ফজলুর রহমান বাবু: যার অভিনয় মুগ্ধতা ছড়ায়, চোখে জল আনে
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
২০১৬ সাল, অনেকটাই অগোচরে মুক্তি পেল তৌকীর আহমেদের 'অজ্ঞাতনামা'। গুটিকয়েক দর্শকই সিনেমা হলে গিয়েছিলেন দেখার জন্য, ফিরে এসে সবাই বেশ প্রশংসাই করেছিল। তবে এই সিনেমায় একজন সদ্য সন্তান হারা পিতার চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতার অসাধারণ অভিনয়েরই বেশি প্রশংসা হয়েছিল।
কয়েক মাস না যেতেই ছবিটা যখন ইউটিউবে এলো, তখন সিনেপ্রেমীদের মাঝে এই ছবি নিমিষেই যেন ছড়িয়ে গেল। সিনেমার যেমন প্রশংসা তার চেয়ে বেশি প্রশংসায় পঞ্চমুখ ঐ অভিনেতার জন্য। এই অভিনেতা সবার চেনা, এর আগেও বহুবার তিনি অভিনয়ে জাত চিনিয়েছেন, জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। তবে 'অজ্ঞাতনামা'য় উনার অসামান্য অভিনয় যেন সব ছাড়িয়ে গেল, অভিনয়ে দারুণ প্রত্যাবর্তন ঘটলো। মুহুর্তে পাল্টে যায় প্রেক্ষাপট, অনেক নতুন দর্শক তার ভক্ত বনে গেল।
তিনি আর কেউ নন, এই সময়ের অভিনয়ের ধারক বাহক বুঝালে যাদের নাম নির্দ্ধিয়ায় সর্বাগ্রে চলে আসে তিনি তাদেরই একজন, সবার প্রিয় 'ফজলুর রহমান বাবু'।
শৈশব থেকেই থিয়েটারের সঙ্গে পরিচয়। মাঝে জীবনের তাগিদেই যোগ দিয়েছিলেন অগ্রণী ব্যাংকে, ঢাকায় এসে যোগ দেন আরণ্যক নাট্যদলে। এক সময় অভিনয়ের টানেই ব্যাংকের চাকরি ছাড়ার কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে তিনি তখন ভুল করেননি, যার প্রমাণ আজকের দিনে এসে উনার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা।
নব্বইয়ের শুরুতে মামুনুর রশীদের 'ইতিকথা' ধারাবাহিকে পরাণ মাঝির চরিত্রে অভিনয় করে সমাদৃত হন, কাজ করেন 'সুন্দরী' নাটকেও। তবে টিভি নাটকে উনার অভিনয় ক্ষমতা দেখানোর বিস্তর সুযোগ মিলে শূন্য দশক থেকে, যখন টিভি নাটকে এক বিশাল পরিবর্তন আসে। সেই সময়ে 'আদু ভাই' নাটক করে বেশ আলোচিত হয়েছিলেন, তৎকালীন অনেক দর্শকই তাকে এই নামে চিনতেন।
আজকের ফজলুর রহমান বাবুর হওয়ার নেপথ্যে নিজের একাগ্রতার পাশাপাশি যেই কয়েকজন নির্মাতা অনেকখানি সহায়ক ছিলেন, তাদের মধ্যে গিয়াসউদ্দিন সেলিম অন্যতম। তার পাপপুন্য, ভয়, হাউজওয়াইফ, এনেছি সূর্যের হাসি, সংশয় সহ প্রায় সব নাটকে বিশেষ চরিত্র দিয়েছিলেন ফজলুর রহমান বাবুকে। এক সময় তো যুগান্তকারী 'মনপুরা'র সুবাদে ব্যাপক পরিচিতি পান ফজলুর রহমান বাবু, অভিনয়ের পাশাপাশি উনাকে পাওয়া গিয়েছিল গায়কের ভূমিকায়ও। মনপুরা সিনেমার গান 'নিথুয়া পাথারে' ছিল তখনকার সব শ্রোতাদের মুখে মুখে।
টিভি নাটকে অভিনয়ের আরও প্রতিভা দেখিয়েছেন যেসব নাটকে, তার মধ্যে অন্যতম 'দৈনিক তোলপাড়', দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি। তখনকার টিভির নিয়মিত অভিনেতাদের ছাপিয়ে দর্শকদের পছন্দে সেরার তালিকায় ছিলেন। হাঁটকুরা, ৫১বর্তী, নুরুল হুদা একদা ভালোবেসেছিল, বোধ, ভগবানকে ডাকি, দ্য পোস্টম্যান, পাঞ্জাবীওয়ালা, মায়া, কমলা সুন্দরী- অনেক নাটকেই। বছর তিনেক আগে 'বিকেল বেলার পাখি'তে অভিনয়ে দর্শকদের অশ্রুসজল করেছিলেন।
প্রথম সিনেমা 'বিহঙ্গ', দ্বিতীয় সিনেমা আবু সাইয়িদের 'শঙ্খনাদ' এ দারুণ অভিনয়ে সবাইকে বিমোহিত করেছিলেন। ২০০৭ সালেই মুক্তি পায় মোট চারটি ছবি, প্রতিটাতেই ছিল গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। মেড ইন বাংলাদেশ, স্বপ্নডানায়, দারুচিনি দ্বীপ, আহা! তে অভিনয়ের গুণে দর্শকদের প্রশংসা আদায় করে নিয়েছিলেন। এরপর এলো 'মনপুরা', মাঝে বিরতি দিয়ে ফিরলেন 'অজ্ঞাতনামা' দিয়ে, এর সুবাদে আবারো দর্শকালোচিত। এরপর যেই সিনেমাই করেছেন, তার জন্য দর্শকদের বিশেষ আগ্রহ ছিল। 'স্বপ্নজাল' সিনেমায় দারুণভাবে কমেডি খলের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন, যেটা উনার ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে দেখা যেত। তালিকায় আরও আছে না বলো না, গহীন বালুচর, মেয়েটি এখন কোথায় যাবে, নুরুউদ্দিন ও তার বিউটি ড্রাইভার, দহন, পোড়ামন ২ ছবিগুলো।
'অল্প না বয়সে উঠে না ছেরি', এই গানের জনপ্রিয়তা সবাই জানে, ইন্দুবালা গানটিও জনপ্রিয়। মনপুরার আরেক গান 'কেও রইলো বরই পাতা' থেকে ঘেটুপুত্র কমলার 'সুয়া উড়িল, আমার যমুনার জল দেখতে কালো, জলে বাসা সাবান' গানে কণ্ঠে তিনি প্রমাণ করেছিলেন অভিনয়ের মতো গানেও তিনি সমান প্রতিভাবান। বিজ্ঞাপনেও ছিলেন স্বপ্রতিভ। ঢেউটিন, প্যারাসুটের বিজ্ঞাপনের পর অলিম্পিক বিস্কুটের 'বাবা হও, তখন বুঝবা' এই সংলাপে সবার মন কাঁদিয়েছিলেন।
২০০১ সালে মেরিল প্রথম আলো পুরস্কারে সতীর্থ শহীদুজ্জামান সেলিম পুরস্কার নিতে গিয়ে বলেছিলেন, 'পুরস্কারটি বাবু পেলে আরো খুশি হতাম'। সতীর্থের মুখে এই কথাও এক ধরনের পুরস্কার। পাপপুন্য দিয়ে না পেলেও পরবর্তীতে ভয় ও পাঞ্জাবীওয়ালার জন্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান 'শঙ্খনাদ' সিনেমার জন্য, এরপর আরও দুইবার পেলেও অজ্ঞাতনামা, স্বপ্নজাল, আহা!র মতো ছবি করেও স্বীকৃতি আসেনি।
সম্প্রতি 'এক্সট্রা আর্টিস্ট' নামক টেলিফিল্মে আবার তিনি আলোচিত হয়েছে। তবে ইদানীং দর্শকদের মধ্যে অভিযোগ, তিনি শুধুই দুঃখ-দুর্দশায় নিপীড়িত মানুষের চরিত্র তুলে ধরেন। এই কথা অনেকখানি সত্য, অনেক বছর আগেও তিনি নিজেও মজার ছলে এই কথা বলেছিলেন। তবে যারা অনেক আগে থেকেই উনার অভিনয় দেখে আসছেন, তারা বলতে পারবেন কৌতুকপূর্ণ খল চরিত্র তিনি কতটা ভালো করতে পারেন। কিন্তু এইদেশের নির্মাতারা উনাকে সেই ধরনের চরিত্র দিচ্ছেন না, তাই উনাকে সেইরকমভাবে দেখাও যাচ্ছে না। তবে পেলেই যে নিজেকে সঁপে দেন সেটার প্রমাণ 'স্বপ্নজাল' এই পাওয়া যায়।
১৯৬০ সালের আজকের এই দিনে জন্মগ্রহণ করা এই স্বনামধন্য অভিনেতা আজ পেরোচ্ছেন জীবনের ৬০ বছর, শুভকামনা রইলো। শুভ জন্মদিন, ফজলুর রহমান বাবু।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন