একজন শান্ত নদীর মতো স্থিতধী, অন্যজন যেন বন্য ম্যাটাডোর। দুজনের স্বভাব একদম আলাদা, খেলার ধরণ আলাদা, টেনিস কোর্টে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী তারা; তবু নাদাল যখন বিশতম গ্র‍্যান্ডস্লামটা জিতে ফেদেরারকে ছুঁলেন, ফেড-এক্সই সবার আগে অভিনন্দন জানালেন তাকে!

ফুটবলে দ্বৈরথ বলতে আমরা একসময়ে পেলে-ম্যারাডোনাকে বুঝলেও মূল দ্বৈরথ আমরা লক্ষ্য করেছি মেসি-রোনালদো এর বেলায়। 'রোনালদো' নামে এক ডকুমেন্টারি দেখেছিলাম কয়েক বছর আগে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো'র স্ট্রাগলকে উপজীব্য করে বানানো এ ডকুমেন্টারিতে রোনালদো অকপটে স্বীকার করেছেন-

I made Messi, Messi Made me.

বাক্যটি নির্জলা সত্য। ছায়ার সাথে দ্বন্দ্ব হয় না। প্রতিযোগিতাও হয় না। হয় মানুষের সাথে। নিজের সাথেও একটা দ্বন্দ্ব অবশ্য হয়। নিজেকেই নিজে ছাপিয়ে যাওয়ার একটা লড়াই ভেতরে ভেতরে সবারই থাকে। সেটি প্রচ্ছন্ন লড়াই। অত প্রকট কিছু নয়। শত্রুতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলতে যা বোঝায়, তা যেন নলেন গুড়ের পায়েসের মত জমাট হয়, সেয়ানে সেয়ানে লড়াই হলে। এই যেমন টেনিসের কথাই ধরি না কেন। রাফায়েল নাদাল ও রজার ফেদেরারের যে ক্লাসিক ব্যাটল... তার সাথে কীসের তুলনা করা যায়! 

একদিকে একজন ধীরস্থির শান্ত, অপর পাশের জন যেন বন্য ম্যাটাডোর...উচ্ছ্বাস প্রকাশে, স্টাইলে, স্বকীয়তায় দুইজন খুবই আলাদা। খেলার মাঠে মুখোমুখি হলেই আমাদের দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি। কী হয়, কী হয়। অথচ মাঠের বাইরে তাদের বন্ধুত্ব দেখেই আবার ভ্রম জাগে। সন্দেহ হয়, যারা মাঠে এদের নামে খেলতে এলো, তারা আসলেই এরা তো! নাকি, এদের চেহারায় অন্য কোনো মানুষ এরা! 

আমি বরাবরই 'ফেড এক্সপ্রেস' এর ভক্ত। এই আপাদমস্তক ভদ্রলোকটির ভক্ত হওয়ার জন্যে বিশেষ কোনো কসরত করতে হয় না। খেলা নিয়ে একাগ্রতা, খেলা নিয়ে তার অধ্যবসায় এবং ব্যক্তি হিসেবে তাঁর যে নিপাট ছিমছাম একটা প্রতিচ্ছবি, সেসব দেখেই আমি বরাবর এই 'সুইস মায়েস্ত্রো'তে মুগ্ধ। সে হিসেব করলে, আমার রাফায়েল নাদালকে অপছন্দ করার যথেষ্ট কারণ ছিলো। এই লোকটির কাছেই বহুবার হারের তিক্ত স্বাদ পেয়েছে রজার ফেদেরার।

মনে আছে, ২০০৬ সালকে ধরা হচ্ছিলো ফেদেরারের জীবনের অন্যতম সেরা সীজন। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, টেনিসেরই অন্যতম সেরা সীজন ছিলো এই বছর। সে বছরে ১৭টি টুর্নামেন্ট খেলেন ফেদেরার, যার মধ্যে ১৬টিরই ফাইনালে গিয়েছিলেন তিনি। চারটি গ্রান্ড স্ল্যামের মধ্যে তিনটিতেই জিতেছিলেন। জেতেননি একটিতে। সেই ক্লে কোর্টে। যে কোর্টের রাজা রাফায়েল নাদাল। ফেদেরার এত অসাধারণ এক সীজন কাটালেন, তিনটি গ্রান্ড স্ল্যামও জিতলেন, কিন্তু হেরে গেলেন রাফার কাছে। নিজের হিরো'র এই পরাজয়, রাইভালের উপর একটু মন খারাপ, একটু বিরক্ত হওয়া তো উচিতই। হলামও। কিন্তু এখন যখন নিরপেক্ষভাবে ভাবি, খেয়াল করি,  কী অমানুষিক ছিলো সেই ম্যাচ! কী প্রবল পরাক্রম দিয়েই না খেলেছেন দু'জন! খেলায় একজন জিতবে, একজন হারবে... এটাই তো নিয়তি। রাগ উবে গেলো সাথে সাথেই।

'লাল দূর্গের রাজা' রাফায়েল নাদালের সাথে এরপর রজার ফেদেরারের দেখা হয়েছে বহুবার৷ হেড টু হেড ব্যাটলে কখনো জিতেছেন ফেদেরার, কখনো নাদাল। তবে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, প্রত্যেকটা ম্যাচ হয়েছে দেখার মত। চোখে আটকে থাকার মত। রিভেঞ্জ, কামব্যাক, আবার রিভেঞ্জে তাদের গল্পগুলো বরাবরই 'মিসির আলী অমনিবাস।'

রাফায়েল নাদাল সম্প্রতি জিতলেন ক্লে কোর্টে তাঁর তেরোতম গ্রান্ড স্লাম। ভাবা যায়! এমনি এমনি তো আর 'রাজা' ডাকা হয় না তাকে। এখানে তিনি বরাবরই দাপুটে। রোঁলা গাঁরোর ফাইনালে জোকোভিচকে রীতিমতো উড়িয়ে দিয়ে তিনি ভাগ বসিয়েছেন ফেদেরারের রেকর্ডেও। দুজনেরই গ্রাণ্ড স্ল্যাম হয়ে গিয়েছে সমান ২০টি। ফরাসি ওপেনে টানা চতুর্থ শিরোপাও জেতা হয়েছে সে সাথে।

বিশটি গ্রাণ্ড স্ল্যাম জিতে রজার ফেদেরারের রেকর্ডে ভাগ বসিয়েছেন রাফায়েল নাদাল! 

এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আবার একত্রেই খেলেন লেভার কাপে। সে জিনিসটিও দারুণ উপভোগ্য এক বিষয়। দুই প্রতিদ্বন্দী একত্রে খেলছেন নিজেদের 'টীম ইউরোপ'কে চ্যাম্পিয়ন করার জন্যে। যেটা তারা করছেও প্রতি বছর। এই টীম বরাবরই অপ্রতিরোধ্য এক টীম! হবে নাও বা কেন, যে টীমে 'ফেদাল' খেলছেন, সে টীম যে কাঁপাবে, তা তো একরকম ধ্রুব সত্যিই। হচ্ছে সেটাই।

লেভার কাপে দুই বন্ধু! 

সবকিছুর একটি নির্দিষ্ট সময় আছে। নাদাল ও ফেদেরারের ক্যারিয়ারের বয়সও এখন বেলাশেষের দিকে। সে হিসেবে হয়তো আর দুই এক বছর খেলবেন তাঁরা। আমরা 'দর্শক' হিসেবে তাই এখন নাহয় মুগ্ধই থাকি তাদের ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভায়। খুঁতখুঁতে সমালোচনার বাক্স খুলে এখন তাদেরকে বিশ্লেষণ আর না করি বরং। যতটুকু সময় বাকি আছে, তাদের প্রতিভাতেই মজে থাকি। তাতেই তো আপাত সুখ নিহিত।

দিনশেষে আমরা খেলা তো দেখি নিজেদের মস্তিষ্ককে হালকা করার জন্যেই। অহেতুক তর্কে মস্তিষ্ককে নিরেট পাথর বানিয়ে লাভটাও বা কী?

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা