পটকা, আতশবাজি অথবা প্রতিবাদের কিছু অগ্নিস্ফুলিঙ্গ
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

এক পক্ষ ধর্মের নামে ফতোয়া দিলো, অন্য পক্ষ আইনের নামে। আইন শৃঙখলা রক্ষার মানে এই নয় যে মানুষকে গৃহবন্দী করে রাখতে হবে। সাধারণ মানুষকে রাতে বাইরে বেরিয়ে আনন্দ করতে দেয়ার পরিবেশ তৈরি করতে পারছেন না মানে আপনি ব্যর্থ, সেই ব্যর্থতা ঢাকার জন্যে বাড়ির ছাদেও উৎসব করার ওপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে নিজেদের দুর্বলতাই তো ঢাকতে চাইলেন আপনারা, তাই না?
আকাশ জুড়ে আলোর রোশনাই, পটকা আর আতশবাজীর আওয়াজে কানে তালা লেগে যাওয়ার অবস্থা। রাত বারোটার কয়েক মিনিট আগে শুরু হয়ে প্রায় পনেরো-বিশ মিনিট চললো নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার এই আয়োজন। পুলিশের নিষেধাজ্ঞা, হাজার রকমের বিধি-নিষেধের বেড়াজাল, ধর্মান্ধদের রক্তচক্ষু আর ধর্মের নামে চৌদ্দ রকমের ফতোয়াকে অগ্রাহ্য করে ঢাকার মানুষ যে ২০২০ সালকে এই আলো আর শব্দের মেলায় বরণ করে নিলো, এটা দেখেই প্রাণটা জুড়িয়ে গেছে। প্রতিটা পটকার বিদঘুটে আওয়াজে যেন মিশে ছিল নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি তীব্র ব্যাঙ্গ আর বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের বার্তা- যারা কীনা থার্টি ফার্স্টের ঘরোয়া অনুষ্ঠানেও 'অনুমতি'র নিয়ম বানিয়ে রেখেছিল!
গত কয়েক বছর ধরেই ইংরেজী নতুন বছরকে স্বাগত জানানোটা বাঙালির জন্যে কঠিণ হয়ে উঠেছে। একদিকে আছে কাটমোল্লার দল, যারা ধর্মকে ঢাক বানিয়ে উল্টোপাল্টা যুক্তি দেখিয়ে দাবী করে, নববর্ষ পালন ইসলামে হারাম, নব্বই পার্সেন্ট মুসলমানের দেশে থার্টি ফার্স্ট নাইট মানেই বেদাতি কার্যক্রম, ধর্মকে অবমাননা, ব্লা ব্লা ব্লা।
অন্যদিকে আছে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ভাইয়েরা। যাদের কাজ অপরাধ সংঘটিত হলে সেই অপরাধীকে গ্রেফতার করা, তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা, এবং কেউ যেন অপরাধ করতে না পারে, সেই পরিবেশটাও নিশ্চিত করা। তৃতীয় কাজটা করতে গিয়ে তারা থার্টি ফার্স্ট নাইটের উৎসবটাই বানচাল করে দিলেন। অনুষ্ঠান নেই, মানে অপরাধও নেই- এমনটাই ছিল তাদের চিন্তাভাবনা।

দফায় দফায় ফতোয়া জারী হলো, বলা হলো, থার্টি ফার্স্ট নাইট এবং নতুন বছরের প্রথম প্রহরে কোন ওপেন এয়ার কনসার্ট, ডিজে পার্টি কিংবা প্রকাশ্য স্থানে কোনো জমায়েত, সমাবেশ বা উৎসব করা যাবেনা। এরপরে ফতোয়া এলো- আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশংকায় উন্মুক্ত স্থান অর্থাৎ রাস্তা বা ফ্লাইওভার, এমনকি বাড়ির ছাদেও কোনো উৎসব আয়োজন করা যাবে না। সন্ধ্যা ছয়টার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জনসাধারণ এবং যানবাহনের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হলো। বলা হলো, পটকা বা আতশবাজী যেন ফোটানো না হয়।
এক পক্ষ ধর্মের নামে ফতোয়া দিলো, অন্য পক্ষ আইনের নামে। আইন শৃঙখলা রক্ষার মানে এই নয় যে মানুষকে গৃহবন্দী করে রাখতে হবে। সাধারণ মানুষকে রাতে বাইরে বেরিয়ে আনন্দ করতে দেয়ার পরিবেশ তৈরি করতে পারছেন না মানে আপনি ব্যর্থ, সেই ব্যর্থতা ঢাকার জন্যে বাড়ির ছাদেও উৎসব করার ওপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে নিজেদের দুর্বলতাই তো ঢাকতে চাইলেন আপনারা, তাই না?
সেই ফতোয়াবাজী মানলো না ঢাকার মানুষ। ঠিক মধ্যরাতে ঝলসে উঠলো ঢাকা, হাজার হাজার ফানুসে ছেয়ে গেল আকাশ, পটকা আর আতশবাজীর শব্দে কান পাতা দায়। প্রতিটা পটকা যেন প্রতিবাদী বুলেট হয়ে আঘাত করেছে সেই লোকগুলোর বুকে, যারা ঢাকার মানুষকে বদ্ধ কামরায় আটকে রাখতে চেয়েছিলেন এই উৎসবের রাতে, এই আনন্দের মুহূর্তে। অন্য সময়ে হলে এমন শব্দের মেলায় বিপন্ন বোধ করতাম, সমালোচনার জায়গাও তৈরি হতে পারতো। কিন্ত যখনই মাথায় এসেছে, এই আয়োজনের পুরোটাই একটা প্রতিবাদী গানে রূপ নিচ্ছে, তখনই অদ্ভুত এক আনন্দে মন ভরে গেছে।

ওহে রক্ষক, ঘরে এবং ঘরের বাইরে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা আপনাদের কাজ, আপনাদের দায়িত্ব। তা করতে গিয়ে আপনারা যখন আমাদের দাবিয়ে রাখাটাকেই একমাত্র রাস্তা ভাবেন, সেটা ভীষণ ভুল একটা ধারণা। ঘরে থাকলেই সব যদি নিরাপদ থাকে, তাহলে বছরজুড়ে ১৪৪ ধারা চলুক, ভবন ধ্বসে, গার্মেন্টসে আগুন লেগে, গাড়ির নিচে চাপা পড়ে আর কেউ মারা যাবে না, সবাই সুরক্ষিত থাকবে। এই আইডিয়াগুলো কাদের মাথা থেকে বেরোয় আমরা জানিনা, তবে সেই মাথাগুলো যে ভীষণ মোটা, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
অদ্ভুত এক দেশ, এখানে বখাটেদের হাতে পহেলা বৈশাখে তরুণীরা নিগ্রহের শিকার হলে পুলিশ পরের বছর পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানই বন্ধ করে দিতে চায়, বিকেল পাঁচটার সীমারেখা বেঁধে দেয়! 'অনভিপ্রেত' ঘটনার আশঙ্কায় থার্টি ফার্স্ট নাইটের উৎসব পালন করতে দিতে চায় না তারা। নিরাপত্তা দিতে না পারলে অপারগতা স্বীকার করে নেবেন দয়া করে, আমরা জানবো, নিরাপত্তা পাবার অধিকার আমাদের নেই। কিন্ত জোর করে নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে আমাদের গৃহবন্দী করার চেষ্টা করবেন না, আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার নেশায় মাতবেন না। তাতে হিতে বিপরীত হবে, প্রতিবাদের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ এভাবেই পটকা, আতশবাজি কিংবা ফানুসের রূপ ধরেই বেরিয়ে আসবে। শুভ নববর্ষ!
ছবি কৃতজ্ঞতা- সাকিব হাসনাত, এসকে তানভীর আহমেদ, মাহমুদ হোসাইন অপু