কেউ বলে তিনি সিরিয়াল কিসার, কেউবা তাকে ডাকেন 'চুম্বন দেবতা' নামে! অথচ ফিল্মি দুনিয়ার বাইরে বাস্তব জীবনেও তিনি এমন একজন সুপার ড্যাড, যিনি নিজের ছেলেকে বাঁচাতে লড়াই করেছিলেন ক্যান্সারের সঙ্গে, হারিয়ে দিয়েছিলেন এই মরণব্যাধিটিকে!

তিনি কখনও ফিল্মস্টার হতে চাননি, ফিল্মি দুনিয়াতেও আসার ইচ্ছে ছিল না। অথচ পরিবারে কিন্ত ফিল্মি আবহটা খুব ভালোভাবেই ছিল। মামারা বলিউডের বিখ্যাত পরিচালক, মুম্বাইয়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের অন্যরকম একটা সম্মান আছে। কিন্ত ওই কাজটা তাকে আকর্ষণ করেনি সেভাবে। তবে অভিনয়টা তিনি করতেন।

স্কুলের মার্কশিট দিলে তার অভিনয়প্রতিভা দেখানো শুরু হতো, কলেজ পালিয়ে ধরা পড়লে বাসায় তিনি দেখাতে শুরু করতেন তার অভিনয়ের জাদু! অভিনয়ের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই হুট করে একদিন মামাদের হাত ধরে রঙিন এই দুনিয়াটায় ঢুকে গেলে তিনি। বয়সে তরুণ, রক্ত গরম, চরিত্রে অস্থিরতা, হাবেভাবে বিশ্বজয় করে ফেলার বাসনা।

বন্ধুদের সাথে ছোটখাট একটা ব্যবসা করছিলেন, পাশাপাশি আর কিছু টাকাপয়সা আয় করা যায় কিনা, সেটা দেখতেই মামাদের সঙ্গে কাজ করার ভাবনাটা মাথায় এলো। শুরুতে মামাদের সিনেমাতেই অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করতেন। কাজের চেয়ে অকাজটাই বেশি হতো। নবাবের মতো আরাম করতেন সিনেমার সেটে এসে, নিজের ভাগের কাজটুকু করিয়ে নিতেন কাজিন মোহিত সুরিকে দিয়ে। 

ভাগ্নেকে লাইনে আনার একটা রাস্তা খুঁজছিলেন মহেশ ভাট। দায়িত্ববোধ জিনিসটা ওর মধ্যে কীভাবে আনা যায়, সেটা ভাবতে ভাবতেই মাথায় একটা প্ল্যান এলো, বিক্রম ভাটকে বললেন, তার পরের সিনেমায় ছেলেটাকে নায়ক হিসেবে নিতে। সেই ছেলেটা যখন বিক্রম ভাটের কাছ থেকে ‘ফুটপাত’ সিনেমায় নায়কের রোলে অভিনয় করার প্রস্তাব পেলেন, তখন আগাপাশতলা চিন্তা না করে রাজী হয়ে গেলেন। কল্পনাও করতে পারেননি, পেছন থেকে তাকে সোজা করার জন্যে কলকাঠি নাড়ছেন তার মামা। 

প্রথম দিন সিনেমার সেটে এসেই বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো ছেলেটা। এতদিন ভেবে এসেছিল, সিনেমায় হিরোদের কাজ বুঝি সবচেয়ে সোজা হয়। মুখে মেকাপ মাখো, ভ্যানে গিয়ে আরাম করো, ডিরেক্টর ডাকলে এসে দুটো ডায়লগ ছাড়ো, একে ঘুষি দাও, তাকে লাথি মারো, নায়িকার সাথে জমিয়ে রোমান্স করো- এর বাইরেও যে সিনেমার হিরোদের কাজ থাকতে পারে, বা ওদের কাজটা করা যে কতটা কঠিন, সেটা তাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেয়ার মিশনে নেমেছিলেন বিক্রম ভাট।

মার্ডার সিনেমার দৃশ্যে

সারাদিন গায়ে কালিঝুলি মেখে বসে রইলো ছেলেটা, শেষ বিকেলে ডাক এলো শুটিঙের। ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতেই মাথাটা কেমন যেন খালি হয়ে গেল তার। এতক্ষণ ধরে মুখস্ত করা স্ক্রীপ্টের একটা শব্দও মুখে এলো না, হা করে বোকার মতো চেয়ে রইলো ক্যামেরার দিকে। কয়েকটা রিটেক শটের পরেও কাজটা মনমতো না হওয়ায় পরিচালক বিরক্ত হয়ে সেদিনের শুটিংই প্যাকআপ করে দিলেন! এতদিন সিনেমার নায়কদের অভিনয় নিয়ে হাসাহাসি করা ছেলেটা হুট করেই বুঝতে পারলো, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয় করাটা মোটেও সহজ কিছু নয়।

‘ফুটপাত’ মুক্তি পেলো, সিলভার স্ক্রীনে নিজেকে দেখে অন্যরকম একটা ভালোলাগা কাজ করলো ছেলেটার। মাল্টিপ্লেক্সের সামনে দর্শকেরা তাকে চিনতে পেরে ঘিরে ধরে, সিকিউরিটির সাহায্য নিয়ে তার গাড়ি বের হয়ে আসে ভীড় থেকে। এই ভীড়টা কিন্ত তার একটুও মন্দ লাগে না। সিনেমা ফ্লপ, কিন্ত অল্প কিছু হলেও দর্শক তার কথা জেনেছে, তার কাজটা পছন্দ করেছে, তাকে ভালোবেসেছে- এই ব্যপারগুলো তার কাছে বিশাল বলে মনে হয়।

আরেক নতুন ডিরেক্টর অনুরাগ বসু একটা সিনেমা বানাবেন। রাফ এন্ড টাফ লুকের একটা হিরো চাই তার। তিনি যোগাযোগ করলেন ফুটপাতে গ্যাংস্টারের রোলে অভিনয় করা সেই ছেলেটার সাথে। সিনেমার নায়িকা মল্লিকা শেরাওয়াত, বেশ খোলামেলা বলে খানিকটা দুর্নাম আছে তার। অনুরাগের প্রথম সিনেমাটা ফ্লপ, মল্লিকার ক্যারিয়ারে তখনও পর্যন্ত কোন হিট মুভি নেই, আর এই ছেলেটার প্রথম ফিল্মটাও বক্স অফিসে চলেনি। তিনজন ব্যর্থ মানুষ একসঙ্গে যাত্রা শুরু করলেন, ইরোটিক সেই থ্রিলারের নাম ‘মার্ডার’! ওই এক সিনেমাই ভারতীয় সিনেমা জগতের, বা বলিউডের সিনেমার প্যাটার্নটাকেই খানিকটা বদলে দিলো, কিংবা বলা যায় বড়সড় একটা ধাক্কা দিলো।

এতক্ষণ যে তরুণের কথা বলা হলো, তার নাম যে ইমরান হাশমি, সেটা বলে না দিলেও চলছে। ইমরান হাশমি নামটা আমাদের কাছে বিশেষ কিছু। আমরা যারা ‘নাইন্টি’জ কিডস’, তাদের কাছে তো অবশ্যই। স্কুলে পড়ার দিনগুলোতে এই ভদ্রলোক ছিলেন আমাদের কাছে কিংবদন্তী। তার সিনেমা মানেই চুম্বন দৃশ্য থাকবে, দারুণ গান থাকবে, গানের মধ্যে আবার খানিকটা রগরগে দৃশ্যও পাওয়া যাবে- সেই ২০০৫-০৬-০৭ সালের দিকে এটা আমাদের কাছে বিশাল কিছু।

ছেলে আয়ানের সঙ্গে ইমরান হাশমি

ভিডিওর দোকান থেকে পাঁচ/দশ টাকা দিয়ে সিডি ভাড়া করে আনা, বাসায় কেউ না থাকার সময়টায় লুকিয়ে দেখা, বিশেষ দৃশ্যগুলো বারবার টেনে টেনে দেখার সেই উত্তেজনা বা রোমাঞ্চটার সাথে আর কোনকিছুর তুলনা হয় না। আকসার, আশিক বানায়া আপনে বা মার্ডারের ভিগি হোঠ তেরে- এই গানগুলো তো আমাদের কাছে বড্ড আপন ছিল। এমপিফোর প্লেয়ারের এক গিগাবাইট মেমোরিতে লোড করে ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসে কয়েকটা গানই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখা হতো শুধু। ইউটিউবের বোধহয় জন্মও হয়নি তখন, একে ওকে ধরে নতুন গানগুলো সংগ্রহ করাটা একটা বাতিক হয়ে উঠেছিল। আর ইমরান হাশমির সিনেমার গান তো শুধু শোনার বস্তু ছিল না, দেখার বস্তুও ছিল! 

মার্ডারের পরে চুটিয়ে সিনেমা করছিলেন, ফ্লপ-হিট দুটোই আসছিল। দারুণ কিছু কাজও হচ্ছিল। গ্যাংস্টার, কালযুগ, কিলার- প্রশংসা পাচ্ছিলেন ফিল্ম ক্রিটিকদের কাছেও। কিন্ত তার সিনেমার একটা চেনা ফর্মূলা ছিল। ভাট ফিল্মসের ছবি, চুমু কিংবা রগরগে দৃশ্য আর ইমরান হাশমি, সঙ্গে তার রাফ এন্ড টাফ লুক- প্রতিটা সিনেমায় এই কয়টা জিনিস উপস্থিত থাকতো নিয়মিত। মার্ডারের পরে একটা অন্যরকম ইমেজ দাঁড়িয়ে গেল তার, পরিচালকেরাও বারবার একই রকমের রোলে, একই কাজটাই করাতে চেয়েছেন তাকে দিয়ে, তিনিও নিজেকে ভাঙতে চাওয়ার ব্যপারে খানিকটা উদাসীন ছিলেন এই সময়টাতে।

সিরিয়াল কিসারের তকমা জুড়ে গিয়েছিল নামের পাশে। বক্স অফিসে হিট-ফ্লপ সবই ছিল, কিন্ত অভিজাত পরিচালকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের মতো কিছু করতে পারেননি তিনি তখনও। করার চেষ্টাটাও খুব বেশি দেখা যায়নি। সিঙ্গেল স্ক্রিনে সফলতা আসছিল, কিন্ত মাল্টিপ্লেক্স কালচারের বলিউডে তার অবস্থানটা একদমই নাজুক তখন। বলিউডে তখন ‘বোল্ড সিনেমা’র পোস্টারবয় তিনি।

মোহিত সুরি’র আওয়ারাপান দিয়ে নিজের ইমেজটা প্রথমবারের মতো ভাঙার একটা চেষ্টা করলেন তিনি, আর সেই চেষ্টায় দারুণভাবে সফল ইমরান। বলিউডে তখন রোমান্স মানেই শাহরুখ খান। ইমরান দেখালেন অন্যরকমের একটা রোমান্টিসিজম, একদম নিজের মতো করে। সিনেমার গল্পটা সুন্দর, গানগুলো দুর্দান্ত, আর দারুণ তার অভিনয়। এই এক সিনেমা দিয়ে মানুষের মনে জায়গা করে নিলেন, বোঝালেন, তাকে দিয়ে সবকিছুই সম্ভব।

তবুও আরও কিছু প্রমাণের তাগিদ ছিল তার। ‘ভাট’ ক্যাম্পের বাইরে বেরিয়েও নিয়মিত সফলতা অর্জন করতে পারেন তিনি, সেটা দেখানোর দরকার ছিল। ‘জান্নাত’ দিয়ে সেই চ্যালেঞ্জটা নিলেন তিনি, জিতেও এলেন। ম্যাচ ফিক্সিঙের পটভূমিতে নির্মিত রোমান্টিক সিনেমাটায় কী দারুণ সাবলীল তার অভিনয়। ইমরান হাশমি তখন হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা, তিনি যা’ই করেন, তাতেই তরুণেরা মুগ্ধ হয়। এই সিনেমার ‘জারা সা’ গানটা যে পরিমাণ ক্রেজ তৈরি করেছিল সেই সময়ে, সেটার সাথে হয়তো কোনকিছুরই তুলনা হয় না।

কত তরুণ যে ঠিক ইমরান হাশমির মতো করেই তার ভালোবাসার মানুষটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে চেয়েছে, তাদের সংখ্যা অগুনিত! এরপরের জার্নিটা ভালো-মন্দের মিশেলে গড়া। রাজ-২, জান্নাত-২, মার্ডার-২, ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন মুম্বাই, ডার্টি পিকচার, দিল তো বাচ্চা হ্যায় জি, রাজা নটবরলাল, আজহার কিংবা বাদশাহো- ভিন্নধর্মী চরিত্রে অভিনয় করার চ্যালেঞ্জটা বরাবরই নিয়েছেন তিনি।

অভিনয়কে কখনও সিরিয়াসলি নিতে না চাওয়া ইমরান বলিউডে পার করে দিয়েছেন পনেরো বছর। তার সিনেমা সিলেকশন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, উঠবেও। দুটো ভালো সিনেমা করেন, তারপর ভাটদের সঙ্গে ভূত-প্রেতের ছবিতে নাম লেখান। এজন্যেই তার ক্যারিয়ারে বাজে সিনেমার সংখ্যাও কম নয়। ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন মুম্বাই, জান্নাত-২ বা ডার্টি পিকচারে তার দুর্দান্ত অভিনয় দেখে দর্শক-সমালোচক যখন মুগ্ধ, তখন তিনিই আবার নাম লেখাচ্ছেন মিস্টার এক্স বা রাজ রিবুটের মতো সিনেমায়। ব্যপারটা তার ভক্তদের জন্যে বেশ পীড়াদায়ক। 

তবে ফিল্মি দুনিয়ায় নয়, ইমরান হাশমি তার জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধটা করেছিলেন বাস্তবে।

ছেলের সাথে ইমরান হাশমি

ইমরান-পারভীন দম্পতির একমাত্র ছেলে আয়ান মাত্র চার বছর বয়সেই আক্রান্ত হয়েছিল ক্যান্সারে। যে ইমরান একসময় উড়নচণ্ডি ছিলেন, জীবন নিয়ে যার কোন ভাবনাই ছিল না, মেডিকেল রিপোর্ট হাতে পাবার পরে সেই উদাসীন ইমরানের পুরো দুনিয়াটা টলে গেল এক মূহুর্তে। ছেলেকে সারিয়ে তোলার সংগ্রামে লিপ হয়েছিলেন তিনি, যেভাবেই হোক, বুকের মানিককে ফিরিয়ে আনতে হবে যমদূতের নাগাল থেকে।

তার ছেলে আয়ান ওষুধ খেতে চাইতো না একদম, শুটিং থেকে বাড়ি ফিরে ব্যাটম্যানের কস্টিউম পরতেন ইমরান, ছেলের প্রিয় সুপারহিরো ব্যাটম্যান, তাকে দেখলে সে খুশী হয়। এভাবেই ব্যাটম্যান সেজে আয়ানকে খাওয়াতেন তিনি। ধৈর্য্য ধরে পড়ে ছিলেন ছেলের সঙ্গে, ক্যান্সারকে হারিয়েই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাবা-ছেলে। পিতৃত্বের ভালোবাসার কাছে পরাজিত হয়েছে মরণঘাতি ব্যাধি। 

মোহিত সুরি তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের একজন, মোহিতের সঙ্গে অনেক সিনেমায় কাজ করেছেন। অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে দুজনের শুরুটাও হয়েছিল একসঙ্গে। সেই মোহিত বলছিলেন ইমরানকে নিয়ে- 

‘ইমরানের মধ্যে প্রচলিতভাবে নায়ক বলতে যা বোঝায়, সেরকম কিছু পাবেন না আপনি। ওর সিক্স প্যাক অ্যাবস নেই, ভালো নাচতে পারে না, সেই অর্থে হার্টথ্রব হিরোও নয়। কিন্ত ওর স্পেশালিটি হচ্ছে, ও কাজটা আর পাঁচজনের মতো করে করে না। ওর নিজস্ব একটা ধরন আছে, সেটা রোমান্সের হোক, অ্যাকশনের হোক, কিংবা চুমু খাওয়ার দৃশ্যই হোক। ইমরানের মতো করে একটা কাজ আর কেউ করতে পারবে না। এটাই ওকে অনন্য করে তুলেছে।” 

আজহারের শুটিং চলার সময় মা মারা গিয়েছিলেন। একদিনের ছুটি নিয়ে তিনি এসেছিলেন মায়ের শেষকৃত্যে যোগ দিতে। সেটা শেষ করেই পরদিন আবার শুটিং-এ যোগ দিয়েছেন। জীবন নিয়ে উদাসীন সেই ইমরান, সিনেমাকে সিরিয়াসলি নিতে না চাওয়া ইমরান এখন কত পরিণত, কত বেশি পেশাদার! ২০১৬ সালে নিজের বায়োগ্রাফি ‘কিস অফ লাইফ’ মুক্তি পেয়েছে। চুমু যাকে অন্যরকম একটা খ্যাতি এনে দিয়েছে, বলিউড যার নামই দিয়েছে ‘চুম্বন দেবতা’, তার আত্মজীবনীতে চুমু থাকবে না, তা আবার হয় নাকি!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা