প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে একজন ভবঘুরের হাঁড়ির খবরও থাকে যাদের কাছে!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
প্রিয়াঙ্কা চোপড়া অভিনীত ‘কোয়ান্টিকো’ টিভি সিরিজের কথা জানেন প্রায় সবাই, সিরিজটি দেখেছেনও অনেকে। কিন্ত অনেকেই জানেন না এর নামকরণ সম্পর্কে। ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের কোয়ান্টিকো নামের শহরটি বিখ্যাত এফবিআই একাডেমীর অবস্থানের কারণে।
ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন- সংক্ষেপে এফবিআই, আমেরিকার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাটির শিক্ষানবীশ কর্মীদের একুশ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ হয় এখানে। উডল্যান্ড নামের এলাকায় প্রায় ৩৮৫ একর জায়গা জুড়ে অবস্থান এই একাডেমীর, এফবিআইয়ের প্রধান কম্পিউটার ল্যাবও এখানেই অবস্থিত।
১৯০৮ সালে ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা বিওআই নামে যাত্রা শুরু। ১৯৫৩ সালে নাম পরিবর্তন করে এফবিআই রাখা হয়। বিশ্বস্ততা, সাহস আর বিশুদ্ধতা- এই তিনটি নিয়েই যাদের কাজ। অপরাধ আর অপরাধীদের সমূলে উৎপাটন করাটাই যার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। প্রথমদিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে এফবিআইয়ের জন্ম হলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সিআইএ বা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সীর জন্ম হলে এফবিআইয়ের কার্যক্রম অনেকটাই আমেরিকাকেন্দ্রীক হয়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরিন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তদারক করার দিকেই মনোনিবেশ করে এফবিআই।
এই সংস্থার প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল ইলিগ্যাল প্রস্টিটিউশনের বিরুদ্ধে। জন এডগার হুভার ছিলেন এফবিআইয়ের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ডিরেক্টর। ১৯২৪ সালে তিনি সংস্থাটিতে যোগ দেন এবং ১৯৩৫ সালে ডিরেক্টর নির্বাচিত হন। এরপরে দীর্ঘ সাইত্রিশটি বছর এই পদ সামলেছেন তিনি, ১৯৭২ সালে তাঁর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে সমাপ্ত হয়ে এফবিআইয়ের হয়ে তাঁর ক্যারিয়ার। আমেরিকার ছয়জন আলাদা আলাদা প্রেসিডেন্টের অধীনে কাজ করেছেন হুভার, এদের মধ্যে আছেন রুজভেল্ট, হ্যারি ট্রুম্যান, জন এফ কেনেডি এবং রিচার্ড নিক্সনের মতো শাসকেরাও! তাঁর হাত ধরেই এফবিআইয়ের গবেষণাগার এফবিআই ল্যাবরেটরীর জন্ম হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের সময়টায় এফবিআই ছিল আমেরিকায় সন্ত্রাসীদের জন্যে মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। জন ডিলিঙ্গার, বেবি ফেস নেলসন, কেট মে বার্কার, আলভিন ক্রিপি কার্পিস, জর্জ মেশিনগান কেলির মতো অপরাধীরা হয় গ্রেফতার হয়েছিল, নইলে এনকাউন্টারে পড়ে জীবন দিয়েছিল এফবিআই এজেন্টদের হাতে। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা মাফিয়া দল কু ক্লাক্স ক্ল্যানের বিষদাঁত ভেঙে দিয়েছিল এফবিআই সেই সময়টাতেই।
চল্লিশ থেকে সত্তরের দশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছু স্যাবোটাজ হামলার প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দেয় এফবিআই, ধরা পড়ে বেশ কয়েক নাজী এস্পিওনাজ এজেন্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন এই সংস্থার এজেন্টরা, বিশেষ করে আমেরিকার আভ্যন্তরীন সুরক্ষায় তাঁদের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। জন এফ কেনেডি হত্যার ঘটনায় এফবিআইয়ের কার্যক্রম প্রশংসা পেয়েছিল, সেবারই নিয়ম করা হয়, স্টেট পুলিশের জন্যে চ্যালেঞ্জিং অপারেশন বা মামলাগুলোতে তদন্তের কাজে এফইবিআইকে ব্যবহার করা হবে।
১৯৭২ মিউনিখ অলিম্পিকে ইজরায়েলি অ্যাথলেটদের ওপর হামলা করেছিল জঙ্গীরা, তেমন কোন ঘটনা যাতে লস অ্যাঞ্জেলসের ১৯৮৪ অলিম্পিকে না ঘটে, সেজন্যে নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এফবিআইকে। সেবার সোয়াতকে (SWAT) ব্যবহার করেছিল সংস্থাটি।
১৯৮০-৯০ এর মধ্যে প্রায় তিনশো এজেন্টকে বরখাস্ত করে এফবিআই, দেশের বাইরে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে। গত শতকের শেষ দশকে এসে কাজের পরিধি অনেক বেড়ে যায় সংস্থাটির। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এবং ওকলাহোমা সিটিতে বোমা হামলার ঘটনা সামাল দেয়ার ভার পড়ে এফবিআইয়ের ওপরে। ২০০১-এ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বিমান হামলার পর আটঘাট বেঁধে টেরোরিস্টদের দমনে নামে এফবিআই, এগারোই সেপ্টেম্বরে উদ্ধার কাজ চালাতে গিয়ে নিহত হয়েছিলেন সংস্থাটির এজেন্ট লিওনার্ড উইলিয়াম হাটন। জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যুতে প্রশ্ন ওঠে এফবিআইয়ের সামর্থ্য নিয়ে, খোলনলচে পাল্টে ফেলা হয় সংস্থার।
এর মধ্যে ২০০১ সালে এফবিআইয়ের সাবেক এজেন্ট রবার্ট ফিলিপ হ্যানসেন গ্রেফতার হন রাশিয়ার হয়ে স্পাইগিরি করার অভিযোগে। এফবিআইয়ের বিভাগীয় তদন্তে বেরিয়ে আসে, ১৯৭৯ সাল থেকেই রাশিয়ার গোয়েন্দাদের তথ্য বিক্রি করে আসছিলেন হ্যানসেন। এমনকি নাইন-ইলেভেনের অ্যাটাকের পেছনেও হ্যানসেনের ভূমিকা থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। পরের বছর তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি দেয় ফেডারেল কোর্ট।
তবে এফবিআই সমালোচনার শিকার হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে স্টিং অপারেশন চালিয়ে। এখানে টেরোরিস্ট বা অপরাধী সেজে অপরাধীদের ফাঁদে ফেলতেন এজেন্টরা, এমনকি নকল গোলাবারুদও সরবরাহ করা হতো হামলার জন্যে। ২০১২ সালে আমিনি আল খালিফি নামে মরক্কোর এক মুসলিম যুবককে এফবিআই নকল আত্মঘাতী বিস্ফোরকসহ জামা (সুইসাইড ভেস্ট) ও অকেজো আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করেছিল। পরিকল্পনা ছিল, ওই জামা পরে খালিফি নির্বিচারে গুলি চালিয়ে লোকজনকে হত্যা করবেন।
২০০৯ সালে নিউইয়র্কের রিভারডেল এলাকায় দুটি সিনাগগ (ইহুদি উপাসনালয়) বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করার দায়ে চারজন কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমান যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের হামলার পরিকল্পনায় সহযোগিতা করা, অর্থ ও নকল বিস্ফোরক জোগান দিয়েছিল এফবিআই। ২১ বছর বয়সী বাংলাদেশি তরুণ কাজী রেজওয়ানুল আহসান নাফিস নিউইয়র্ক শহরে ফেডারেল রিজার্ভ ভবন বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার দায়ে ‘হাতেনাতে’ গ্রেপ্তার হয়েছিল। সেটাও ছিল এফবিআইয়ের স্টিং অপারেশনের অংশ।
এফবিআইয়ের কর্মপদ্ধতিটা অনেক বেশী গোছানো, ছয়টি বিভাগে ভাগ করা আছে সংস্থাটিকে। এক দল সাইবার ক্রাইমের দিকটা দেখছেন, কেউ টেকনোলজির অংশটা সামলাচ্ছেন, ন্যাশনাল সিকিউরিটি এবং ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ আলাদা, আছে হিউম্যান রিসোর্স ব্রাঞ্চও। আর সব কিছু তদারকি করেন ডিরেক্টর, তিনি সরাসরি মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে জবাবদিহি করেন। শিক্ষানবীশ এজেন্ট হিসেবে ফিল্ড এজেন্টদের কর্মজীবন শুরু হয়, যারা সরাসরি অপারেশনে অংশ নেয় তাদের চীফ হচ্ছেন স্পেশাল এজেন্ট ইনচার্জ পদমর্যাদার এক বা একাধিক অফিসার। এর ওপর থেকে ম্যানেজমেন্ট পদাবলীর শুরু, ডেপুটি অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর থেকে শুরু করে আটটি ধাপ পেরিয়ে মেধা আর যোগ্যতার চূড়ান্ত স্বাক্ষর রেখে কেউ ডিরেক্টর পদে আসীন হতে পারেন। তবে এফবিআইয়ের ডিরেক্টর বেশীরভাগ সময়ে প্রেসিডেন্টের আস্থাভাজনেরাই হয়ে থাকেন।
২০১০ সালে এফবিআইয়ের বাজেট ছিল ৭.৯ বিলিয়ন ডলার যার মধ্যে ৬১৮ মিলিয়ন ডলার খরচ করা হয় সন্ত্রাসবাদ দমন, সাইবার ক্রাইমের বিরুদ্ধে কার্যক্রম, প্রশিক্ষন কর্মসূচি ইত্যাদি কার্যক্রমে। বলা হয়, মার্কিন মুল্লুকের সবচেয়ে গোয়েন্দা সংস্থাটির কাছে দেশের প্রেসিডেন্ট থেকে একজন ভবঘুরেরও হাঁড়ির খবর থাকে। সেটা কতটা সত্যি কে জানে, তবে আমেরিকা দেশটার নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এফবিআইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম, সেটা বলাই যায়।