবাবের বাড়িতে অবতরণ করার জন্য এতো উঁচুতে থাকা বেলুনের উচ্চতা যতটা নামিয়ে আনা দরকার ততটা পারা গেল না। বেলুন ভাসতেই থাকলো। জেনি ভ্যান তাসেল অসম সাহসের কাজ করে ফেললেন। তিনি প্যারাস্যুট খুলে ধুম করে লাফ দিলেন নবাব বাড়ির ছাদ উদ্দেশ্য করে। কিন্তু, বাতাস তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো আরো উত্তরে। নবাব বাড়ির ছাদ পেছনে ফেলে বেলুন চলে গেল আরো তিন মাইল দূরে।
অবশেষে জেনি আটকালেন একটা উঁচু গাছের ডগায়। নগরের লোক বুঝতে পারছিল না কি হচ্ছে। তারা ছুটে ছুটে অনুসরণ করছে জেনি ভ্যান তাসেলকে। জেনি আটকে থাকলেন গাছের উপরে। একটা আতংক ছড়িয়ে পড়লো। উদ্ধারকারী দল পৌঁছে গেল ঘটনাস্থলে। জায়গাটা জনমানবহীন, জংলামতো জায়গা। একজন গোরা পুলিশ অফিসার, সাথে ক’জন স্থানীয় পুলিশ আছে উদ্ধার তৎপরতায়। আনা হল একটি লম্বা বাঁশ, গাছের ভেতর দিয়ে সে বাঁশ পৌঁছে দেওয়া হল জেনির কাছে। গোরা অফিসার তাকে আহবান জানাতে থাকলো সে যেন বাঁশ ধরে ঝুলে নেমে পড়ে।
কিন্তু ইউরোপিয়ান লেডি জেনি ভয় পাচ্ছিলেন৷ তিনি সেই বাঁশ ধরে নেমে আসতে রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু পুলিশের অব্যাহত আহবানে তিনি অনন্যপায় হয়ে অবশেষে সেই বাঁশ ধরেই নেমে আসতে শুরু করলেন। অঘটন ঘটে গেল মাঝপথে, সেই বাঁশে জেনির ভার বহন করতে না পেরে দু’টুকরো হয়ে ভেঙ্গে গেল। জেনি পড়ে গেলেন সোজা নীচের অরক্ষিত ভূমিতে, মাথায় তীব্র চোট পেয়ে আহত হলেন গুরুতর। এই চোটেই যে জেনি মারা যাবেন কেউ ভাবেনি তা। হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি বাঁচলেন না। ১৮ই মার্চ তিনি মারা গেলেন৷
এই ঘটনা ইংরেজ প্রশাসন ও ঢাকাবাসীকে যেন মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। ঢাকার অভিযোগ, ইংরেজ পুলিশ কর্মকর্তার ব্যর্থতার জন্যই জেনির এই করুণ পরিণতি। আর অপরদিকে ইংরেজ প্রশাসনের পক্ষে বিভিন্ন ইংরেজি পত্রিকা অভিযোগ তুলেছিল যে ঢাকার অধিবাসীরা গুজব ছড়াচ্ছে। গণিউরের দিনলিপি থেকে জানা যায়, জেনির মা এবং পার্ক ভ্যান তাসেল পুলিশের নামে মামলা করতে চেয়েছিলেন। সম্ভবত নবাব আহসানউল্লাহ দুইপক্ষের মধ্যে কিছু অর্থ ক্ষতিপূরনের মাধ্যমে মিটমাট করে দেন।
সব বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে জিনেটের স্বামী পার্ক ভ্যান তাসেল দুই-এক দিন পর ঢাকা ত্যাগ করেন। তখনো উড়োজাহাজের প্রচলন ছিল না। তাই আকাশে মানুষ ভেসে বেড়ানো বিশাল এক ব্যাপারই। আর বাংলার আকাশ জয় করেছিলেন এক ভিনদেশী ইউরোপীয় নারী! যদিও কেউ কেউ তাকে আমেরিকান অভিবাসী বলেন। কিন্তু, ভাগ্যের কি নির্মম ফের! মানুষকে আনন্দ দিতে গিয়ে কি করুণ পরিণতি বরণ করতে হলো সেই জেনিকে! তিনি থেকে গিয়েছেন এই ঢাকাতেই, নারিন্দায় খ্রিস্টান কবরস্থানে শায়িত এই জেনি। শায়িত হয়ে আছে, এক অদ্ভুত ইতিহাস, আকাশ জয়ের ইতিহাস!