ফারহান আখতার: মাল্টি ট্যালেন্টেড এক জিনিয়াসের গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
অন্যের আলোয় নয়, নিজের প্রতিভায় আলোকিত হতে চেয়েছেন ফারহান, হয়েছেনও। জাভেদ আখতারের ছেলে হিসেবে নয়, ফারহান পরিচিতি পেয়েছেন নিজের নামেই। বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী এমন একটা মানুষ নিজের যোগ্যতায়, নিজেত প্রতিভায় নিজের নামটা বলিউডের ইতিহাসে স্মরণীয় করে লিখে রেখে যাবেন, এটা সুনিশ্চিত।
বাবা-মায়ের সেপারেশনটা মেনে নিতে পারেনি ছেলেটা। আগে থেকেই চুপচাপ স্বভাবের ছিল, এই ঘটনার পরে আরও বেশি অন্তর্মূখী হয়ে পড়লো সে। কলেজে যেতে ভালো লাগে না, পড়ালেখায় মন বসে না। ক্লাসমেটরা যখন ভারী ভারী বইয়ের নিচে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করে নিচ্ছে নির্দ্বিধায়, তখন তার হাজিরার খাতায় একটার পর একটা শূন্য দাগ! কলেজের নাম করে সে বাসা থেকে বের হতো ঠিকই, কিন্ত গন্তব্য হতো অন্য কোথাও। কখনও পার্ক, কখনও রেলস্টেশন, কখনও বা সিনেমা হল। মা জানতেনও না, ছেলে কলেজে না গিয়ে অন্য কোথাও বসে আছে!
কলেজ থেকে বাবা-মা'কে ডাকা হলো। ছেলেটা বাসায় কিছুই জানালো না। চিঠি দেয়া হলো বার দুয়েক, সেগুলো পড়ে রইলো তার ব্যাগের কোণে। তারপর যা হবার তা-ই হলো, বাধ্য হয়ে তাকে কলেজ থেকে বহিস্কার করলো কর্তৃপক্ষ। ছেলেটাও বাসায় এসে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই মা'কে জানালো খবরটা। জীবনের হাজারটা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়তে থাকা ভদ্রমহিলা কী করবেন বা কী বলবেন, সেটা বুঝে উঠতে পারলেন না ঠিকঠাক। তবে পড়ালেখা করতে যে ছেলের ভালো লাগছে না, সেটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তাই আর জোরাজুরি করলেন না, জোর করে যে কোনকিছু টিকিয়ে রাখা যায় না, সেটা তিনি বুঝে গেছেন অনেক আগেই।
ছেলেটা সারাদিন বাসায় শুয়ে-বসে কাটায়, টেলিভিশন আর কম্পিউটারে সিনেমা দেখে। সেই সিনেমা দেখার সিস্টেমটাও বেশ অদ্ভুত। একটা সিনেমা একবার দেখার পরে আবার দেখতো সে, সাউন্ড অফ করে দিয়ে, অনেকটা নির্বাক সিনেমার মতো করে। নিজের পছন্দমতো ডায়লগ সেখানে বসিয়ে সিনেমাটা অন্যরকমভাবে কল্পনা করতো সে। এভাবে এক মাস-দুই মাস-তিন মাস করে দুটো বছর কেটে গেলো। সারাদিন সিনেমা দেখা ছাড়া ছেলেটার আর কোন কাজ নেই। কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে। মা একদিন হুমকি দিলেন, কিছু একটা না করলে বাসা থেকে বের করে দেবেন।
এবার একটু নড়েচড়ে বসলো ছেলেটা। এর আগে সহকারী পরিচালক হিসেবে কয়েকটা সিনেমায় কাজ করেছে সে, সিনেমার এই জগতটাতেই সে থাকবে, এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। একটা গল্প ঘুরছিল মাথায় অনেকদিন ধরেই, তিন বন্ধুর গল্প, তাদের জীবনের গল্প। সেটাই লেখা শুরু করে দিলো সে। বাবা ছিলেন বলিউডের সর্বকালের সেরা চিত্রনাট্যকারদের একজন, ছিলেন সর্বকালের সেরা গীতিকারও। সেই বাবার রক্ত তো তার ধমনীতেও বইছে, মেধার স্মাক্ষর তিনি রাখবেন না, তা কী করে হয়? গল্প লেখা হয়ে গেল। বন্ধু রিতেশ সিধওয়ানির সঙ্গে মিলে অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পরে সিনেমাও বানানো হলো, সিনেমার নাম 'দিল চাহতা হ্যায়!' কার কথা বলছি, এতক্ষণে সবার বুঝে যাওয়ার কথা। মাল্টি-ট্যালেন্টেড জিনিয়াস, ফারহান আখতার- একাধারে যিনি অভিনেতা, পরিচালক, গায়ক, চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক- সবকিছুই!
যেখানে হাত দিয়েছেন, নিজের প্রতিভায়, নিজের মেধায় সোনা ফলিয়েছেন। ক্যামেরার পেছনে দারুণ সফলতা প্রাপ্তির পরে অভিনেতা হয়ে এসেছিলেন পর্দায়, অভিনেতা হিসেবে তিনি তো পরিচালনার চেয়েও সফল! ভাগ মিলখা ভাগ সিনেমায় অনবদ্য অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ জিতে নিয়েছিলেন ফিল্মফেয়ারে সেরা অভিনেতার পুরস্কারও! কার্তিক কলিং কার্তিক, রক অন কিংবা জিন্দেগি না মিলেঙ্গি দোবারায় দেখা ফারহানের দুর্দান্ত অভিনয় তো এখনও চোখে লেগে থাকার কথা দর্শকের!
তাহলে কি ফারহানের কোন খুঁত নেই? আছে তো! এই মানুষটা তেলাপোকাকে প্রচণ্ড ভয় পান। তেলাপোকা আর কুমির তার কাছে একই জিনিস। তবে ফারহান প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, একদিন তিনি এই তেলাপোকাভীতি দূর করবেনই। ব্যক্তিগত জীবনে অসম্ভব গোছানো স্বভাবের একজন মানুষ তিনি, বর্ডারলাইন অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার নামে এক বিরল রোগে তিনি আক্রান্ত, জিনিসপত্র গোছানো না দেখলে তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায় হুট করেই। অভিনেতারা নিজেদের ডায়েট নিয়ে খুব সচেতন হন, ফারহানের মধ্যে এত ভাবনা-চিন্তা নেই। মিষ্টি দেখলে তিনি বাছবিচার না করেই ঝাঁপিয়ে পড়েন!
প্রথম সিনেমা দিয়েই ফিল্মফেয়ারে সেরা চিত্রনাট্য আর সমালোচকের রায়ে সেরা সিনেমার পুরস্কার জিতেছিলেন ফারহান। রক-অনে অভিনয় করে বেস্ট ডেব্যুটেন্ট অ্যাক্টরের ট্রফিটা হাতে তুলেছিলেন, সেরা পার্শ্ব অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন জিন্দেগি না মিলেঙ্গি দোবারায়। বাকি ছিল সেরা অভিনেতার পুরস্কারটা, ভাগ মিলখা ভাগ দিয়ে সেটাও জিতে নিয়েছিলেন ২০১২ সালে। পরিচালক রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরার সঙ্গে তার জুটিটা মুগ্ধ করেছিল দর্শককে। ফারহানের ক্যারিয়ারের অনন্ত এক আক্ষেপের সঙ্গেও রাকেশের নামটা জড়িয়ে আছে। রঙ দে বাসন্তী সিনেমায় আমিরের চরিত্রটা প্রথমে ফারহানকে অফার করেছিলেন রাকেশ। ফারহান তখনও অভিনয়ে আসার ব্যাপারে সিরিয়াস ছিলেন না, তাই না করে দিয়েছিলেন। সেই আক্ষেপটা ফারহান এখনও করেন।
তবে ক্যারিয়ার শেষে আক্ষেপটা থাকবে না ফারহানের, সেটা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়। বাবা জাভেদ আখতার ছিলেন সূর্যের মতো একটা বিশাল নক্ষত্র, তার ছেলে হয়ে ফারহান আরেকটা সূর্যই হতে চেয়েছেন, চাঁদ হতে চাননি। অন্যের আলোয় নয়, নিজের প্রতিভায় আলোকিত হতে চেয়েছেন ফারহান, হয়েছেনও। জাভেদ আখতারের ছেলে হিসেবে নয়, ফারহান পরিচিতি পেয়েছেন নিজের নামেই। বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী এমন একটা মানুষ নিজের যোগ্যতায়, নিজেত প্রতিভায় নিজের নামটা বলিউডের ইতিহাসে স্মরণীয় করে লিখে রেখে যাবেন, এটা সুনিশ্চিত।
পাদটীকা: শাহরুখ খানের ক্যারিয়ারে এখন ভাটার টান, বক্স অফিসে সফলতা পাচ্ছে না তার সিনেমাগুলো, সমালোচকেরাও পছন্দ করতে পারছেন না সিনেমার বিষয়বস্তু। শাহরুখের কট্টর ভক্তদের অনেকেও এখন বিশ্বাস করে, এই অবস্থা থেকে শাহরুখকে উদ্ধার করতে পারেন একটা মানুষ- তিনি ফারহান আখতার! ডন-৩ সিনেমাটা এলেই নাকি এই শনির দশা কেটে যাবে! ভাবুন তো ব্যাপারটা, শাহরুখ ভক্তরাও এখন প্রিয় নায়কের ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট মানছেন ফারহানকে!