
আজ শুধু বাংলাদেশেই না, সারা বিশ্বেই আমার বাবার মতো কতশত মানুষ এইভাবেই নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছেন মানব সেবার লক্ষ্যে। তাদের জন্য আমরা কী করছি আসলে?
রাজিউল হোদা দীপ্ত: আমার বাবা ডা. মোঃ দুররুল হোদা একজন শিশু ও ডায়াবেটিক বিশেষজ্ঞ। উনি বিএমএ চাঁপাইনবাঞ্জের সভাপতি, এবং একইসাথে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ডায়াবেটিক হসপিটালের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।
আমাদের পুরো পরিবারের কাছে গর্বের বিষয় হচ্ছে চারপাশের ভীতিকর পরিবেশ দেখে আমরা যখন ভয়ের মধ্যে দিন পার করছি, অনেক জায়গায় অনেক চিকিৎসকের চেম্বার বন্ধ করে দেয়ার খবর যখন পাচ্ছি, আবার যখন চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে কত প্রতিভাবান ডাক্তারের প্রাণ হারানোর খবর শুনে যখন আমরা আফসোস করছি, তখন আমার বাবা প্রত্যেকটা দিন সব ভয়, বিপত্তি উপেক্ষা করে মানুষকে চিকিৎসা প্রদানের লক্ষ্যে সকালবেলা উঠে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ছেন। নির্দ্বিধায় হাসপাতালে অথবা তার চেম্বার কিংবা ফোনের মাধ্যমে সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন।
প্রতিদিন তার একই রুটিন। অনেক সকালে বেরিয়ে পরেন, প্রায় দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেল, তখন তিনি বাসায় ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু ঘুমান, তারপর এক ঘন্টার মাথায় উঠে চেম্বারে বসেন, রাত ১০টায় সেখান থেকে তার গ্রামের চেম্বারে যান, ফিরে আসেন রাত প্রায় সাড়ে বারোটার পর। দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে আমার বাবার একই রুটিন, একই লাইফস্টাইল দেখে আসছি।

এখন শুধু একটাই পার্থক্য। বাবা প্রতিদিন বাসা থেকে বের হবার সময় গায়ে একটা পিপিই জড়িয়ে নেন। হয়ত এই ভেবে যে, প্রাণঘাতি ভাইরাসের বিরুদ্ধে এই পিপিই খানিকটা হলেও ঢালের কাজ করবে। এই পিপিই’র বদৌলতেই হয়তো তিনি আরো একটা দিন সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে আসতে পারবেন।
আপনি ভাবতে পারেন, একজন মানুষ, যিনি অনেকটাই নিশ্চিত যে যেকোনো সময় তার যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে! জীবনের অস্তিত্ব নিয়ে যেখানে প্রশ্ন সেখানে এইসব জেনেও তিনি সম্মুখ সমরে ছুটে যাচ্ছেন, মানুষকে সেবা দেবেন বলে। কতটা নিষ্ঠা আর একাগ্রতা থাকলে কেউ নিজেকে এইভাবে বিলিয়ে দিতে পারেন। আজ শুধু বাংলাদেশেই না, সারা বিশ্বেই আমার বাবার মতো কতশত মানুষ এইভাবেই নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছেন মানব সেবার লক্ষ্যে। তাদের জন্য আমরা কী করছি আসলে?
শুরুর দিকে পিপিই’র সংকট দেখা দিয়েছিলো। আপনি এর জন্যে কাউকে দোষারোপ করতে পারেন না, কারণ পুরো পৃথিবী জুড়েই এই সংকটটা আছে, ছিল। তবুও, বাংলাদেশের মতোই সকল দেশের প্রশাসন এই ঘাটতির সামাল দিতে চেষ্টা করেছেন এবং করছেন। আমার বাবা বরাদ্দকৃত পিপিই’র জন্য অপেক্ষা করেননি। উনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ ডায়াবেটিক হাসপাতাল এবং গৌড় ক্লিনিক, তার এই দুই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সকল চিকিৎসক, সেবাকর্মী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ের প্রটেকশন ইকুইপমেন্টের ব্যবস্থা করেছেন।
বাবাকে যখনই করোনা নিয়ে আমাদের ভীতির কথা জানাই, তার কথাবার্তা আর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় যেন কিছুই হয়নি। উনি বলেন, প্রতিদিন কতশত শিশুর চিকিৎসা করছেন। বেশীরভাগ শিশুরই এখন ঠান্ডা-জ্বর দেখা দিচ্ছে। আমাদের পরিচিত কারো যখন শুনছি ঠান্ডা বা জ্বর, আমরা আঁতকে উঠছি এই ভেবে যে, কে জানে করোনা হলো কিনা! আমার বাবা সেখানে নিজ হাতে বাচ্চাগুলোকে কোলে তুলে নিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছেন। হয়তো, বাবার মনেও করোনা নিয়ে চাপা দুর্ভাবনা কাজ করে। কিন্তু আমাদের সামনে, পুরো দুনিয়ার সামনে তিনি তা দেখাতে চান না।
আমাদের সব ডাক্তারেরা যদি তাদের উৎকন্ঠার কথা জানাতে থাকেন, যদি তাদের চিন্তায় ভাঁজ পড়া কপাল আমরা দেখি, তাহলে আমরা সাহস পাবো কার কাছ থেকে? সেজন্যই হয়তো...

একজন ডাক্তারের কাজ কি শুধুই চিকিৎসা সেবা প্রদান করা? নাকি যেহেতু তারা সমাজে একটি বিশেষ অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত হন, তাই সমাজের প্রতি তাদের বাড়তি কিছু দায়িত্ব থাকে? আমার মনে হয়, থাকে। অন্তত আমার বাবা আমাকে তেমনটাই শিখিয়েছেন। আমাদের চারপাশে দিন আনে দিন খায় এমন মানুষেরা খুব সংকটে দিন কাটাচ্ছেন। আমরা গত কয়েক মাস ধরে দেখে আসছি আমার বাবা এবং মা দুজনেই কতটা আন্তরিকভাবে এগিয়ে এসেছেন। কতজন মানুষকে কী পরিমান অর্থে তারা সাহায্য করেছেন সেসব সংখ্যার হিসেবে আমি যাচ্ছি না। আমি শুধু শিখছি প্রতিনিয়ত, গর্বে টানটান হচ্ছে আমার বুক। তারা আমার বাবা-মা, সেই গর্বের কারণ।
এই কথাগুলো আমি বড়াই করার জন্য কিংবা বাহবা পাবার জন্য আপনাদের জানাচ্ছি না। আমি শুধু এইটাই বোঝাতে চাচ্ছি যে, অনুপ্রেরণা পাবার জন্য আমরা কত দিকে যে ছুটে বেড়াই, আমরা কত হাহুতাশ করি, কত অভিযোগ আমাদের। অথচ আমাদের বাবারা কিংবা মায়েরা আমাদের সামনেই কোনো রকম অভিযোগ বা স্বার্থ ছাড়াই কতরকমভাবে তাদের কাজের মাধ্যমে আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন।
এমন মহামারীর দিনে, এই দুঃসময়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যবৃন্দ, সাংবাদিকগণ, সেবা কর্মীরা এবং সর্বোপরি আমাদের চিকিৎসকরাই সত্যিকারের সুপারহিরো আজ। আমরা গর্বিত আমাদের ঘরে, আমার পরিবারে এমনই একজন সুপারহিরো আছেন। আমি আমার বাবার কথা বলছি, আমি একজন সুপারহিরোর কথা বলছি।
বাবা দিবসে পৃথিবীর সকল বাবাদের শ্রদ্ধা।