আল্লাহ বলেছেন, 'পশুর রক্ত বা মাংস নয়, তোমাদের তাকওয়াটাই পৌঁছায় আমার কাছে।' আল্লাহ তো বলেননি অন্য ধর্মাবলম্বীদের বাড়ির সামনে গরুর খুলিটা রেখে আসতে, কোথাও বলা হয়নি পশুর উচ্ছিষ্ট অংশগুলো মন্দিরে ফেলে আসতে। তাহলে এগুলো কারা করে? কেন করে?

ঘটনা এক

চট্টগ্রামের একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করি। সাতকানিয়া উপজেলার দক্ষিণ ধর্মপুর গ্রামের মা মগদেশ্বরী মন্দির। গতকাল সন্ধ্যায় কে বা কারা সেখানে জবাই করা গরুর চোয়ালের হাড়, খুলির অংশবিশেষ ফেলে রেখে গেছে। মন্দিরের পবিত্রতা নষ্ট করার জন্য সেখানে থাকা মায়ের ঘট লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে, পশুর উচ্ছিষ্টাংশ ফেলে রেখে গেছে সেই জায়গাতেও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গতকাল রাত থেকেই ছবিগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিউজফিডে স্ক্রল করতে গিয়ে যতবার সেগুলো চোখের সামনে পড়ছে, ততবারই অক্ষম একটা আক্রোশ দানা বাঁধছে মনের ভেতর।

ঘটনা দুই

লোকমান নামের এক ভারতীয় ট্রাক চালক হরিয়ানায় তার ট্রাকে করে মোষের মাংস নিয়ে যাচ্ছিলেন। গত কুড়ি বছর ধরেই মাংস পরিবহনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত লোকমান। গতকাল আচমকা তার ট্রাককে ধাওয়া করলো একদল লোক, তারা নাকি গোরক্ষক সংঘের প্রতিনিধি! লোকমান ট্রাকে করে গরুর মাংস নিয়ে যাচ্ছেন, এমন অভিযোগ তুলে তাকে বেদম মারধর করা হলো। পুলিশ দাঁড়িয়েছিল সামনেই, তারা এগিয়ে আসেনি, হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেয়া হয়েছে লোকমানের। কেউ উঁকি মেরে দেখতেও যায়নি যে ট্রাকে আসলে কিসের মাংস ছিল। 

আর গরুর মাংস থাকলেই বা কী? ভারত সরকার তো গরুর মাংস খাওয়ার ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা জারী করেনি এখনও! লোকমান জানেন না, কেন তার ওপর এমন অকথ্য নির্যাতন করা হয়েছে, তিনি জানেন না তার কোন পাপ ছিল কিনা। তিনি শুধু জানেন, সংখ্যালঘু হওয়ার মতো বড় পাপ আর নেই। 

ঘটনা তিন

আবার বাংলাদেশে আসি। ঈদের একদিন আগে অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহা সাহা মিম একটা ছাগলের ছবি ফেসবুকে শেয়ার করে লিখেছিলেন, তার বাসায় যারা তাকে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করেন, ড্রাইভার, গৃহকর্মী- তাদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়ার জন্যেই কুরবানীর উদ্দেশ্যে এই ছাগলটা কেনা হয়েছে। সবাকে ঈদের শুভেচ্ছাও জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্ত বিনিময়ে পেয়েছেন গালাগাল আর ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। শুভেচ্ছার পরিবর্তে শুভেচ্ছা জানানোর পরিবর্তে মিকে বরং নসিহত দিয়েছে 'ফেসবুক মুমিন'রা। মিমও জেনে গেছেন নিশ্চয়ই, তারকা হোন আর যাই হোন, দিনশেষে এই দেশে তিনি সংখ্যলঘুই। 

এই ছবি আপলোড দিয়েই গালাগাল আর ট্রলের শিকার হতে হয়েছে মিমকে

সকল কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল- স্বয়ং আল্লাহ তাআলা বলেছেন কথাটা। মিমের নিয়তে কোন ভুল ছিল না। তিনি তার বাসার সাহায্যকারী লোকগুলোকে পরিবারের সদস্য মনে করেই তাদের জন্য কুরবানীর ব্যবস্থা করেছিলেন, ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চেয়েছিলেন তাদের সঙ্গে। কিন্ত ধর্মান্ধদের সেটা সহ্য হলো না। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, মিমের কুরবানী নিয়ে তাকে ট্রল করা এই লোকগুলোই জীবনে অসহায় মানুষের দুই পয়সার উপকারেও আসেনি, দেশ, সমাজ এবং মানবতার প্রতি তাদের কন্ট্রিবিউশন বলতে পাবলিক প্ল্যাটফর্মে অন্যকে গালাগালি করাটাই। 

ঘটনা চার

কুরবানীর ঈদের ঠিক পরপর, গরুর উচ্ছিষ্টাংশ এবং হাড়গোড় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রেখে আসার মতো ন্যাক্কারজনক একাধিক ঘটনা ঘটেছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। আমরা হয়তো হেসে উড়িয়ে দেব, কিংবা 'ছোটদের কাজ' বলে পাত্তা না দিয়ে এড়িয়ে যাব। কিন্ত যাদের সঙ্গে এই ঘটনাগুলো ঘটেছে, তারাই জানে, পুরো ব্যাপারটা কতটা অপমানজনক। এগুলো শিশুতোষ কোন খেলা না। এটা জেনে, বুঝে, ঠান্ডা মাথায় অন্য ধর্মের মানুষের ওপর চালানো বর্বর অত্যাচার। ধার্মিক আর ধর্মান্ধের মধ্যে যে বড়সড় পার্থক্য আছে, অনেকেই ভুলে যায় সেটা। 

আল্লাহ কুরবানী সম্পর্কে বলেছেন, 'জবাইকৃত পশুর রক্ত বা গোশত আমার কাছে পৌঁছায় না, যেটা পৌঁছায়, সেটা হচ্ছে তোমাদের তাকওয়া।' আল্লাহ তার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু কুরবানী দিতে বলেছেন, সেই পশুর মাংস ভাগ করে আত্মীয়-স্বজন এবং গরীব-অসহায় মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিতে বলেছেন। কিন্ত কোথাও তো বলেননি, অন্য ধর্মের মানুষের বাড়ির সামনে গরুর খুলিটা রেখে আসতে, কোথাও বলা হয়নি পশুর উচ্ছিষ্ট অংশগুলো মন্দিরে ফেলে আসতে। তাহলে এগুলো কারা করে? কেন করে? এমন অপকর্ম করার সাহসটাই বা এরা পায় কোথায়? 

সাহস সম্ভবত আমরাই দিয়েছি। এই যে প্রতিবছর দূর্গাপূজার মৌসুম এলেই পাইকারী হিসেবে মন্দিরে হামলা চালানো হয়, প্রতিমা ভাংচুর করা হয়, এসব ঘটনার এক পার্সেন্টেরও কি বিচার হয়? কখনও শুনেছেন, প্রতিমা ভাংচুরের দায়ে কারো পাঁচ-সাত বছরের কারাদণ্ড হতে? বছরের পর বছর আশকারা পেয়ে পেয়ে ধর্মান্ধ ইতরের দল ভেবেই নিয়েছে, নব্বই পার্সেন্ট মুসলমানের দেশে মন্দিরে হামলা করা, অন্য ধর্মের মানুষকে নির্যাতন করাটা তাদের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে! একটা ধর্মের মানুষজনকে তাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের আগে বিনিদ্র রাত কাটাতে হয় মন্দির পাহারা দিয়ে- এরচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা আর কি হতে পারে? 

সাতকানিয়ায় মন্দিরে ফেলে আসা হয়েছে গরুর উচ্ছিষ্ট হাড়গোড়

সংখ্যালঘু শব্দটা যত ছোট, সংখ্যালঘু নির্যাতনের কনসেপ্টটা এত ছোট নয়। সংখ্যালঘু নির্যাতন বলতে যদি আপনি বাংলাদেশে মন্দির-প্রতিমা ভাংচুর, আর ভারতে গরুর মাংস খাওয়ার অপরাধে মুসলমান নাগরিককে পিটিয়ে হত্যা করাটাকেই বুঝে থাকেন- তাহলে এই শব্দটার মানে আপনার জানা নেই। 'মালাউন' গালি দিলেই শুধু সংখ্যালঘু নির্যাতন হয় না, আপনি যখন পশুর শরীরের অংশবিশেষ আপনার হিন্দু প্রতিবেশীর বাড়ির সামনে রেখে আসেন, সেটাও সংখ্যালঘু নির্যাতন। 

আপনি আপনার হিন্দু বন্ধুটিকে 'আরে অনেক হিন্দুকেই তো খাইতে দেখসি, তুই খাইলে আর এমন কি হবে' বলে যখন গরুর মাংস খাওয়ার জন্য চাপাচাপি করেন, সেটাও সংখ্যালঘু নির্যাতনের মধ্যেই পড়ে। ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণে ইসলামে শুকরের মাংস খাওয়া হারাম। কিন্ত বিশ্বের অজস্র মুসলমানই শুকরের মাংস খায়, ইউরোপ-আমেরিকায় তো এটা একদমই স্বাভাবিক। সেটার উদাহরণ টেনে আপনাকে কেউ শুকরের মাংস খাওয়ার জন্য জোর জবরদস্তি করলে আপনার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে না। যে হিন্দু লোকটা খুশিমনে গরুর মাংস খায়, সেটা যেমন তার চয়েজ, যে খেতে চায় না সেটাও তার চয়েজ। দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে, সেই পার্থক্য না বুঝে কারো ওপর জোর করাটা, তার ফুড হ্যাবিট নিয়ে ঠাট্টা করাটাও সংখ্যালঘু নির্যাতন। 

এরপরও এদেশের অজস্র মানুষ সংখ্যালঘু নির্যানের কথা শুনলে নাক সিঁটকে বলে, এগুলো সব ভুয়া কথা, বাংলাদেশের হিন্দুরা যত আরামে আছে, সেটা পৃথিবীর আর কোথাও নেই! সমস্যা হলো, এদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা অন্য ধর্মাবলম্বীরা ভালো আছে কি মন্দ আছে, সেটার সার্টিফিকেট মুসলমান কারো দেয়াটা মানায় না। হিন্দুরা ভালো আছে কিনা, পদে পদে তাদের অবহেলিত, নির্যাতিত হতে হয় কিনা, ঘৃণা বা আক্রোশের শিকার হতে হয় কিনা- সেটা হিন্দুদের মুখ থেকে শোনাই ভালো। নরেব্দ্র মোদি যদি বলেন ভারতের মুসলমানরা খুব ভালো আছে, সুখে আছে- সেটা কি কেউ বিশ্বাস করবে? 

ভারত হোক কিংবা বাংলাদেশ, এই অঞ্চলের নানা ধর্মাবলম্বী মানুষ একই রকমের ধর্মান্ধতায় আক্রান্ত। দুনিয়ার সব প্রান্তেই বোধহয় ধর্মান্ধদের চেহারা আর আচরণ একই। আমার শুধু খারাপ লাগছে সেই হিন্দু ধর্মাবলম্বী তরুণীটির জন্য, ঈদের আগের দিন যে নিজের হাত মেহেদীর রঙে রাঙিয়েছিল। ছোটবেলা থেকে যে মেয়েটা এই দেশটাকে, দেশের মানুষজনকে আপন ভেবে এসেছিল। ঈদের দিন বাড়ির সামনে পড়ে থাকা একটা গরুর খুলি তার সেই ভাবনার শেকড়ে গিয়ে আঘাত করেছে, শেকড়টাকে উপড়ে দিয়েছে। তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, এদেশের কিছু মানুষ তাদের আপন ভাবে না, নিজেদের একজন বলে মনে করে না। আমি সেই অভিমানী তরুণীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী... 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা