ফারুকীর সিনেমা পছন্দ না-ই করতে পারেন, কিন্তু এই লোকটা যে একজন জিনিয়াস, এতে কোনো সন্দেহ নেই। নইলে কি ইরফান-নওয়াজের মতো অভিনেতা থেকে শুরু করে এ আর রহমানের মতো কিংবদন্তী এসে কাজ করেন তার সঙ্গে?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সিনেমা আপনি পছন্দ না করতেই পারেন, তার সিনেমাকে আপনার কাছে নাটক মনে হতেই পারে, কিংবা তার মার্কেটিং স্ট্র‍্যাটেজিটাও কারো ভালো না লাগতেই পারে- কিন্ত এই লোক যে একটা জিনিয়াস, তাতে কোন সন্দেহ নেই। নইলে কি আর ইরফান খানের মতো ডাকাবুকো অভিনেতা সিনেমার গল্প শুনেই সহ-প্রযোজক হতে রাজী হয়ে যান? ব্যস্ত শিডিউলের মাঝখান থেকে ফারুকীর সিনেমায় কাজ করার জন্য সময় বের করেন নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী? এ তো গেল অভিনেতাদের কথা, অস্কার বিজয়ী কিংবদন্তী সঙ্গীত পরিচালক এ আর রেহমানও ফারুকীতে মুগ্ধ, আর তাই তো ফারুকীর নতুন সিনেমা 'নো ল্যান্ডস ম্যান'- এ নাম লিখিয়ে ফেলেছেন তিনিও। এই সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনা করবেন এ আর রেহমান, সিনেমাটির যৌথ প্রযোজকও তিনি। 

ভ্যারাইটি ডটকমকে এ আর রেহমান নিজেই নিশ্চিত করেছেন ফারুকীর সঙ্গে কাজ করার খবরটা। পরে অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশার ভ্যারিফাইড ফেসবুক পেজ থেকেও আপলোড দেয়া হয়েছে ছবি, সেই ছবিতে আছেন ফারুকী, তিশা এবং এ আর রেহমান। অভিবাসী সমস্যা নিয়ে নির্মিত 'নো ল্যান্ডস ম্যান' সিনেমায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করছেন নওয়াজউদ্দীন সিদ্দিকী। দক্ষিণ এশিয়ান এক ব্যক্তির জীবনের ঘটনা নিয়ে এগিয়েছে গল্পটা, যার পরিচয় হয় এক অস্ট্রেলিয়ান নারীর সাথে। তারপর তাদের জীবনের গল্পে মোড় আসে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে। ইংরেজী ভাষায় নির্মিত নো ল্যান্ডস ম্যান- এ আরও অভিনয় করছেন তাহসান এবং অস্ট্রেলিয়ান অভিনেত্রী মিশেল মেগান। 

এ আর রেহমানের সঙ্গে ফারুকী ও তিশা

এ আর রেহমানকে তো নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। বলিউড এবং দক্ষিণী সিনেমায় অসাধারণ সব কাজ করেছেন এই সঙ্গীত পরিচালক। বম্বে, রোজা, দিল সে থেকে শুরু করে রকস্টার, বা হাইওয়ে- তার মিউজিক মানেই অন্যরকম কিছু। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে 'স্ল্যামডগ মিলিওনিয়ার' সিনেমার সঙ্গীত পরিচালনা করে তিনি অস্কার জিতেছেন, সেটা সম্ভবত রেহমানের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে দুর্বল কাজ। সেই এ আর রেহমান বাংলাদেশী একজন পরিচালকের সিনেমায় সঙ্গীত নির্দেশনা দেবেন- এটা ছোটখাটো কোন বিষয় নয়। শুধু তো সিনেমার মিউজিক নিয়েই কাজ করছেন না রেহমান, গল্প, নির্মাতা, অভিনেতা- সবকিছু তাকে এমনভাবে কনভিন্স করেছে যে, তিনি সিনেমাটার সহ-প্রযোজকই হয়ে গেছেন! 

ইরফান, নওয়াজ, এবার এ.আর রেহমান- ফারুকী নিজেকে ক্রমশ অন্য মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছেন, যেখানে যাওয়াটা বাকীদের জন্যে কল্পনার মতোই। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, কবে আরেকজন বাংলাদেশী পরিচালক ইরফান বা নওয়াজের মাপের আর্টিস্টকে নিয়ে কাজ করবে? কিংবা এ আর রেহমান আবার কবে কোন বঙ্গসন্তানের কাজে মুগ্ধ হয়ে তার সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনা করবেন? হয়তো করবেন, দশ-পনেরো-বিশ বছর পরে। সেটা ফারুকী এখন করছেন। সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা একজন তো তাকে শুধু শুধু বলা হয় না। 

তবুও তার প্রচুর হেটার। তাকে পছন্দ করে এমন দর্শকের সংখ্যা আর পছন্দ করে না এমন দর্শকের সংখ্যা বোধহয় কাছাকাছিই হবে। তার সিনেমা মুক্তির আগেই আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে, ফারুকীর সাক্ষাৎকার থেকে শুরু করে সিনেমার বিষিয়বস্তু- সবকিছু নিয়েই চুলচেরা গবেষণা হয়। বাংলাদেশে কোন পরিচালকটা এর আগে সমানভাবে দর্শক এবং মিডিয়া- দুই পক্ষের কাছেই এমন আকর্ষণ তৈরী করতে পেরেছিলেন, আমার জানা নেই। 

নির্মাতা হিসেবে ফারুকী বরাবরই ভিন্ন ধারার কাজ করতে চেয়েছেন, করেছেনও। জনপ্রিয় ধারার বিপরীতে হেঁটে গল্প বলতে চেয়েছেন তিনি, রূপালী পর্দায় তুলে আনতে চেয়েছেন জীবনের টানাপোড়ন, সমাজের নানা অনিয়ম আর অসঙ্গতিকে। সেটা ব্যাচেলর হোক, মেড ইন বাংলাদেশ হোক, কিংবা থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার বা টেলিভিশন- প্রতিটা জায়গায় ফারুকী সবকিছুর ওপরে গল্পকে ঠাঁই দিয়েছেন। 

ফারুকীর 'ডুব' সিনেমায় কাজ করেছেন ইরফান

ফারুকীর সিনেমায় কোথায় যেন একটা বেপরোয়া ভাব আছে, সমাজের ভ্রান্ত সব নিয়ম-নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখানোর একটা সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা আছে। আর তাই সমালোচনাটাও বরাবর বেশিই জুটেছে তার পাতে। সেই ‘ব্যাচেলর’ থেকে শুরু করে মেড ইন বাংলাদেশ, পিঁপড়াবিদ্যা বা হালের ডুব- তার প্রতিটা কাজ নিয়েই বিভক্ত হয়েছে দর্শকেরা। সমাজের একচোখা দৃষ্টিভঙ্গি আর নিয়ম-নীতির দিকে বরাবরই সাহসের সঙ্গে আঙুল তুলেছেন ফারুকী। নিজের সিনেমায় শিক্ষণীয় কিছু আছে বলে কখনও দাবী করেননি তিনি, জীবনের গল্প বলে দর্শককে খানিকটা সময় আনন্দ দিতে চেয়েছেন কেবল।

আর চেয়েছেন বাংলা সিনেমার নিজস্ব একটা ভাষা তৈরি করতে। তার মতে- "আমাদের সিনেমার নিজের কোন ভাষা নাই। আপনি হলিউড সিনেমা দেখলে বুঝবেন সেটা হলিউড সিনেমা, বলিউড সিনেমা দেখলে বুঝবেন সেটা হিন্দি সিনেমা, ইরানি সিনেমা সাউন্ড অফ করে দেখলেও আপনি বুঝবেন সেটা ইরানি সিনেমা। কিন্তু আমাদের সিনেমা দেখলে বুঝা যায় না সেটা আমাদের সিনেমা।" সেই ভাষাটাই তৈরি করতে চেয়েছেন ফারুকী। 

বিনিময়ে উপহার পেয়েছেন গালি, নিন্দা, ঘৃণা। সমালোচনা এক জিনিস, যে কোন কাজ নিয়েই সমালোচনা হতে পারে। ফারুকীর বেলায় ব্যপারটা সমালোচনার জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, অতিক্রম করে গেছে সীমারেখা। তার অপরাধ হয়তো এটাই যে, তিনি প্রথা ভাঙতে চেয়েছেন, স্রোতের বিপরীতে হাঁটার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। রূপালী পর্দায় চিরচেনা গল্প না বলে তিনি অসামঞ্জস্যতা আর অসঙ্গতি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, আঘাত করেছেন আমাদের ফিক্সড মাইন্ড সেটআপ- এ। সেকারণেই তাকে শূলে চড়ানো হয়েছে বারবার, সামনেও হবে, তাতে সন্দেহ নেই। 

তবে ফারুকী অন্য ধাতুতে গড়া। এসব নিন্দায় তিনি কান দেন না। বরং মাঝেমধ্যে মনে হয়, এগুলো তার মার্কেটিং স্ট্র‍্যাটেজিরই অংশ কিনা! তার সিনেমাকে লোকে ধুয়ে দিচ্ছে, বিগ বাজেটের একটা সিনেমা সেন্সরে আটকে আছে, কোনদিন আলোর মুখ দেখবে কিনা কেউ জানে না- অথচ ফারুকী পেছনে না তাকিয়ে নিজের পরের সিনেমায় নওয়াজকে কাস্ট করেছেন, এ আর রেহমানকে নিয়ে এসেছেন! কাজের প্রতি তিনি কতটা ফোকাসড- সেটা বোঝার জন্যে এটুকু উদাহরণই যথেষ্ট মনে হয়।

নওয়াজের সঙ্গে ফারুকী, নো ল্যান্ডস ম্যান- এর সেটে

ব্যক্তিগতভাবে ফারুকীর কাজ আপনার ভালো না লাগতে পারে, তার চিন্তাভাবনার সঙ্গে আপনি একমত না'ই হতে পারেন, কিন্ত বাংলা সিনেমায় যে গুণগত পরিবর্তনটা এসেছে, গল্পনির্ভর সিনেমা হচ্ছে, মারদাঙ্গা অ্যাকশন বা দুষ্টুমিষ্টি প্রেম ফেলে রেখে জীবনধর্মী ভিন্নধারার সিনেমা নির্মাণে আমাদের পরিচালকদের আগ্রহী হবার পেছনে ফারুকীর অবদান অবশ্যই আছে, এই সত্যিটাকে অস্বীকার করা যাবে না কোনভাবেই।  

সিনেমার অশ্লীলতার সেই অন্ধকার যুগে তারেক মাসুদের মতো পরিচালকের ছায়াতলে থেকে অন্যরকমের সিনেমা বানানোর লড়াইটায় তাকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন ফারুকী, তারেক মাসুদ অবেলায় হারিয়ে যাবার পরেও তিনি টেনে নিয়ে গেছেন সেটাকে, এখনও যাচ্ছেন। সবচেয়ে বড় কথা, কাজ করতে করতে নিজের হাতে অনেকগুলো মেধাবী পরিচালকে ফারুকী তৈরী করেছেন, তারা এখন গোটা নাটক ইন্ডাস্ট্রিটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, তাদের অনেকে তো সিনেমাতেও নাম লিখিয়েছেন। 

আমাদের চলচ্চিত্রে গর্ব করার মতো সবশেষ নির্মাতা ছিলেন তারেক মাসুদ, তার স্বাধীনভাবে নিজস্ব স্টাইলে গল্প বলার লিগ্যাসিটা এখন বয়ে নিয়ে চলেছেন ফারুকী। মানুন আর না মানুন, এই ভদ্রলোকই বিশ্ব অঙ্গনে বাংলা চলচ্চিত্রকে পৌঁছে দিচ্ছেন এখন, যতোই আপনি তাকে 'বাংলার কিয়োরোস্তমি' বা 'অ্যাওয়ার্ড সেন্ট্রিক ডিরেক্টর' বলে উপেক্ষা করতে চান না কেন, সেটা সম্ভব নয়। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে ফারুকীকে হয়তো অপছন্দ করা যাবে, উপেক্ষা নয়... 

আরও পড়ুন-


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা