ধন্যবাদ, ফজলুল করিম! আপনারাই সত্যিকারের নায়ক
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
পদ্মায় ফেরি ডুবিতে শতাধিক মানুষ নিখোঁজ, পত্রিকাজুড়ে আজ এমন খবর থাকতে পারতো। কিন্তু...
যার কারণে এমন খবর হয়নি, যিনি চার শতাধিক মানুষকে বিপদটাও বুঝতে দেননি সেই মানুষটার নাম ফজলুল করিম, যিনি পেশায় একজন ফেরিচালক যার পদবী ইনচার্জ মাস্টার।
ঘটনাস্থল পদ্মা নদী। রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সাতটি ট্রাক, ৫টি যাত্রীবোঝাই বাস ও ৭টি ছোট গাড়ি নিয়ে মাওয়ার শিমুলিয়া ঘাট থেকে ছেড়ে যায় যায় রাণীগঞ্জ নামের একটি ডাম্ব ফেরি। ফেরিটিতে যাত্রী ও কর্মীসহ চার শতাধিক মানুষ ছিল।
যারা নিয়মিত পদ্মা পাড়ি দেন তারা জানেন এই ডাম্ব ফেরিগুলোর নিজস্ব ইঞ্জিন নেই। যানবাহন ওঠানোর পর অন্য একটি শক্তিশালী জাহাজ ফেরিটিকে ঠেলে নিয়ে যায়। ব্রিটিশ শাসনামলে এই মডেলের ফেরিগুলোর প্রচলন হয যেগুলার কয়েকটি এখনো পদ্মায় চলছে। রাণীগঞ্জ ফেরিটি তেমনি যেটি অন্তত ৬০ বছরের পুরোনো।
এই ফেরি নিয়েই চলছিলেন ফজলুল করিম। রাত ১১ টার দিকে ফেরিটি যখন পদ্মা সেতু সংলগ্ন হাজরা চ্যানেলের কাছাকাছি পৌঁছায় তখন সেতু স্থাপনের কাজে ব্যবহৃত ড্রেজারের পাইপের সাথে প্রবল বেগে ধাক্কা খায়।শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে ফজলুল করিম দেখতে পান ফেরির তলা ফেটে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করছে। এরপর পাম্প দিয়ে পানি নিষ্কাশনের চেষ্টা করেও তারা ব্যর্থ হন।
এরপর ফেরির কর্মচারীদেরকে তিনি দায়িত্ব দেন বালি, কম্বল যা কিছু আছে সেগুলো দিয়ে যতোটা সম্ভব পানি প্রবেশ ঠেকাতে। এরপর তিনি দ্রুত গতিতে ঘাটের দিকে রওনা হন। তখনও ঘন কুয়াশা না পড়ায় ২০ মিনিটের মধ্যে বাংলাবাজার ঘাটে পৌঁছে যায় ফেরিটি। ততোক্ষণে ফেরির ওপরে পানি উঠতে শুরু করেছে।
ফজলুল করিম যাত্রীদের কিছুই বুঝতে দেননি। একে একে সব গাড়ি আনলোড করার পর তিনি ঘাটের উল্টো পাশেই ফেরিটি নোঙর করেন।ফেরির কর্মী ও পরবর্তীতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা পানি নিষ্কাশনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। মধ্যরাতে ফেরিটির নব্বই শতাংশ ডুবে যায়।
যারা ঘটনার ভয়াবহতা বুঝতে পারছেন না, তাদের নিয়ে যাই আরিচা-পাটুরিয়া ঘাটে। প্রায় একই সময়ের ঘটনা। ঘণ কুয়াশার কারণে নৌপথ দেখতে না পাওয়ায় রোববার রাত থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
একপর্যায়ে রাত ১২টার দিকে কুয়াশার তীব্রতা বেড়ে গেলে আগে থেকে ছেড়ে যাওয়া ছয়টি ফেরি দিক হারিয়ে মাঝনদীতে এদিক–সেদিক যেতে থাকে। পথ না পেয়ে মাঝনদীতে সেগুলো নোঙর করে ছিল। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে কুয়াশার তীব্রতা কমে গেলে ফেরি চলাচল পুনরায় শুরু হয়।
এইবার ভাবেন! আর যদি মাত্র ২০ মিনিট দেরি হতো মাওয়া-জাজিরা ঘাটে মানে ঘন কুয়াশায় মাঝ নদীতে আটকা পড়তো রাণীগঞ্জ ফেরিটা তাহলে হয়তো সব যাত্রীকে নিয়ে ডুবতে হতো। কিন্তু ফজলুল করিমের বুদ্ধিমত্তায় সেটি রক্ষা পেয়েছে। বিবিসিতে তার সাক্ষাতকারে দেখলাম তিনি বলেছেন,তার জীবনে এমন অভিজ্ঞতা এটাই প্রথম। তবে তার মাথাতে এটাই ছিল যে ঘাবড়ানো যাবে না। ধৈর্য হারানো যাবে না। 'কেউ বুঝেও নাই, কতো বড় বিপদ থেকে আল্লাহয় আমাদেরে বাঁচাইছে।'
আমি মনে করি ফজলুল করিমকে তাঁর দায়িত্বশীলতার জন্য পুরুষ্কৃত করা উচিত। আমরা অনেকেই মনে করি শিক্ষা বা কাজের উদ্দেশ্যে বড় চাকুরি। আসলে তা নয়। বরং শিক্ষার উদ্দেশ্যে হচ্ছে মানুষ হওয়া। মানুষের সেবা করাটা বুঝতে পারা। ফজলুল করিম বুঝতে পেরেছিলেন সেটা যথাসময়ে। কিন্তু আফসোস আমাদের বহু বড় বড় সনদধারী মানুষ কিংবা দায়িত্বশীলরা বুঝতে পারেন না। তাই তারা আমাদের ডুবিয়ে দেয়। ডুবিয়ে দেয় দেশকে। কিন্তু ফজলুল করিমের মতো মানুষেরা বাঁচিয়ে দেয় বহু মানুষের জীবন।
জনাব ফজলুল করিম, সব সময় নেতিবাচক কথা বলা এই জাতি আপনার খবরটি ভাইরাল করবে না। আজকের পত্রিকায় আপনার কোনো ছবি বা খবরটাও পেলাম না। জানি গণমাধ্যমের খবরে আপনাকে পাওয়া যাবে না। আবার এই রাষ্ট্র আপনাকে কতোটা সম্মান জানাবে সেটাও আমি জানি না। কিন্তু আমার যেহেতু লেখার শক্তি আছে আমি আপনাকে নিয়ে লিখলাম। সাথে আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ধন্যবাদ আপনার সব সহযোদ্ধাকে। মাত্র একদিন আগে এই ফেরিতে করেই আমি পদ্মা পাড়ি দিয়েছি। শতাধিক মানুষকে বাঁচিয়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়ায় আপনাকে সম্মান জানাচ্ছি।
মাননীয় নৌ পরিবহনমন্ত্রী Khalid Mahmud Chowdhury ভাইয়ের কাছে অনুরোধ, ফজলুল করিমের মত মানুষকে যেন সম্মান জানান। তিনি যেভাবে নৌপথ মন্ত্রণালয়কে গোছাতে চাইছেন তাতে ফজলুল করিমের মত সাধারন মানুষেরা বড় শক্তি। আমার মতো সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ফজলুল করিমকে। আমি বলবো, আপনারাই আমাদের সত্যিকারের নায়ক।
ছবি কৃতজ্ঞতা- বিবিসি
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন