তিনি তো কোথাও দাবী করেননি যে করোনার ভ্যাক্সিন নিয়ে এসেছেন, কিংবা করোনা আক্রান্ত সবাইকে তিনি সুস্থ করে দিতে পারবেন। তিনি এসেছিলেন কমিউনিটি সেবা দিতে, ফিরে গেলেন অপমানিত হয়ে।

বাংলাদেশের এয়ারপোর্টে অবতরণের সাথে সাথেই তাকে বলা হয়েছিলো- 'পাসপোর্টটা দিন, ফলো মি।' অ্যান্টিবডির সনদ থাকা সত্ত্বেও সেখান থেকে তাকে সরাসরি পাঠানো হয়েছে আশকোনার হজ ক্যাম্পে। তার ফ্লাইটের ১২৯ জন যাত্রীর মধ্যে ১২৮ জনকে হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অথচ তাকে একা সেই সুযোগ না দিয়ে চৌদ্দ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন পালন করতে বাধ্য করা হয়েছে। দারুণ এই আতিথিয়তার মাধ্যমে তার সঙ্গে আনা ৮ সুটকেস মাস্ক, গ্লাভস ও পিপিই আটকে দিয়েছিলেন কাস্টমস কর্মকর্তারা।

তিনি দেশে এসেছিলেন তিন সপ্তাহের সময় নিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল কোভিড-১৯ রোগীদের সেবা দেওয়া এবং বনানীতে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য কাজ শুরু করা। কিন্তু এর মধ্যে দুই সপ্তাহ প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকতে বাধ্য হওয়ায় তার সেই পরিকল্পনা থমকে গিয়েছে। অন্তত তাকে হোম কোয়ারিন্টিনের সুযোগটা দেয়া হলে প্রাথমিক কাজগুলো এগিয়ে রাখতে পারতেন।

স্থানীয় ১০ জন ডাক্তার, ১০ জন কর্মচারী, ৫০/৬০ জন মেডিকেল স্টুডেন্টকে নিয়ে একটি মেডিকেল টিমও নাকি গঠন করেছিলেন। যেন তারা প্রতিদিন অসুস্থ রোগীদের সেবা দিতে পারে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য বনানীতে একটি ভবন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মৌখিক আলাপ করেছিলেন ফেরদৌস। কিন্তু সেই ভবন অন্য আরেকটি সংস্থাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। 

মিঃ হাইজিন জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি

প্রতিদিন ১০ জন ডাক্তার নিয়োগ করে সার্বক্ষণিক ৬ জন সেবায় নিয়োজিত থাকলে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দিনে আনুমানিক ৩০০ রোগীর সেবা দেওয়া যেত। অন্তত ৩ মাস এই সেবার প্রদানের পরিকল্পনা করেছিলেন, যার ফলে ঢাকার ভেতরেই আনুমানিক ২৭০০ রোগীকে সেবা দেওয়া যেত। ঢাকার পরে কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে আরও দুইটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র খোলার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। 

নিউইয়র্কের একজন চিকিৎসক বাংলাদেশে এসে আইনগতভাবে চিকিৎসা সেবা দিতে পারেন কিনা, সেই প্রশ্নও তোলা হয়েছিলো। অথচ  তিনি এমবিবিএস পাস করেছেন বাংলাদেশে। দেশে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার ‘লাইসেন্সও’ তার আছে। এরই মাঝে কখনো ‘বঙ্গবন্ধুর খুনির আত্মীয়’ হিসেবে, কখনোবা ‘জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার’ অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধে চালানো হয় অপপ্রচার।

তিনি নাকি পলাতক তারেক জিয়ার ফান্ডিং যোগাড় করেন, তার মূল লক্ষ্য নাকি কুমিল্লার এমপি হওয়া। অনেকে তো আবার তাকে ‘দালাল’ উপাধিতেও ভূষিত করে দিয়েছেন ইতিমধ্যে। অথচ কোয়ারেন্টিন শেষে হতেই মানুষটা  ছুটে গেলেন একজন মুমূর্ষ রোগীর জীবন বাঁচাতে, নিজের প্লাজমা দান করলেন। 

গত ৭ই জুন তিনি দেশে আসেন, এরপর ২১শে জুন কোয়ারেন্টিন থেকে মুক্ত হয়ে তিনি যখন করোনা রোগীদের জন্য কাজ করার চেষ্টা করেন- ‘অজ্ঞাত’ কারণে বাধাপ্রাপ্ত হন। বাধ্য হয়ে ২৪শে জুন রাতে নিউইয়র্কে ফিরে যাওয়ার উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেন। তাকে আমরা এক প্রকার বন্দী করেই রাখলাম। এরপর অপমান করে দেশ থেকে বের করে দিলাম। 

অথচ এই মানুষটা যুক্তরাষ্ট্রের মাউন্ট সিনাই কুইন্স হসপিটাল এবং প্রেসবাইটেরিয়ান কুইন্স হসপিটালে চিকিৎসক হিসেবে 'অ্যাফিলিয়েটেড'। এছাড়া সেখানে তার তিনটি ক্লিনিক আছে, সাতজন ডাক্তার তার সাথে কাজ করেন। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আলোচিত হন তিনি। ওদিকে 'প্রচারপ্রিয়' হিসেবে তার সমালোচনাও হয়েছে। 

ডা. ফেরদৌস খন্দকার

তবে তার ব্যাখ্যাটা হচ্ছে, তিনি যে কাজটা করছেন সেটাই প্রচার করেছেন শুধু। যাতে অন্যরা তাকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে তার ডাক্তারির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে বলেও অপপ্রচার চালানো হয়েছে তার বিরুদ্ধে। অথচ লাইসেন্স ছাড়া কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মত জায়গায় চিকিৎসা প্রদান করা যায়?  

প্রতি ৩/৪ মাস অন্তর অন্তর যে মানুষটা ছুটে আসতেন মাটির টানে, এবার ফিরে গেলেন অপমানিত হয়ে। তিনি তো কোথাও দাবী করেননি যে করোনার ভ্যাক্সিন নিয়ে এসেছেন, কিংবা করোনা আক্রান্ত সবাইকে তিনি সুস্থ করে দিতে পারবেন। তিনি এসেছিলেন কমিউনিটি সেবা দিতে, ফিরে গেলেন অপমানিত হয়ে, নিজের সর্বোচ্চ চেস্টাটা চালিয়ে যেতে এসেছিলেন। আর এতেই যতো সমস্যা। তিনি দেশে আসায় কার এতো ক্ষতি হলো সেটাও ঠিক বোধগম্য না। অবশ্য গুণীর কদর এই দেশে কখনোই ছিলো না। তাইতো যোগ্য মানুষের অভাবেই ভুগি আমরা।

ডা. ফেরদৌস সেসব বিরল মানুষদের একজন যারা যেকোনও অবস্থাতেও এখনো দেশকে ভালোবাসে, দেশের মানুষকে ভালোবাসে। আর সেই মানুষটিকে আমরা এই প্রতিদান দিলাম?  এটাই কি তার প্রাপ্য ছিলো? 

তথ্যসূত্র- বিডি নিউজ২৪, কালেরকন্ঠ 

আরও পড়ুন- 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা