ফারুক আহমেদ, জনপ্রিয় অভিনেতা। হুমায়ূন আহমেদ তাকে আবিস্কার করেছিলেন, তার জহুরী চোখে ফারুকের ভেতরের অভিনেতার স্বত্বাটাকে দেখতে পেয়েছিলেন। হুমায়ূনের নাটক-সিনেমায় নিয়মিত মুখ ছিলেন তিনি, এখন চুটিয়ে অভিনয় করে চলেছেন। অভিনেতা হিসেবে তিনি অসাধারণ, তবে লেখক হিসেবেও যে তিনি দারুণ একজন, সেটা অনেকেই জানেন না। নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে ফারুক আহমেদ তার জীবনের একটি ঘটনা শেয়ার করেছেন, সেটি এগিয়ে চলোর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
ফারুক আহমেদ: বিয়ের সময় আমি শ্বশুর বাড়ি থেকে যৌতুক হিসাবে উল্লেখ করার মত তেমন কিছু নেইনি। যৌতুকের প্রতি আমার একেবারে লোভ ছিল না একথা বললে মিথ্যা বলা হবে। কিঞ্চিৎ পরিমাণ লোভ আমার ছিলো। কিন্তু কয়েকটি বড় কারণে সেই লোভ থেকে আমি বেরিয়ে আসতে সক্ষম হই। কারণগুলি হলো:
- এক. যেহেতু আমি সুন্দরী বউ পেয়েছি তাই যৌতুক ফৌতুক নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তাড়াতাড়ি বউ নিয়ে বাড়ি চলে এসেছি।
- দুই. বিয়ের কিছুদিন আগে থেকে কি কারণে জানিনা আমি আমার বন্ধুদের সাথে শুধু যৌতুকের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী কথা বলেছি। যেমন- যৌতুক নেয়া ভালো না। যারা যৌতুক নেয় তারা লোভী ইত্যাদি। এখন আমি যদি আমার বিয়েতে যৌতুক নেই তাহলে বন্ধুদেরতো আমি মুখ দেখাতে পারব না। তারা বলবে যৌতুকের বিরুদ্ধেে কত বড় বড় কথা বললি। এখন তো ঠিকই যৌতুক নিলি।
- তিন. আমার বাবার কারণে। আমার বাবা ছিলেন যৌতুকের ঘোর বিরোধী। তাঁর ভয়ে যৌতুকের 'য' উচ্চারণ করতে পারি নাই।
যাই হোক মোটামুটি যৌতুক ছাড়াই আমি বিয়ে করেছি। তাতে আমার লাভ হয়েছে এই যে, শ্বশুর বাড়িতে আমি বুক চেতিয়ে ঘুড়তে পারি। শালা শালীরা আমাকে সম্মান করে। কথা কাটাকাটি হলেও তারা আমাকে খোঁটা দিতে পারেনা। অবশ্য আমার বিশ্বাস, যৌতুক নিলেও তারা এব্যাপারে কখনও আমাকে খোঁটা দিতো না। তারা প্রত্যেকেই শুদ্ধ মনের অধিকারী এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত।
এবার আসল প্রসঙ্গে আসি। আমার শ্বশুর আসির উদ্দীন আহম্মেদ মারা যান ২০০৫ সালে। তিনি অত্যন্ত বিখ্যাত মানুষ ছিলেন। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান আমলে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকে সাংবাদিকতা করেছেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন জনপ্রিয় পাক্ষিক "ঝিনুক" সিনে পত্রিকার স্বত্বাধিকারী ও সম্পাদক। পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম থিয়েটার দল করেন তিনি। দর্শনীর বিনিময়ে নাটক দেখার রেওয়াজ প্রথম তিনিই চালু করেন। তাঁর দলের নাম ছিলো "মিনার্ভা থিয়েটারর্স"। তিনি গ্রামীণ জীবনে যাত্রাপালাকে অধিক জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে যাত্রা সমিতির সভাপতি ছিলেন। তিনি এক সময় ছিলেন বাচসাসের সভাপতি। স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে শিল্প সংস্কৃতির সাথে জড়িত সকলেরই আসির উদ্দীন আহাম্মদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততা ছিলো।
মৃত্যুর কিছুদিন আগে আমার শ্বশুর আমাকে তাঁর জয়কালি মন্দির "ঝিনুক" পত্রিকা অফিসে নিয়ে গেলেন। অফিস রুমে তিনি আমাকে তাঁর সামনাসামনি বসতে বললেন। আমি বসলাম। তিনি কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ফারুক আমি আজ তোমাকে একটা জিনিস দিবো। তুমি যত্ন করে রেখে দিবে। আমার ধারনা তুমি জিনিসটার মূল্য বুঝবে। তারপর সহাস্যমুখে বললেন, মনে করো তোমার বিয়েতে আমি শ্বশুর হিসাবে যৌতুক দিলাম।
আমি চিন্তায় পরে গেলাম। তাঁর মেয়েকে আমি বিয়ে করেছি অনেক বছর আগে। যৌতুকের জন্য তাঁর মেয়েকে কোনদিন প্রেশার ক্রিয়েট করেছি বলে তো আমার মনে পড়ে না। নাকি রাগের মাথায় তাঁর মেয়ে অর্থাৎ আমার স্ত্রী নাসরিনকে বলেছি, যাও বাপের কাছ থেকে আমার জন্য একটা বাইসাইকেল নিয়ে আসো। না তো, এমন কথা নাসরিনকে বলেছি বলেতো মনে পড়ে না। তাহলে বিয়ের এত বছর পর শ্বশুর আমাকে যৌতুক দিতে চাচ্ছেন কেন? আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম।
আমার চিন্তাযুক্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, কি চিন্তা করছো? চিন্তার কিছু নাই। বলেই তিনি পাশের টেবিল থেকে বিরাট একটি রেডিও আমার সামনে রাখলেন। তারপর আবারও হেসে বললেন, এই নাও তোমার বিয়ের যৌতুক। আমি রেডিওটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। এত বড় রেডিও আমার বাপের জনমে দেখি নাই। ৩২ ইঞ্চি টেলিভিশনের সমান। অনেক পুরানো। ধারনা করলাম এত বড় আর এই মডেলের রেডিও ষাটের দশকের হবে। তিনি বললেন, কি পুরানো রেডিও দেখে মন খারাপ হয়েছে। আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, জ্বি। তিনি তখন বললেন, মন খারাপ করার কিছু নাই।
তিনি তখন তাঁর বয়ান শুরু করলেন। শোন, এই রেডিওটার আছে একটা দীর্ঘ ইতিহাস। সম্ভবত ১৯৫৯ সালে আমি এই রেডিওটা কিনেছিলাম। তখন থেকে এই রেডিওটা আমার কাছে আছে। কত খবর, কত গান, কত নাটক, কত রাজনৈতিক বক্তৃতা আমি এই রেডিওতে শুনেছি। কত যে স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই রেডিওর সাথে আমার! বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ, মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের খবর সব শুনেছি এই রেডিওতে। এখন এটা বাজে না। নষ্ট হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর আগে। আজ থেকে আমার অনেক প্রিয় এই রেডিওটা তোমার। বললাম তো, মনে করো আমি তোমাকে এই রেডিওটা যৌতুক দিলাম। তুমি যত্ন করে এন্টিক হিসাবে রেখে দিও।
বলতে বলতে তাঁর গলা ভারি হয়ে গেল। আমি দেখলাম আমার শ্বশুরের চোখে পানি। এক সময় আমার চোখও ছলছল করে উঠলো। আমি গভীর আবেগে আমার শ্বশুরকে আস্তে আস্তে বললাম, জ্বি আব্বা, রেখে দিব। আপনার দেওয়া মহামূল্যবান এই যৌতুক আমি রেখে দিবো। সেই থেকে রেডিওটি আমার কাছেই আছে...
বিঃ দ্রঃ- রেডিওটির সামনের এবং পেছনের অংশের ছবি পাঠকদের দেখার জন্য সংযুক্ত করে দিলাম। বর্তমানে রেডিওটির আনুমানিক বয়স ৬৫ বছর।