ঘুষেও পেট ভরে নি হারামখোর কর্মকর্তার। তাকে বকশিশও দিতে হয়। কি বকশিশ জানেন? কৃষকের কষ্টের ফলানো ফসল! দুই বস্তা ধান কৃষকের কাছ থেকে রেখে দেয় সেই কর্মকর্তা বকশিশ হিসেবে।

হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন 'তলাবিহীন ঝুড়ি'। আজ আমরা সেই মন্তব্যকে ভুল প্রমাণ করে অনেক দূর এগিয়েছি তা নিঃসন্দেহে বলতে পারি। কিন্তু এই এগিয়ে যাওয়ার আড়ালে কিছু পিছিয়ে যাওয়ার গল্পও কি আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়? হ্যা, বেড়ায় যখন আমরা আমাদের শিকড়ের দিকে তাকাই।

আজকে আমরা বলি, খাদ্যে বাংলাদেশ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্র। এই কথা আমরা যখন বড় গলায় বলছি, সভা সেমিনারে উচ্চারণ করছি, কীবোর্ডে লিখছি - তখন কি আমাদের মাথায় থাকছে এই অর্জনের পেছনের কারিগররা কেমন আছেন? কেমন আছেন কৃষকরা?

কৃষকদের জন্যে বীজ সরবরাহ, সার সরবরাহ কিংবা ব্যাংক একাউন্ট সুবিধা দেয়ার কথা সহ নানান কথা টেনে আমরা দাবি করতেই পারি, কৃষকদের জন্যে অনেক কাজ হচ্ছে। কিন্তু, মৌলিক জায়গা কি ঠিক হয়েছে এতো বছরেও? কৃষকের কষ্টের বিনিময় স্বার্থক হবে যদি তিনি তার শ্রমের ন্যায্যতা পান। তার ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত থাকে। তাহলেই না কৃষকের মুখের হাসি চওড়া হবে।

পরিশ্রমের ফসল  

কিন্তু আমরা দেখছি, কৃষকের কি অদ্ভুত দুরবস্থা। এবছর আমরা দেখেছি কৃষকরা ন্যায্যমূল্য না পেয়ে নিজের জমিতে আগুন দিচ্ছে। ধান কাটার যে খরচ তা দিয়ে পোষায় না, যখন ধান বিক্রির সময় আসে। সিন্ডিকেট, আড়তদারদের কারণে কৃষককে বাধ্য হয়ে কম দামে ফসল বিক্রি করতে হয়। আর কেউ এতো হতাশ হয়ে যায়, রাগে আগুন জ্বালিয়ে দেয় নিজের ফসলে।

এবার আরো মাথা গরম হয়ে যাওয়ার গল্প শুনুন। কক্সবাজারে এই ঘটনাটি ঘটেছে এবছর। সেখানে কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয়ে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতি টন ধানে ঘুষ দিতে হচ্ছে ৩ হাজার টাকা।

কক্সবাজার সদর উপজেলার ঘটনা এটি। সেখানে পিএমখালী ইউনিয়নের মাছুয়াখালী গ্রামের কৃষক ছালামত উল্লাহ ও তাঁর চাচা রমজান আলী গত ১৬ জুলাই সদর খাদ্যগুদামে বিক্রির জন্য ছয় মেট্রিক টন ধান নিয়ে আসেন। কিন্তু খাদ্য গুদামের কর্মকর্তা সালাউদ্দিন শুরু করেন টালবাহানা। তার মূল উদ্দেশ্য ঘুষ খাওয়া। তাই, তিনি একটি অলীক অভিযোগ তুলেন, বলেন ধান নিম্নমানের। এই অজুহাত দেখিয়ে সালাউদ্দিন কৃষকের কাছে প্রতি টন ধানের জন্য ৩ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন।

কৃষক তো আজন্মই নিরুপায়। তারই ঠেকা। কারণ, কাদামাটি মাখিয়ে রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এই কাজ তো আর কেউ করবে না। সে করে, তাই সে বিপদে পড়ে। তাকে সবাই ঠকাতে চায়। দামে ঠকে, জীবনেও সে ঠকে বার বার। এই কৃষকরাও ( ছালামাতউল্লাহ, তার চাচা) নিরুপায় ছিলেন। দরকার ছিল জরুরি অর্থের। তাই, নিজের পরিশ্রমের ফসল বিক্রি করতে গিয়ে ঘুষ দেয়া ছাড়া আর কোনো পথ রইলো না তাদের সামনে। ৬ টন ধান বিক্রি করতে তাদের ঘুষ দিতে হয় ১৮ হাজার টাকা, অর্থাৎ প্রতি এক টনের জন্য ৩ হাজার।

 

কৃষকদের ঘামের সাথে প্রতারণা করা চলবে না!

শুধু তা-ই নয়, ১৮ হাজার টাকা ঘুষেও পেট ভরে নি হারামখোর কর্মকর্তার। তাকে বকশিশও দিতে হয়। কি বকশিশ জানেন? কৃষকের কষ্টের ফলানো ফসল! দুই বস্তা ধান কৃষকের কাছ থেকে রেখে দেয় সেই কর্মকর্তা বকশিশ হিসেবে।

এই ঘুষ নেয়ার ঘটনা জেনেছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকও। তিনি এই ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রথম আলোকে বক্তব্য দেন, "ঘটনাটি আমি জানি। তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি। পরবর্তীতে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে কঠোর ব্যবস্থা নেব।"

এটাই হলো কৃষকের অবস্থা। সরকারের শস্য মজুদের জায়গা সীমিত। তাই সরকার চাইলেও কৃষকের সব ফসল কিনে নিতে পারে না। আবার সরকারি গুদামে বিক্রি করতে গিয়ে এরকম ঘুষ দেয়ার ব্যাপার তো কিছুক্ষেত্রে থাকেই। অন্যদিকে কৃষকেরও নিজস্ব গুদাম নেই, ধান, চাল সংরক্ষণের। সে কি করবে? বাধ্য হয়ে তাকে কম দামে আড়তদারের কাছে ছেড়ে দিতে হয় ফসল। এই চক্র চলতেই থাকে। কৃষকের ভাগ্য বদলায় কদাচিৎ। কৃষককে উল্টা সারভাইভ করার স্বার্থে ঘুষও দিতে হয়, এই ঘুষ হলো এদেশে বেঁচে থাকার ঘুষ!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা