ফিফা র‍্যাংকিংয়ের সদ্য পুরনো পদ্ধতি যা ২০০৬ থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত আমরা দেখে এসেছিলাম, তা বলবৎ থাকলে বাংলাদেশের অবস্থান আজ ১৮৭ এর বদলে ১৫৬ তে থাকতে পারতো!

বর্তমানে ফিফা তাদের র‍্যাংকিং নির্ধারণে ই.এল.ও পদ্ধতি দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং এই নিয়মে যে কোন দল র‍্যাংকিংয়ে খুব দ্রুত উন্নতি করতে পারবে না কিংবা পতনও সম্ভব নয় যা আমরা পূর্ববর্তী র‍্যাংকিং পদ্ধতিতে দেখে এসেছিলাম। ২০১৪ এর ডিসেম্বরে ভারতের ফিফা র‍্যাংকিং ছিল ১৭১ এবং ২০১৫ এর জানুয়ারিতেও ঠিক তাই যখন তারা ২০১৮ ফিফা বিশ্বকাপ ও ২০১৯ এএফসি এশিয়া কাপের যুগ্ম বাছাই এর ড্র তে প্রবেশ করেছিল। ২০১৪ এর জানুয়ারিতে তাদের ই.এল.ও র‍্যাংকিং ছিল ১৮১। বর্তমানে যদিও তাদের ফিফা র‍্যাংকিং ১০৮; তথাপি ই.এল.ও র‍্যাংকিং মাত্র ১৬১। ২০১৫ এর মার্চ থেকে ২০১৭ এর জুনের ভেতর খেলা ২৩ ম্যাচ থেকে ১৪ জয় ও ২ ড্র তে ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ভারত ইতিহাসে তাদের সেরা ফিফা র‍্যাংকিংয়ে পৌছায়, ৯৬ তে। ফিফা র‍্যাংকিংয়ের নিয়ম বদলাবার ঠিক আগে আগে ২০১৮ এর জুনে তাদের অবস্থান ছিল ৯৭। ২০১৭ এর জুলাই থেকে ২০১৮ এর ৪র্থ জুনের ভেতর খেলা ৮ ম্যাচ থেকে ৫ জয় ও ২ ড্র তে শীর্ষ একশো এর ভেতর ভারত নিজেদের অবস্থান নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়। ফিফার নতুন র‍্যাংকিংয়ে পদ্ধতি চালু হবার পর খেলা ২২ ম্যাচে ৬ জয় ও ৬ ড্র তে তাদের অবস্থান খুব বেশি না, পিছিয়ে আসে ১০৮-এ। কিন্তু পুরাতন পদ্ধতি জারি থাকলে তারা আরও অনেক বেশি পিছিয়ে যেত। পরিবর্তনটি আসার পূর্বে ২০১৮ এর জুনে ১৩২ পয়েন্ট নিয়ে দক্ষিণ সুদান ছিল ১৫৬-তে। আমাদের হিসেব অনুযায়ী পুরাতন পদ্ধতিতে বাংলাদেশের বর্তমান ফিফা পয়েন্ট ১৩২, যা ২০১৮ এর জুন অনুযায়ী ধরলে আমাদের অবস্থান এখন হতে পারতো ১৫৬।

আমরা থাকতে পারতাম র‍্যাংকিংয়ের ১৫০ থেকে ১৬০ এর ভেতর

এই কথাগুলো বলা হচ্ছে এটা বোঝাতে যে, জেমি ডে'র অধীনে তরুণ বাংলাদেশ দলটি খুব ভালো করছে যার অংশ জামাল ভূঁইয়া ও আশরাফুল রানা'র মত যোগ্য কিছু সিনিয়র খেলোয়াড়। এবং এটাও উল্লেখ করতে যে, র‍্যাংকিংয়ে ধুপধাপ উন্নতি করা এখন আর আগের মত সম্ভব হচ্ছে না। র‍্যাংকিংয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে এখন কাগজে-কলমে ও মাঠের খেলা অনুযায়ী বাংলাদেশ দলটিকে বিচার করতে হবে। আজ আমাদের অবস্থান ১৮৭ তে হলেও আমাদের খেলার ধরণ আমাদের বর্তমান অবস্থানের চাইতেও নিঃসন্দেহে অনেক উঁচুতে।

২০১৭ এর ১৭ই মে জেমি যখন আমাদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ঠিক সে দিন প্রকাশিত ফিফা র‍্যাংকিংয়ে আমাদের অবস্থান ছিল ১৯৭। এর পর খেলা ১৯ ম্যাচে প্রাপ্ত ৮ জয় ও ২ ড্র তে আজ আমরা হয়তো বলতে পারতাম যে জেমির অধীনে ৪১ ধাপ উন্নতি করে ১৫৬ তে পৌঁছেছি আমরা। বাংলাদেশ ফুটবলে উদাসীন মানুষদের মনের ভেতর তা সমূহ পরিবর্তন আনতে পারতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে জেমির ভালো কাজগুলো চোখে পড়লো না নতুন পদ্ধতিতে। লোকে বলে যে আমাদের মাত্র ১০ ধাপ উন্নতি হয়েছে। হ্যাঁ, ঠিক ১৫৬-তেই যে থাকতাম আমরা তেমনটা না হয়তো, কারণ অন্যান্য দলগুলোর ফলাফলে এদিক ওদিক হতো। তবে ২০১৮ এর মে থেকে ৯৯ পয়েন্টের উন্নতিতে এটা বলাই যায় যে আমাদের অবস্থান হতো ১৫০ এর ঘরের শুরু থেকে ১৬০ এর ঘরের শুরুর ভেতরেই।

আমরা যদি ২০১৫ সালের অক্টোবরের র‍্যাংকিং বিবেচনায় নেই, যখন কিনা সেই সময়কার বাছাইয়ের খেলা ঠিক একই জায়গায় ছিল বর্তমানে চলা বাছাইপর্বের মতো, যেখানে সবগুলো দল গ্রুপে নিজেদের ৪-৫টি করে ম্যাচ শেষ করেছে; তাহলে আমরা দেখতে পারবো যে সেই সময়ে ১৩২ পয়েন্ট নিয়ে কুক আইল্যান্ডের অবস্থান ছিল ১৬৬ তে। ২০১৫ এর অক্টোবর থেকে ২০১৮ এর জুনের ভেতর আপনি যে কোন মাসই ধরুন না কেন, ১৩২ পয়েন্ট নিয়ে কোন দলের অবস্থানই ১৭০ এর নিচে যাবে না। ১৩২ পয়েন্ট পেলে ওই সময়ের ভেতর র‍্যাংকিংয়ে গড় অবস্থান থাকতো ১৬৪।

তবে জেমি'র কাজ এখনও শেষ হয়নি মোটেও। ২০১৫ সালে আমরা দেখেছিলাম কিভাবে বাবু-মামুনুল-এমেলি সিন্ডিকেটে জাতীয় দলের সর্বনাশ হয়েছিল। যে ধারা আজও চলছে রূপুর মাধ্যমে। জেমি যদি রূপুর প্রভাবের ঊর্ধ্বে না ওঠতে পারে তাহলে তার পরিশ্রম সব মাটি হয়ে যাবে। আমরা আবারও কুয়োর গভীরে চলে যাবো। জীবন কিংবা রায়হানের মত খেলোয়াড়দের সীমাবদ্ধতাকে আমরা শ্রদ্ধা করি, কিন্তু তাদের বারবার একাদশে খেলিয়ে রূপু ইতিমধ্যে আমাদের আরও বেশ কিছু ভালো ফল থেকে বঞ্চিত করেছে। বলা হয় যে, 'একটি লোহার চেইন ঠিক ততটুকুই শক্তিশালী যতটা দুর্বল চেইনটির সবচেয়ে কম শক্তির সন্ধিস্থল'। জেমির দলটি যতই প্রতিশ্রুতিশীল হোক না কেন, রূপুর অন্যায় পছন্দের ২-১ জন ফুটবলার দলের সম্ভাব্য সব ক্ষতিই করে চলেছে। বাবুদের ব্যাপারে বাফুফে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এখনই সময় যে রূপুকে সরিয়ে জেমিকে নির্বিঘ্নে কাজ করবার সুযোগ করে দেয়া। কারণ সামনের কয়েক মাস আমাদের ফুটবলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ফুটবলার ও সমর্থকদের চরিত্র গঠন করে দিয়ে যাবে।

শেষ করবার আগে এবারের বিশ্বকাপ ও এশিয়া কাপের যুগ্ম বাছাই এর ড্র অনুষ্ঠানে বাংলাদেশকে নিয়ে বলা কিছু কথা উল্লেখ করতে চাই। ২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিলের ঘটনা। ড্র হবার আগে প্রথম রাউন্ডে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে নিয়ে কথা হচ্ছিল যাতে অংশ নেয় সিঙ্গাপুরের এক সাবেক ফুটবলার রাইশ রোশান রায় ও ইন্দোনেশিয়া জাতীয় দলের তখনকার স্কটিশ হেড কোচ সাইমন ম্যাকমেনেমি যিনি ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়াতে লীগ শিরোপা জিতেছেন। উল্লেখ্য প্রথম রাউন্ডে অংশ নেয়া ১২টি দলের ভেতর মালয়েশিয়ার মত দলও ছিল।

উপস্থাপিকা: কোন দল কে আপনাদের মনে হয় যে পরবর্তী ধাপে পৌঁছে সেখানকার বড় প্রতিপক্ষগুলোর বিপক্ষে অঘটন ঘটাতে পারবে?

সাইমন: আমার যা মনে হয়, প্রথম রাউন্ডে অংশগ্রহণকারী দলসমূহের ভেতর বাংলাদেশ কে অন্যান্যদের থেকে এগিয়ে রাখবো এবং তা খানিকের জন্য হলেও। একই পর্যায়ের প্রতিপক্ষের বিপক্ষে তারা বরাবরই খুব ভালো খেলে। আপনি যদি তাদের শেষ এক বছরের ফলাফল দেখেন তবে খেয়াল করবেন যে তারা কিন্তু খুব বেশি গোল হজম করে না। তারা এক ব্রিটিশ কোচের অধীনে আছে এবং যেহেতু তার দল খুব কম গোল হজম করে তাই তাদের হারানো বেশ দুরূহ। যে কোন প্রেক্ষাপটেই তাদের হারানো খুব কঠিন এবং তাদের বেশ ভালো পরিমাণে খেলোয়াড় আছে একাদশ গঠনের জন্য। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই যে তাদের ঘরোয়া লীগ দিন দিন উন্নত হচ্ছে।

ইন্দোনেশিয়া জাতীয় দলের তখনকার স্কটিশ হেড কোচ সাইমন ম্যাকমেনেমি

উপস্থাপিকা: বছর চারেক আগে ভারত প্রতিযোগিতার ঠিক এই পর্যায়ে ছিল। তারপর র‍্যাংকিংয়ের ১৭১ থেকে তারা শীর্ষ একশো এর ভেতর ঢুকে পড়ে এবং চাইনিজ তাইপে, ইয়েমেন কিংবা নেপালও উন্নতি করেছিল। আপনাদের কি মনে হয় এবারের এই পর্যায় থেকে কোন দল সেরকম কিছু করে দেখাতে পারবে?

রোশান: আমি বাংলাদেশের কথাই বলবো। আসলে আমরা ইতিমধ্যেই তাদের ব্যাপারে ইতিবাচক শব্দ উচ্চারণ করেছি। একই পর্যায়ের প্রতিপক্ষের বিপক্ষে তারা সব সময়ই বেশ শক্তভাবে খেলে থাকে। তারা তাদের খেলার ধারা পরিবর্তন করেছে। গতবারের এশিয়ান গেমসে তারা নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মত নক আউটে কোয়ালিফাই করেছিল যা প্রমাণ করে যে কিরকম প্রতিভা উঠে আসছে।

সাইমন: রোশানের সাথে আমি একমত কারণ আপনি যদি তাদের ঘরোয়া ফুটবলের দিকে তাকান, তাদের লীগ কিন্তু ধাপে ধাপে উন্নতি করে চলেছে। তারা এখন বেশ বড় মাপের বিদেশি খেলোয়াড় আকৃষ্ট করছে। ভারতের আইএসএল থেকে ২-৩ জন এসেছে সেখানে। এখন তারা যদি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কিছু ফুটবলার আনতে পারে জাতীয় দলের জন্য যা গুয়াম এর মত কয়েকটি দেশ করেছে, তারা ফিফা রেংকিং এ খুব ভালোভাবে দৌড়িয়ে উঠবে।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা